চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষগুলো কি সত্যিকারের আপন? একবার বিপদে পড়ুন টের পাবেন আপনজন কারা? বুঝবেন কীভাবে চারপাশের অনেকে সরে পড়ছে। আপনার বারোটা বাজাতে তৎপরতা চালাচ্ছে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় একদিন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা একসঙ্গে ঢাকার আদালত থেকে পুলিশ ভ্যানে উঠলেন। তাদের গন্তব্য ছিল কাশিমপুর কারাগার। আদালতে এসেছিলেন হাজিরা দিতে। বিষণ্ন্ন মনে গাড়ির ভিতরে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে উঁকি দিলেন দুই সিনিয়র রাজনীতিবিদ। একজন আওয়ামী লীগের, আরেকজন বিএনপির। হয়তো অজানা কষ্টে নীরবে ছাড়ছিলেন দীর্ঘশ্বাস। হঠাৎ খেয়াল করলেন, বাইরে থেকে একজন তাদেরকে নিয়ে কটূক্তি করছে। বলছে, এই চোররা এখন কেমন লাগছে? চুরি করিস কেন? এখন মজা লাগছে ধরা খেয়ে? দুই নেতা মাথা নিচু করে বসে পড়লেন। ঝাপসা চোখে পরস্পরের দিকে তাকালেন। এই নেতাদের বিরুদ্ধে আনীত কোনো অভিযোগ তখনো প্রমাণিত হয়নি। ওয়ান-ইলেভেন সরকার তাদের বিরুদ্ধে দুনিয়ার অভিযোগ আনল। আদালতে কোনোটার সত্যতার তথ্যপ্রমাণ দাখিল করতে পারেনি। মন খারাপ করলেন দুই নেতা। রাজনীতি করতে এসেছিলেন মানুষের জন্য। সেই মানুষদের একদল ভয়ে চুপসে গেছে। আরেকদল লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনায়। চারদিকের পরিবেশ তারা বুঝতে পারছিলেন না। হিংসা-প্রতিহিংসার টার্গেট শুধু রাজনীতিবিদ নন, ব্যবসায়ীরাও ছিলেন। জোয়ার-ভাটার এই দেশে আমরা খুব সহজে সবকিছু ভুলে যাই। ওয়ান-ইলেভেনের দুঃসহ জীবনের কথাও এখন আর কারও মনে নেই।
এই তো সেদিন বেইলি রোডে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে মৃত্যুকূপে পড়তে হয়েছিল নিরীহ মানুষকে। সবাই সুর তুললেন, ঢাকা শহরের রেস্টুরেন্ট ভবনগুলোকে নিয়মে আনতে হবে। কথার ফুলঝুরির ফোয়ারা উপচে পড়ছিল টকশোতে। বিভিন্ন সংস্থা অভিযান চালাল ঢাকা শহরের বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ভবনে। নিরীহ অনেক ব্যবসায়ী হয়রানিতেও পড়েন। এখন সবাই সবকিছু ভুলে গেছেন। পুনরায় এমন ঘটনা ঘটলে সবার সবকিছু আবার স্মরণে আসবে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় আমাদের দুই নেত্রীকে কারাগারে নেওয়া হলো। সারা দেশে বড় কোনো বিক্ষোভ হয়নি। নেতারা আপসের পথ খুঁজলেন। অনেকে হাত মেলালেন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে। নেত্রীদের বিরুদ্ধে বানোয়াট সরল স্বীকারোক্তি দিলেন। সেসব নেতা আবার মিশে গেছেন মূলধারার সঙ্গে। শুধু গোয়েন্দা সংস্থার অফিস ও ইউটিউবে নেত্রীদের বিরুদ্ধে দেওয়া তাদের সেই জবানবন্দি রয়ে গেছে। ইতিহাস বড়ই নিষ্ঠুর। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এখন টের পাচ্ছেন দলের ভিতরের বাইরের আপন পর। গত ১০ বছরে তার ভাবনার বাইরে ঘটে গেছে অনেক কিছু। দলের নেতাদের বারো রকমের রূপ দেখছেন বেগম জিয়া। হয়তো বুঝতে পারছেন ক্ষমতার অন্দরমহলের বাইরে থাকলে কী হয়।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/2024/05.%20May/19-05-2024/BD-Pratidin_2024-05-19-20.jpg)
বাঙালি চরিত্র অনেক বেশি জটিল। ব্রিটিশরা একসঙ্গে মিলিত হয়ে ক্লাব গড়ে। জাপানিরা গড়ে তোলে কর্মক্ষেত্র। বাঙালিরা লিপ্ত হয় হানাহানিতে। একই বৈঠকে চারজন চার মত। একটা পর্যায়ে হানাহানি, সংঘাত। পত্রিকায় দেখলাম, কুষ্টিয়ায় কুলখানির দাওয়াত নিয়ে সংঘর্ষে একজন নিহত। এমন খবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা থেকে বেশি আসে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার সমর্থন নিয়ে এই দেশের মানুষ খুনোখুনি করে। কান চিলে নিয়ে গেছে গুজবের পেছনে ছুটে সারাটা দিন বরবাদ করে। সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফিরে দেখে কান মাথার পাশেই আছে। শান্তি কারও ভালো লাগে না। পরস্পরকে দমিয়ে যত আনন্দ তাদের। পাশের বাড়ির মানুষের উত্থান কেউ মেনে নেয় না। অপরের খারাপ খবরে পোলাও, মাংস রান্না করে খায়। কথায় আছে- প্রতিবেশীর ছেলের পড়াশোনা হবে না। হলে, চাকরি পাবে না। চাকরি পেলেও বিয়ে হবে না। অপরের অদ্ভুত এমন সব অমঙ্গলে বাঙালির দিন কাটে। অপরের ভালো খবরে খুব কম বাঙালি আনন্দিত হয়।
বাঙালির নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে একটা গল্প আছে। সারা দুনিয়ার মানুষের জন্য তৈরি করা নরকে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা রেখেছেন ঈশ্বর। নরকের রক্ষীরা খেয়াল রাখে যাতে কোনো অপরাধী কোনোভাবে বের হয়ে পাশের স্বর্গে যেতে না পারে। রক্ষীরা কঠোরভাবে চারদিকে চোখ-কান খোলা রাখে। নিরাপত্তার কড়া ব্যবস্থা রাখা হয় নরকের সদর দরজা ও দেয়ালের চারপাশে। একমাত্র বাংলাদেশের জন্য রাখা নরকের দরজা ও দেয়ালের পাশে কোনো রক্ষী নেই। সবকিছু খোলা। স্বর্গের একজন দেবতা নরকের নিরাপত্তা দেখতে বের হলেন। তিনি খেয়াল করলেন, দুনিয়ার সব দেশের জন্য নিয়ম একটাই। আর বাংলাদেশের জন্য আরেকটি। বিস্মিত হলেন পরিদর্শক দেবতা। রহস্য জানতে হাজির হলেন ঈশ্বরের দরবারে। বললেন, বাঙালির জন্য করা নরকে ঢিলেঢালা ভাবের কথা। জানালেন সেখানে কোনো নিরাপত্তা রক্ষী নেই। অন্য দেশের নরকের নিরাপত্তাবলয় কঠোর। বাংলাদেশের মানুষের জন্য আরেক রকম কেন ঈশ্বরের কাছে জানতে চাইলেন পরিদর্শক দেবতা। জবাবে ঈশ্বর বললেন, বাংলাদেশের মানুষের জন্য নরকে কোনো রক্ষীর প্রয়োজন হয় না। উত্তর শুনে প্রশ্নকারী দেবতা বিস্ময় নিয়ে তাকালেন। তারপর আবার বললেন, রহস্য আর ভালো লাগছে না। বাংলাদেশের মানুষ কি আসলে এত ভালো হয়ে গেছে? তারা কি ঈশ্বরের সব নির্দেশ-আদেশ অনেক বেশি পালন করেন যে তাদের জন্য রক্ষীর প্রয়োজন নেই। জবাবে ঈশ্বর বললেন, বাংলাদেশিদের জন্য রক্ষী লাগে না, কারণ তারা একজন আরেকজনের পেছনে লেগে থাকে। একজন কোনোভাবে বের হয়ে স্বর্গের দিকে রওনা হলে অন্যরা তাকে টেনে ধরে রাখে। কোনোদিকে যেতে দেয় না। পরস্পরকে আটকে রেখে তারা আনন্দিত হয়। পরস্পরের অমঙ্গলে তারা খুশি হয়। এই দেশে আপন পর বলে কিছু নেই। এরপর ঈশ্বর অন্য দেশের জন্য রক্ষী রাখার কারণ ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, বিশ্বের অন্য মানুষরা পরস্পরকে উন্নতি অগ্রগতিতে সহায়তা করেন। একজন কোনোভাবে নরক থেকে বের হওয়ার পথ আবিষ্কার করলে প্রথমে অন্যদের কীভাবে পার করবেন সেই ব্যবস্থা করেন।
বাংলাদেশের মানুষকে দোষারোপ করে শুধু শুধু লাভ নেই। হিংসুটে মানুষ কমবেশি সব দেশেই আছে। মানুষের সৃষ্টির পর থেকে হিংসা, বিদ্বেষ, যুদ্ধ চলে আসছে। দুনিয়ার প্রথম মানব পরিবারের সন্তান হাবিল-কাবিল একজন খুন করলেন আরেকজনকে। নিজেরা সহ্য করতে পারেননি নিজেদেরকে। ধর্ম থামাতে পারেনি মানুষের ভিতরের বিদ্বেষ। হিংসার আগুনে ইসলামের চার খলিফার তিনজনকে হত্যা করা হয়। কারবালার ভয়াবহ ইতিহাস পড়ে মানুষ এখনো ডুকরে কেঁদে ওঠে। তারপরও অন্যায় বন্ধ হয় না। অপরাধ কমে না। কাছের মানুষরাই বারবার আঘাত হেনেছিল আমাদের নবীজির ওপর। নবীজি নীরবে সব সহ্য করেছেন। অত্যাচার নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। মানুষের নিষ্ঠুরতা সব সময় ভয়াবহ ছিল। দুনিয়ার সব নবী-রসুল নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছিলেন। আলাপে আড্ডায় এক বন্ধু বললেন, ছোটবেলায় সাপ আর পাগলা কুকুরকে ভয় পেতাম। এখন শুধু ভয় করি মানুষকে। অন্য কোনো প্রাণীকে নয়। পাশের মানুষটি মুহূর্তে চোখ উল্টে ফেলে। লিপ্ত হয় ভয়াবহতায়। দুনিয়ার সব ধর্মের অনুসারীরা জানে মানুষ হত্যা অপরাধ। জেনেশুনে তারপরও খুন রাহাজানিতে জড়িয়ে পড়ে। পরস্পরকে হত্যা করে। ধ্বংস করে পৃথিবী। নিষ্ঠুরতার সময় কেউ ভাবে না ইহকাল, পরকালের পাপের কথা।
খারাপ সময়ে মানুষ প্রত্যাশা করে একজন ভালো বন্ধুর। চায় আপনজনের হাতের পরশ। শাহরুখ খানের একটি ছবি দেখেছিলাম। নাম বিল্লু বারবার। ছবির নায়ক শাহেরের ছোটবেলা কেটেছিল গ্রামে। তখন তার এক বন্ধু ছিল, নাম বিল্লু। নাপিতের সন্তান বিল্লুর সঙ্গে শাহেরের গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত নায়ককে ছোটবেলা বিল্লু সহায়তা করতেন। খাবার দিতেন। টাকার অভাবে চুল কাটতে পারতেন না শাহের। সেই চুল কেটে দিতেন বিল্লু। বড় হয়ে জীবিকার সন্ধানে শাহের গেলেন বোম্বে। অন্যদিকে ভিন্ন জাতের মেয়েকে বিয়ে করে গ্রামছাড়া বিল্লু। দুই বন্ধুর জীবনে বিরাট পরিবর্তন। কারও সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই। বিল্লুর নতুন সংসারে আসে দুটি সন্তান। নতুন ঠিকানায় বিল্লু চুলকাটার দোকান খোলেন। জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে দারিদ্র্য। আর বোম্বের জীবনের পালাবদলে শাহের বিখ্যাত নায়ক হয়ে ওঠেন। এক কথায় সুপারস্টার। বিল্লু লোকমুখে সেইসব গল্প শোনেন। জীবন-জীবিকার টানে শাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে ওঠে না। হঠাৎ বিল্লুর নতুন ঠিকানায় শুটিং করতে আসেন ছোটবেলার সেই বন্ধু নায়ক শাহের। কথায় কথায় বিল্লুর স্ত্রী গ্রামের মানুষকে বলে দেন তার স্বামী নায়ক শাহেরের ছোটবেলার বন্ধু। মুহূর্তে এই খবর রটে যায় পুরো গ্রামে। বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন বিল্লু। সবাই বিল্লুকে ধরেন নায়কের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। বিল্লু বোঝানোর চেষ্টা করেন তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ছোটবেলায়। এখন কোনো যোগাযোগ নেই। তাতেও পাড়ার মানুষের উৎসাহ কমে না। তারা বিল্লুকে যন্ত্রণা দিতেই থাকে। অতিউৎসাহী একজন বিল্লুর ভাঙা চুলকাটার দোকান মেরামত করে দেন। আরেকজন দেন ফার্নিচার। হুলুস্থুল কাণ্ড! সবার অনুরোধ নায়কের সঙ্গে শুধু একবার দেখা করিয়ে দিতে।
বিল্লুকে নিয়ে সবাই গেলেন শুটিং স্পটে। চেষ্টা করলেন নায়কের সঙ্গে সাক্ষাতের। কিন্তু কোনোভাবেই নায়কের সাক্ষাৎকার পাচ্ছিলেন না বিল্লু। নায়ক দেখার হুড়োহুড়িতে পুলিশের সঙ্গে উৎসাহীদের লড়াই হয়ে যায়। পুলিশে আটক হন উৎসাহীরা। তারা পুলিশকে বিল্লুর নাম বলেন। আটক হন বিল্লু। কোনোভাবে ক্ষমা চেয়ে মাফ পান। গ্রামের লোক ক্ষুব্ধ হন বিল্লুর প্রতি। তাদের ধারণা হয় বিল্লু মিথ্যা বলছেন। তারা বিল্লুকে নাজেহাল করেন। বাড়িতে স্ত্রী, সন্তানদের কাছে বিল্লুর শান্তি নেই।
জটিল পরিস্থিতিতে স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার আমন্ত্রণে নায়ক যোগ দেন শিক্ষার্থীদের অনুষ্ঠানে। বিল্লুর সন্তানরাও পড়ে এখানে। তারা ছিল নায়কের সঙ্গে দেখা করাতে না পারায় বাবার ওপর অখুশি। স্ত্রীর অনুরোধে বিল্লু অনুষ্ঠানে আসেন। দাঁড়ান সবার পেছনে। শিক্ষার্থীদের সামনে নায়ক শাহের বক্তব্য রাখতে থাকেন। তুলে ধরেন তার ছোটবেলার কষ্টের কথা। উঠে আসে দারিদ্র্য আর বিল্লুর কথা। নায়ক নিজের মুখে সব বলতে থাকেন। ছোটবেলায় অভাবের সংসারে টাকার অভাবে নায়কের চুলকাটা হতো না। নিজের বাবার দোকানে নিয়ে চুল কেটে দিত বিল্লু। টিফিনের সময় নিজের খাবার শেয়ার করত। বই-খাতা কেনার পয়সা দিত। একদিন ভাগ্যের সন্ধানে বোম্বে যান শাহের। নায়ক হয়ে বন্ধু বিল্লুকে খুঁজতে গ্রামে আসেন। এসে জানেন বিল্লু বিয়ে করে গ্রামছাড়া। অশ্রুসজল নয়নে বিল্লুর কথা বলতে বলতে নায়ক বলেন, আজ আমার সব আছে, নেই শুধু বিল্লুর মতো একজন বন্ধু।
একজন ভালো বন্ধুর অভাব নিয়ে মৃত্যুর আগে নায়িকা কবরী আক্ষেপ করেছিলেন। বলেছিলেন নিজের ভিতরের বেদনার কথা। বাস্তবতা অনেক কঠিন। যিনি যত বেশি বেশি সফল তিনি হয়তো ততটাই একা, নিঃসঙ্গ।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন