শিরোনাম
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

ফিরে দেখা একরত্তি হারানো শৈশব

অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরী

ফিরে দেখা একরত্তি হারানো শৈশব

অদেখা অচেনা ভুবনে ভবিষ্যতের স্বপ্ন সোপানে অলক্ষ্যেই অদৃশ্য মঙ্গল সুতার রথে যারা খুব যত্নে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সেই প্রাথমিকের হীরন্ময় গণ্ডিতে শিশুবেলায়, তাদের একজন আমাদের অতি আপন প্রিয়জন শ্রদ্ধাভাজন দিদিমণি, আভা দিদিমণি। সময়ের হিসাবে প্রায় পাঁচ দশক পরে তাকে খুঁজে পেলাম। ইতিপূর্বে আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম প্রাথমিকের হরিবলা দিদিমণি আর মাধ্যমিকের লীলা দিদিমণিকে। এ দুই পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর কেউ আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। বিধির বিধান বড় নিষ্ঠুর আর নিয়মানুবর্তীও বটে।

আভা দিদিমণির সঙ্গে প্রায় বছর দশেক আগে দেখা হয়েছিল জামালপুরে, ট্রেনের যাত্রাপথে, সঙ্গে আমার হাজবেন্ডও ছিলেন। অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করার পরে, চিনতে পেরে তাকে যখন পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছিলাম তিনি এতটাই আবেগাপ্লুত হয়েছিলেন যে, হাত থেকে চায়ের কাপ নিচে পড়ে গিয়েছিল। দিদিমণির হাজবেন্ড সঙ্গে ছিলেন কি না মনে করতে না পারলেও দিদিমণির একমাত্র ছেলে সজীব কুমার ভৌমিক সঙ্গে ছিল। সজীব তখন পড়ালেখা করছে। বর্তমানে সে ৩৪তম বিসিএস-এ নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে গণপূর্ত বিভাগে (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে) কর্মরত। প্রিয়াংকা নামে মিষ্টি একটা বউমা আর একমাত্র নাতি সৃঞ্জয়ের দুষ্টমির সঙ্গে দিদিমণির সুখের সংসার দেখে আমরাও আনন্দিত হয়েছি। দাদাভাই পরপারে। একমাত্র কন্যা সে-ও কেমিস্ট। বয়সটাকে একটা সংখ্যা ধরে নিলে তা প্রায় আশির কোটায় গড়াবে। কিন্তু মায়ের মতো দিদিমণিকে দেখেশুনে, গল্পে আড্ডায় আর ক্লান্তিহীন হাঁটাচলায় আমরা শুধু খুশিই হইনি আনন্দে আপ্লুত হয়েছি, নিজেদের দিকে তাকিয়ে আবারও মনে হলো রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে। বন্ধু মুর্শিদার আগ্রহ আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমরা দিদিমণির সন্ধান পেয়েছি বলে বন্ধু তোমায় আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

নানামাত্রিক ব্যস্ততা তো রয়েছেই, তাছাড়া বিগত প্রায় মাসখানেক ধরে তীব্র দাবদাহের কারণে দিদিমণির বাসায় যাওয়া হয়ে উঠছিল না। ওদিকে বন্ধু কোহিনূর যাবে আমেরিকায় কন্যা দেখতে, সময় হাতে নেই; সব মিলিয়ে ঠিক হলো ২৭ এপ্রিল, শনিবার। হঠাৎ বন্ধু মুর্শিদা ফোন করে জানাল দিদিমণির বাসা পিলখানার আশপাশে, ঠিকানা পাঠালাম; তুমি দেখ। আমি তো ঠিকানা দেখে অবাক! হায় আল্লাহ! পিডব্লিউডি কোয়ার্টার তো আমার বাসা থেকে হাঁটা রাস্তা। মন আমার খুশিতে নেচে উঠল। ফোন করে বন্ধুদের আবারও ভালোলাগা প্রকাশ করলাম। তীব্র একটা উত্তেজনা অনুভব করছিলাম আমরা নিজেদের মাঝে। এত এত বছর পর দিদিমণি কেমন আছেন, দেখতে কেমন হয়েছেন, চিনতে পারবেন তো! কতটা ভুলোমনের হয়েছেন তিনি ইত্যাদি ইত্যাদি। কোহিনূর আর মুর্শিদা (ব্যাংকার বন্ধু) যথাসময়ে মেট্রোরেলে উড়ে এসে বাসার কাছেই আমার পূর্বনির্দেশিত জায়গায় অপেক্ষা করছিল। অবশেষে তিনজন একসঙ্গে যথারীতি সেই বাসার সামনে গিয়ে বেল বাজাতেই দেখি আমাদের জন্য অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতে থাকা দিদিমণি নিজেই খুলছেন সদর দরজা। আমরাও একে একে আবেগাপ্লুত হয়ে সালাম করেছি, দিদিমণির বুকে স্নেহের আশ্রয় খুঁজেছি। আশ্বস্ত হয়েছি দিদিমণিকে দেখে। সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় তিনি সুস্থ আছেন। আমাদের সঙ্গে তার শিক্ষকতা জীবনের নানা বিষয় নিয়ে গল্প করছেন, একমাত্র নাতি সৃঞ্জয়ের সঙ্গে খেলা করছেন। বললেন, আমি ভাবতে পারি নাই তোমরা আমাকে মনে রাখবে। তাঁর কৃতজ্ঞতাভরা কণ্ঠস্বর আর চকচকে দৃষ্টির গভীর প্রশান্তিই বলে দিচ্ছিল কতটা অভিভূত তিনি। নিঃসন্দেহে, দীর্ঘকালের পুরনো ছাত্রীদের কাছ থেকে পাওয়া এ বিরল সম্মাননা সন্তানের কাছেও তাঁকে মর্যাদাবান করে তুলেছে। মুখ দিয়ে উচ্চারণের প্রয়োজন নেই; তাঁর চলনে বলনে আপ্যায়নে আমরা যে স্বতঃস্ফূর্ততা দেখেছি, প্রগাঢ় স্নেহ দেখেছি তা সত্যিই স্বর্গীয়। এক পর্যায়ে হরিবলা দিদিকে ফোনে ধরিয়ে দিলে তিনি কেঁদেই ফেললেন। বললেন, আজকালকার বাচ্চারা কি এমনটা করে! আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না ওরা (আমরা তিন বন্ধু) কী করেছে আমার জন্য। হরিবলা দিদির সঙ্গেও ওভার ফোনে কথা হলো আমাদের। জামালপুর গেলে তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। দোয়া করলেন প্রাণভরে। এটুকুই আমাদের পরম প্রাপ্তি ছিল। ভাবতে ভালো লাগল, সিংহজানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ইঊ প্যাটার্নের বিশাল চৌচালা ভাঙাচোরা, জং ধরা, ক্ষয়ে যাওয়া টিনের ঘরটা আর তার মাঝখানে বিশাল আম গাছের বিস্তীর্ণ আঙিনায় শৈশবের হারিয়ে যাওয়া দাপাদাপির পদধ্বনির মাঝে অন্তত একজন আভাদির সঙ্গে আমরা অবস্থান করছি এই মুহূর্তে। কী অভাবনীয় সেই অনুভব। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠার মতো শিহরণ। তখনকার হেড মিসট্রেস পরম মমতাময়ী হালিদা আপা, বেলা আপা সবার কথা একেবারে মেমোরির ক্যাশ কাউন্টারে ফিরে আসতে লাগল। সবই হলো শুধু দিদিমণি পড়া মুখস্থ ধরলেন না। ভাবলাম, বড় হয়েছি বটে! দিদিমণির ছেলে সজীব বউমাসহ বাসায়ই ছিল। যতক্ষণ আমরা সে বাসায় অবস্থান করেছি ঠিক ততক্ষণই ওরা আমাদের সঙ্গ দিয়েছে, সাহচর্য দিয়েছে, গল্প করেছে। আমার সঙ্গে ট্রেনে দেখা হওয়ার সময়টা সজীব স্মরণে আনতে পেরে বলেছে, আন্টি, আপনাকে আমার মনে আছে। তিন বন্ধু খুনসুটি করে করে ছবি নিয়েছি বেশ কয়েকটি। হাসিখুশি বউমণিকে নিয়ে দিদিমণির পজিটিভিটি ছিল লক্ষ্য করার মতো; অবশ্য ওর সারল্যও আমাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। কীভাবে যেন গল্পে গল্পে সময় গড়িয়ে চলল। বেশ কয়েক ঘণ্টা। বন্ধু মুর্শিদা সম্মাননা স্মারকটি বেশ সুন্দর আর আকর্ষণীয় করে তৈরি করেছিল। দিদিমণিকে ফুলেল শুভেচ্ছা দিয়ে কেক কেটে সাক্ষাতের সময়টাকে আমরা বন্ধুরা পূর্ণতা দিয়েছি, স্মরণে রেখেছি। পুত্র-পুত্রবধূর নিবিড় যত্ন-আত্তি সত্ত্বেও দিদিমণি যেন স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। আসলে কী দিয়ে তিনি আমাদের আদর করবেন, আপ্যায়ন করবেন, কোথায় রাখবেন তার সুস্পষ্ট কোনো চিত্রকল্প তিনি তৈরি করতে পারছিলেন না বিধায় চোখেমুখে তাঁর একটা অতৃপ্তি আর অস্বস্তি ঝরে পড়ছিল অনবরত। অথচ আমাদের বউমণি আর সজীবের আতিথেয়তা-আপ্যায়ন ছিল ভরপুর, ভালোবাসার মায়ায় জড়ানো।

লেখক : অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

সর্বশেষ খবর