বুধবার, ২২ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

শিশুদের শিক্ষাজীবন শুরু হোক মাতৃভাষায়

অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান

শিশুদের শিক্ষাজীবন শুরু হোক মাতৃভাষায়

মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার স্থান মানুষের হৃদয়ে। মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক আরও সুদৃঢ়। এ দেশের মানুষ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। ভাষার ভিত্তিতেই এ দেশের সৃষ্টি। আগামী প্রজন্মের মধ্যে দেশাত্মবোধের চেতনা বৃদ্ধির অন্যতম উপায় শিক্ষায় মাতৃভাষার ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ। বর্তমানে বাংলাদেশের শিশুদের শিক্ষাজীবন শুরু থেকে অর্থাৎ শিশু শ্রেণি বা প্লে গ্রুপ থেকে বাংলা বা ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়ার সুযোগ আছে। অধিকাংশ শিশু বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া করে, সামর্থ্যবান অভিভাবকদের অনেকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে তাদের শিশুদের ভর্তি করে থাকেন। তাছাড়া আজকাল মধ্যবিত্তের অনেকে ইংরেজি মাধ্যমের প্রতি ঝুঁকছেন। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোকে অনেকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করেন। শিশুরা প্রথমত, পারিবারিক পরিবেশ থেকে মাতৃভাষা শিখতে শুরু করে। চার-পাঁচ বছর বয়সে স্কুল থেকে শিখতে শুরু করে। এ বয়সে বাড়িতে মাতৃভাষা এবং স্কুলে ভিন্ন ভাষায় কথোপকথন শিশুদের ভাষা বিকাশে কিছুটা বিঘ্ন সৃষ্টি করে, অনেক শিশু বিভ্রান্তিতে ভোগে। তাই মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিশুদের শিক্ষাজীবন আরম্ভ করা উত্তম। তবে শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা হলেও ভাষা হিসেবে মাতৃভাষা ও অন্য কমপক্ষে একটি ভাষা শেখানো প্রয়োজন। যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবার জন্য শিক্ষার মাধ্যম বাংলা, ভাষা হিসেবে বাংলা ও ইংরেজি। শিক্ষার মাধ্যম ও শিক্ষার বিষয় এক কথা নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাংলা ও ইংরেজি এই দুটি বিষয়কেই মৌলিক শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া অত্যাবশ্যক।

বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নাগরিক যাতে চিন্তা করে, ভাবে, মনে মনে হিসাব-নিকাশ করে, এমনকি স্বপ্ন দেখে বাংলায় তাই প্রারম্ভিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম একমাত্র বাংলা রাখা প্রয়োজন। আজকের বিশে^র আমরা একা থাকতে পারি না, তাই বাংলার সঙ্গে গুরুত্বসহকারে মৌলিক শিক্ষা স্তরেই একটি আন্তর্জাতিক ভাষা শেখানো প্রয়োজন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হলো ইংরেজি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মৌলিক শিক্ষায় বাংলা ও ইংরেজি এ দুটি ভাষার চারটি দক্ষতা শোনা, বলা, পড়া ও লেখায় পারদর্শী হওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে বাংলাদেশে বাংলা ও ইংরেজি দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক, তা চালু থাকা প্রয়োজন। ১২-১৩ বছর শেখার পরও অনেকে যথোপযুক্ত দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হয় না, তার জন্য প্রয়োজন যোগ্য শিক্ষক দ্বারা সঠিক পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা।

শিক্ষার কাজ বৈষম্য সৃষ্টি করা নয় বরং হ্রাস করা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদানের মাধ্যমে চিন্তা, চেতনায় ও দক্ষতায় বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। অধিকাংশ ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিতরা নিজেদের আলাদাভাবে, অন্যদের সঙ্গে চলাফেরা করতে দ্বিধাবোধ করে। অনেকের ধারণা, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে ভালো কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল। অনুসন্ধানে দেখা যাবে, ভালো বিশ^বিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেলে উচ্চশিক্ষায় আনুপাতিকহারে ইংরেজি মাধ্যম থেকে আগত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। আমরা কি শুধু ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদেরই ইংরেজিতে পারদর্শী করতে চাই? সব শিক্ষার্থীকেই পারদর্শী করা প্রয়োজন। তাই সব শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে ইংরেজিতে দক্ষ করতে হবে।

অভিজাত শ্রেণি তৈরি করা শিক্ষার লক্ষ্য হতে পারে না। বাংলাদেশ নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ মনে করেন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ার সুযোগ না দিলে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা হবে। কথাটি সঠিক নয়। বিশে^র বহু দেশ তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত করে। যেমন চীন, রাশিয়া, জার্মানি, জাপান। ফিনল্যান্ডসহ অনেক দেশে উচ্চশিক্ষায় বিধিনিষেধ আছে। তাই বলে কি নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে? ইংরেজি মাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা হলে কওমি মাদ্রাসায় পড়াতে চাইলে বাধা থাকবে কেন?

এ কথা বলা হচ্ছে না যে, বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষালাভের সুযোগ থাকবে না বা ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকবে না। অবশ্যই থাকবে। মৌলিক শিক্ষা প্রথম স্তর অর্থাৎ শিশু শ্রেণি বা কেজি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হবে বাংলা। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ইংরেজি বা আরবি মাধ্যমেও শিক্ষা কার্যক্রম চলবে। তবে শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা মাধ্যমে শিক্ষালাভের সুযোগ থাকবে। বর্তমানে চালু ইংরেজি মাধ্যম স্কুলসমূহ প্রারম্ভিক শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা মাধ্যম পাঠদান করবে, অন্যতম আবশ্যিক বিষয় হিসেবে ইংরেজি পড়াবে।

বাংলাদেশে ভাষানীতি থাকা অত্যাবশ্যক। সারা দেশের জন্য প্রযোজ্য ভাষানীতি হতে পারে : বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ সর্বক্ষেত্রে সর্বপ্রকার যোগাযোগ বাংলায় করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, লিখিত ও মৌখিক যোগাযোগ বাংলায় হবে। সাইনবোর্ড, যানবাহন, বিলবোড ইত্যাদিতে বড় আকারে বাংলায় ও নিচে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারে ইংরেজি বা অন্য ভাষায় ব্যবহার করা যাবে। (এ নীতি প্রয়োগের জন্য আইন প্রয়োজন)।

শিক্ষাক্ষেত্রে ভাষানীতি হতে পারে : বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা মাধ্যমে শিক্ষালাভের সুযোগ থাকবে। শিশুদের শিক্ষাজীবন শুরু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম বাংলা। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ইংরেজি বা আরবি মাধ্যমে শিক্ষা লাভের সুযোগ থাকবে। প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ও ইংরেজি বিষয় হিসেবে বাধ্যতামূলক থাকবে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অন্যতম হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। অর্থ ধর্মহীনতা নয়, নাস্তিকতা নয়। বাংলাদেশের বসবাসরত নাগরিকের ধর্মকর্ম করার পূর্ণ অধিকার আছে। স্ব স্ব ধর্ম সম্পর্কে সঠিক শিক্ষালাভের অধিকার আছে। ধর্ম শিক্ষার জন্য সবাইকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পড়তে হবে-তা নয়। মৌলিক স্তরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্ব স্ব ধর্ম শিক্ষার সুযোগ থাকবে। ধর্মের মৌলিক বিষয়াদি যেমন বিশ্বাস, আকিদা, রীতিনীতি, উপাসনা, ধর্মীয় নীতিবোধ ইত্যাদি প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ নাগরিকের জানা ও পালন করা আবশ্যক। ধর্মের এসব মৌলিক বিষয়াদি মৌলিক শিক্ষা স্তরে শিক্ষার সুযোগ থাকতে হবে। ধর্মীয় বিধিবিধান অনুসারে জীবনযাপনের জন্য যে শিক্ষা গ্রহণ করা আবশ্যক তা মৌলিক শিক্ষাস্তরে অর্জন করার সুযোগ থাকতে হবে। সাধারণ শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা, এনজিও পরিচালিত শিক্ষা সব ধরনের শিক্ষায় ধর্ম শিক্ষার সুযোগ থাকবে। মৌলিক শিক্ষা হবে একমুখী। মৌলিক স্তরে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই শিক্ষাক্রম অনুসারে একই শিখন সামগ্রী অনুসারে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এখানে উল্লেখ্য, মধ্যপ্রাচ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদরাসা বলতে যা বুঝায় তা হলো আমাদের দেশের স্কুল বা বিদ্যালয়। ওখানে ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান ও ধর্ম এসবই শিক্ষা দেওয়া হয়। ওখানকার মাদরাসার সঙ্গে আমাদের দেশের মাদরাসা বিশেষ করে কওমি মাদরাসার ধারণার পার্থক্য আছে। মোট কথা বাংলাদেশে আপাতত মৌলিক শিক্ষার মেয়াদ হবে আট বছর। মৌলিক শিক্ষা হবে একমুখী। সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই একমুখী মৌলিক শিক্ষা প্রদান করা হবে। মৌলিক শিক্ষার অন্যতম বাধ্যতামূলক বিষয় হবে ধর্ম শিক্ষা, ধর্ম শিক্ষায় নৈতিক শিক্ষার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব থাকবে। অন্যান্য বিষয়েও নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব থাকবে। দেশে ইবতেদায়ি মাদরাসা ও অন্যান্য মাদরাসায় একমুখী মৌলিক শিক্ষা প্রদান করা হবে, পরবর্তী পর্যায়সমূহে ইসলাম বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা দেওয়া হবে। যেমন মাদরাসায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একমুখী মৌলিক শিক্ষা-পরবর্তী আলিম, ফাজেল ও কামেল পর্যায়ে উচ্চতর ইসলাম শিক্ষা দেওয়া হবে।

১৩ মে ২০২৪ এই কলামে শিক্ষানীতি নিয়ে ‘শিক্ষানীতি : বাস্তবতা ও কঠিন ভাবনা’ শীর্ষক লেখার ধারাবাহিকতায় আজকের লেখাটি প্রকাশিত হলো। শিক্ষার অন্যান্য মৌলিক বিষয়ে পরবর্তীতে আলোকপাত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

লেখক : প্রাক্তন পরিচালক, আইইআর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর