বুধবার, ২২ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

পাছে লোকে কিছু বলে

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

পাছে লোকে কিছু বলে

স্বনামধন্য আইনবিদ, আইন সংস্কারক, বিচারক, বাগ্মী, লেখক, অনুবাদক মরহুম গাজী শামসুর রহমান (১৯২১-১৯৯৮) টেলিভিশনে আইন-কানুন ও আইনের ভাষ্য বা ব্যাখ্যা-বয়ান করার সময় প্রায়শ দবির ও সাবেত নামীয় দুই ব্যক্তির উদাহরণ দিতেন। চোখ বুজে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় আইন কানুনের যে ব্যাখ্যা তিনি দিতেন, সেখানে দবির ও সাবেতের প্রসঙ্গ থাকতই। যে কোনো মামলায়, বিবাদ-বিসংবাদে বাদী ও বিবাদী, যে কোনো ঘটনায় পক্ষ আর বিপক্ষের সাক্ষী কিংবা প্রতিনিধি হিসেবে দবির ও সাবেতকে তিনি এমনভাবে উপস্থাপন করতেন যেন দবির সৎ, সহজ-সরলমনা ও যুক্তিবাদী এবং তার বিপরীতে সাবেত একটু অধমর্ণ প্রকৃতির, কিছুটা বোকা কিছুটা চালাকির মিশেল আর আইনের দৃষ্টিতে অনেকটা বিবাদী কিংবা আসামি প্রকৃতির। এ দুই ব্যক্তির বোধ-বুদ্ধি আর আচরণ দিয়ে যে কোনো ফৌজদারি কিংবা দেওয়ানি মামলা-মোকদ্দমা বাগবিতণ্ডা ও ফ্যাকড়া ফ্যাসাদে দবির ও সাবেত পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতেন। আদালতের কাছে দুজনই সমান বিচার বিবেচনার দাবিদার। দবিরের পক্ষে তার উকিল এবং সাবেতের পক্ষে তার উকিল যেভাবে কাগজপত্র দলিল দস্তাবেজ হাজির করতে সক্ষম হবেন সেটি নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করে রায় দেবেন আদালত। আদালতের রায়কে সবাই শিরোধার্য মনে করবেন, এক একটি রায় যেন এক একটি মাইলস্টোন ওই বিষয়ে এবং আদালতের ন্যায়দণ্ড সকল পর্যায়ে সব দেশ ও সমাজে অনুসরণীয় বলে প্রতিভাত, পরিপালিত হয়ে থাকে। হাকিম নড়বে তবু হুকুম নড়বে না। এ কারণেই আদালতের আদেশ বা সিদ্ধান্তে কেউ ন্যূনতম সংশয়, সন্দেহ, বিরূপ সমালোচনা প্রকাশ কিংবা অমান্য করলে তা আদালত অবমাননা বলে ধরা হয়ে থাকে। সব শাস্ত্রে আদালতের রায়কে বিনাবাক্য ব্যয়ে শিরোধার্য বিবেচনার পরামর্শ রয়েছে। সুতরাং আদালতের রায়ের মধ্যে কোনো সংশয় সন্দেহ, পক্ষপাতিত্ব থাকা বা জাগার সুযোগ যাতে না থাকে সেটিরও নিশ্চয়ন থাকে। নিম্ন আদালতের রায়ে কেউ সংক্ষুব্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন। রিভিউ পিটিশন দাখিল করতে পারবেন। অর্থাৎ তার প্রতি কোনো অবিচার করা হয়ে থাকলে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার তার আছে বা থাকবে। সুতরাং আদালতের রায় ন্যায় বিচারের স্বার্থে, এর মর্যাদা এবং বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও আস্থা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে নিরপেক্ষ নিরাপস মনোভাব পোষণ করে থাকেন। আর সে কারণেই আদালত অবমাননার শাস্তি ও জরিমানা থেকে মেজর পানিশমেন্ট হতে পারে। রাস্তার ট্রাফিক পুলিশের বেয়াদবি কর্মকাণ্ডের জন্য আদালত আবমাননার এক কেসে পুলিশের খোদ বড় কর্তা চাকরি হারিয়েছিলেন।

পাল, মৌর্য, গুপ্ত, হাবশি প্রায় সব যুগে ন্যায় বিচারকে সর্বাগ্রে সম্মান, অবস্থান ও অধিষ্ঠানের বিষয় মনে করা হতো। মুঘল আমলেও দেওয়ানি মামলা-মোকদ্দমার আধিক্য থাকত। ফৌজদারি ততটা নয়, কেননা সমাজে নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গ, খুনখারাবি স্থানীয়ভাবে মীমাংসার আওতাকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। এ দেশীয় বিচার প্রক্রিয়ায় সার্বজনীনতা ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের আমলে। সে সময় দবির ও সাবেতের মাঝখানে কায়েমি স্বার্থবাদী আরেক পক্ষ (সরকার বা নির্বাহী বিভাগ) দাঁড়িয়ে যায় যাদের ব্যবহার করে সাতসাগর তেরো নদীর ওপার থেকে এদেশে আসা ঔপনিবেশিক সরকার এখানে এসে গেঁড়ে বসতে চেয়েছিল- দীর্ঘদিন এখানে থাকতে চেয়েছিল বলেই। তারা বিচার বিভাগকে নিজেদের পক্ষে রাখতে নিজেদের লোককে নিজেরা বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিত। দবির, সাবেতকে বশে রাখার ক্ষমতা নিজেদের কাছে রাখার পক্ষপাতি ছিল বলেই তারা বিচার বিভাগে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে ন্যায় বিচার সুবিচার সেখানে বিভিন্ন পোশাক-আশাকে ব্যবহার করা হতো। ইতিহাসবিদ তপন রায় চৌধুরীর (১৯২৬-২০১৪) বাঙালনামা (২০১৪) থেকে আমরা জানতে পারি বরিশাল শহরে তাঁর পিতা কংগ্রেস কর্মীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারিতে ইংরেজ পুলিশ অফিসারের ভূমিকাকে সমালোচনা বা দোষারোপ করে একটি রায় দিয়েছিলেন একজন সাহসী বাঙালি বিচারক। মামলাটি রাজনৈতিক মামলা, কেননা ওই কংগ্রেস কর্মী (ব্রিটিশ) সরকারের বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলনে ছিলেন। তাকে গ্রেফতার করে জেলে ভরতে হবে। এখন সরকারেরই পুলিশ বাহিনী তাকে ‘বিশেষ উপায়ে’ না দেখার ভান বা অভিনয় করে। এদেশীয় বাঙালি বিচারক তার রায়ে বললেন, পুলিশ পলাতক আসামি কোথায় আছে তা জানা সত্ত্বেও তার বাড়িতে নোটিস জারি করে বরং আসামির প্রতি বিশেষ ব্যবহার আরোপ করেছে। বিচারক ব্রিটিশ রাজার বিশ্বস্ত কর্মচারীর দায়িত্ব পালনে পক্ষপাতিত্ব বা ব্যর্থতার দায় আনলেন। ব্রিটিশ সরকার ওই বিচারকের ওপর ক্ষেপে গেলেন। কেননা ‘ধোঁয়া তুলসী পাতা’র মতো তার অতি বিশ্বস্ত কর্মচারীকে কেন এভাবে হেয় করা হয়েছে। তাঁরা সেই বিচারককে ময়মনসিংহের মতো দুর্গম এলাকায় বদলি করলেন। একবার এক দেশে সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে সেদেশের সরকারপ্রধান নিজে নির্বাচনি আচরণ বিধি ভঙ্গ করেছেন মর্মে মামলা করেন তার বিপক্ষ প্রার্থী। অভিযোগ সরকারপ্রধান সরকারি খরচে সরকারি কর্মচারীদের আতিথেয়তা ও সেবা গ্রহণ করেছেন। তার সচিবালয়ে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তাকে (অবসর গ্রহণের আগেই) তার নির্বাচনি এজেন্ট বানানো হয়েছে। অভিযোগ, নির্বাচিত হওয়ার জন্য তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। নির্বাচনে তার প্রতিপক্ষ তার বিরুদ্ধে নৈতিকতা ও নির্বাচনি বিধিমালা ভঙ্গের অভিযোগ এনে মামলা ঠুঁকে দিলেন। যার বিরুদ্ধে নির্বাচনি মামলা, তিনি যেহেতু ক্ষমতাসীন সেই মামলা নিষ্পত্তিতে পাঁচ বছর সময় লেগে গেল। অর্থাৎ তিনি ক্ষমতায় থাকতেই এই বিচার বিলম্বিত হতে হতে ক্ষমতার সময় পার করার পর মাননীয় আদালত তাকে শাস্তির বিধান করে রায় দিলেন। তখন তো তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে কয়েক বছরের জন্য তার ভবিষ্যৎ রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়।

আদালতে উপস্থাপিত কাগজপত্র দেখে তার ভিত্তিতে বিচারক রায় দেবেন। কিন্তু সেই কাগজপত্র যদি আসামির বিপক্ষে অভিযোগকারী নিজে তৈরি করে সরবরাহ করেন, আসামিকে জেলে রেখে অভিযোগনামা দাখিলে বিলম্ব করেন কিংবা বিচারক অসুস্থতার জন্য শুনানিতে বিলম্ব হতে পারে, তাহলে আসামির জেলহাজত বাস বাড়তেই থাকবে। আদালত তো সবার, তিনি দবিরেরও সাবেতেরও। জাস্টিস ডিলেইড জাস্টিস ডিনায়েড বলে একটা মশহুর প্রবাদ আছে। আদালত কাগজপত্র না পেলে মামলা নিষ্পত্তি করতে পারবেন না এই যুক্তিসঙ্গত যুক্তিতে, আসামির দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য যাই বলি মামলার তারিখ পিছিয়ে আসামির শাস্তিভোগ বাড়তেই পারে। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদা বা না কাঁদার ব্যাপারে আদালতের করণীয় নিয়ে বিষয়টি সচেতন বিবেচনায় রাখেন বিচার বিভাগ। আদালতে মৌলিক অধিকার বজায় রাখার প্রার্থনা চেয়ে রিট করা হয়। একটি ঔপনিবেশিক পরিবেশে এমনটি হওয়া স্বাভাবিক যে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টিকারী অসাধারণ বাদীরও পক্ষে মৌলিক অধিকার আইনের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়া বোধগম্য কারণে যতটা সহজপ্রাপ্য হয় সাধারণ মানুষের সেই মৌলিক অধিকার লাভ স্বয়ংক্রিয় হয় না, হয় অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর। ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের সময় দবির ও সাবেতেরা এহেন পরিস্থিতিতে কঠিন আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতার ও মুক্তির সংগ্রামে বিজয়লাভ করে এবং সংবিধানে নিম্নবর্ণিত বিধান সন্নিবেশ ঘটায়। ১৯। সুযোগের সমতা-(১) সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন। (২) মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। এবং ২০। অধিকার ও কর্তব্যরূপে কর্ম (১) ...(২) রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না। এখন যদি দেখা যায় সেই স্বাধীন ও মুক্ত দেশে ঔপনিবেশিক আমলের নিবর্তনমূলক মনোভঙ্গি, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া প্রয়োগে ব্যত্যয় ঘটছে; তখন পাছে লোকে কিছু বলে এই ভয় ও বিবেচনায় বিস্ময়ের সঙ্গে, বেদনার সঙ্গে, দেশ ও সমাজ কালজয়ী কণ্ঠশিল্পী মান্না দের সঙ্গে গলা মেলাতেই পারেন- ‘যে ক্ষতি আমি নিয়েছিলাম মেনে, সে ক্ষতিপূরণ করতে কেন এলে, কি খেলা তুমি নতুন করে যাবে আবার খেলে...’।

লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর