বুধবার, ২২ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

বসন্তসুখে দুঃখবোধ কেন?

অধ্যাপক জীবেন রায়

বসন্তসুখে দুঃখবোধ কেন?

বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ে বাবা-মায়ের সপ্তম এবং সর্বশেষ সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছি আমি। গ্রামীণ সামাজিক অবস্থায় আমাদের মধ্যবিত্ত বলা যেত তখন। খাওয়া-পরার অভাব ছিল না, তবে শৌখিনতা ছিল না বলেই চলে। একটি কলের গান কিংবা রেডিও এসব ছিল না। জমিদারি ব্যবস্থা তখন উঠে গেছে। বাবাও তার ছোটখাটো চাকরি থেকে অবসর প্রাপ্ত। কাজেই রোজগার ছিল না বলেই চলে। প্রতিটি পয়সা হিসাব করে সংসার চালাত আমাদের বুড়ো বাবা। অন্যান্য বড় ভাইবোন তখন কলকাতা, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়িতে বসবাস করত। ব্রিটিশ আমলের কথা তো।

অবশ্য আমার জন্ম পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু কখনো দুঃখবোধ ছিল না। বলা চলে বসন্তসুখেই বড় হয়ে উঠেছি। অষ্টম শ্রেণিতে স্কলারশিপের বদৌলতে গ্রামের স্কুল ছেড়ে দিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরে পৌঁছে গেলাম। দুই বছর পড়াশোনার পর মনে হলো বসন্তে সুখ স্থায়ী হয়ে গেল। এক লাফে ঢাকা শহরে। আহা রে, ১৯৬৯ সালে ঢাকা শহরের লোকসংখা ছিল মাত্র কয়েক লাখ। আর এখন প্রায় আড়াই কোটি। প্রথম দিকে তাঁতীবাজার থেকে বাসে নটর ডেম কলেজে পড়তে যেতাম। মধুমিতা সিনেমা হলে নেমে সিনেমা দেখতাম। পরের বছর ছিলাম সদরঘাটে ব্যাপ্টিস্ট মিশন হোস্টেলে থেকে বাসে করেই যেতাম কলেজে। তারপরও আমার জন্য আনন্দধারা বহিত ভুবনে।

পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা, হাওয়াই, ঢাকা, সাভার, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র। কত বসন্তই না পেরিয়ে এসেছি, বলা চলে সেই বসন্তসুখেই। তাহলে দুঃখবোধ কোথায় এবং কেন?

দুঃখে আছি আর দুঃখবোধ এক কথা নয়। আমার এখনো মনে আছে, ১৯৭৯ সালে কানাডা যাওয়ার প্রাক্কালে তপনদাদের বাসা থেকে তখনকার সময়ের কত গান ক্যাসেটে রেকর্ড করে নিয়ে গিয়েছিলাম। মূলত হেমন্ত, সতীনাথ, জগন্ময় মিত্র, সন্ধ্যা।

অবাক হলেও সত্যি, আমি এত গান ভালোবাসি কিন্তু একটি গানেরও একটা লাইনও সুরে গাইতে পারি না। অথচ আমার হাত অর্টিস্টিক। হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম, আমি আঁকতে পারি। পেন্সিল পোর্টেট করতাম। এমনকি কানাডা থাকাকালে কিছু ডলারও কামিয়েছি। এরপর রং নিয়েও অনেক কিছু এঁকেছি। তারপর আসি লেখালেখির কথায়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে লেখা ছাপানোর একটা দারুণ নেশা ছিল, ঠিক যেমন ড্রিং করার মতোই।

একদিন আমার অত্যন্ত কাছের বন্ধু হুমায়ূন ভাইকে একটা গল্প লিখে দেখালাম। হুমায়ূন ভাই তখন নন্দিত নরক এবং শঙ্খনীল কারাগার লিখে বাংলাদেশের বাজার মাত করে ফেলেছে। বলল, ‘জীবেন, বালিশের নিচে রেখে দাও কিছুকাল, তারপর আবার লিখ।’ বন্ধুর কথায় দুঃখবোধ তখনো হয়নি, তবে কিছুটা দমে গেলাম।

সে সব সময়কাল পার হয়ে ২০০১ সালে ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে একাডেমিক জবের জন্য একটা ফোন ইন্টারভিউ দিলাম। বাংলাদেশে তখন রাত ১২টা-১টা আর যুক্তরাষ্ট্রে দিন দুপুর। আমি নিজেই অবাক। একটি মাত্র ফোন ইন্টারভিউর মাধ্যমে চাকরি। তাও আবার যুক্তরাষ্ট্রে। আমার ছোটবেলাকার স্বপ্নের দেশ। সহযোগী অধ্যাপকের চাকরিটা নিয়ে পাঁচজনের পুরো পরিবারসহ সেই যে পাড়ি জমালাম, শিকড়ে বাঁধা পড়ে গেলাম। তা ধিং তা ধিং করে করে জীবনের কান্নিতে এসে পড়লাম।

সেই যে মধ্যবিত্ত হয়ে গ্রামীণ মধ্যবিত্তের ঘরে জন্মেছিলাম, এখনো সেরকম মধ্যবিত্তেই আছি। তবে শহরের মাপকাঠিতে। তারপরও ব্র্যান্ডেট নতুন গাড়ি কখনোই চালায়নি। আমারই মতো জীর্ণশীর্ণ গাড়ি আমার। সৌভাগ্যের কথা আমার বৌয়েরও তেমন কোনো চাহিদা নেই। তবে হয়তো তার দুঃখবোধ থাকতে পারে। কিন্তু দুঃখবোধের মানুষ তো আমি নই।

তাহলে বসন্তসুখে কি সেই দুঃখবোধ?

বন্ধু হুমায়ূন আহমেদ হলে এখানেই থেমে পাঠকদের আরও ৫০ পৃষ্ঠা টেনে নিয়ে যেত। তারপর ক্রমশ প্রকাশ করত। সবাইতো হুমায়ূন আহমেদ হতে পারবে না। কলম ধরলেই যার লেখা আসে।

১৯৮০ সালের সামারে ১০০ ডলার দিয়ে গ্রেহাউন্ড বাসের একটা টিকিট কেটে নর্থ আমেরিকা, কানাডা- যুক্তরাষ্ট্র ট্যুরে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম স্টপেজ ছিল হুমায়ূন ভাইয়ের বাসায়। নর্থ ডোটার ফারগো শহরে। ৩-৪ দিন থাকলাম। ভাবি ও হুমায়ূন ভাইয়ের আন্তরিকতা ভুলবার নয়। তারপর প্রায় এক দশক চলে যায়। তখন আমরা এবং হুমায়ূন ভাইয়েরা ঢাকায়। আমাদের প্রথম মেয়ে একটা ক্লিনিকে জন্মেছিল। দুই দিন পর হুমায়ূন ভাই তিনটা বই নিয়ে আমার স্ত্রীকে উপহার দিয়ে গেল। সত্যিকথা বলতে কি হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এক কথায় দারুণ ছিল। এমনকি তার পরিবারের সঙ্গে পর্যন্ত- তার মা, বোন এবং ভাই। শুধু জাফর ইকবালের সঙ্গে মুখোমুখি পরিচয় হয়নি। যা হোক কোনো এক সময় হুমায়ূন ভাইকে নিয়ে লিখব।

এখনো তো বলাই হয়নি কি সে দুঃখবোধ? যখন যা যতটুকু, ঠিক ততটুকু করেছি- এ যাবৎ কাল। টিচিং জবে যখন আছি তখন প্রমোশন তো দরকার। অন্তত ২/৩টা রিসার্চ পাবলিকেশন এবং অন্যান্য। আরও জানলাম, একটা টেক্সস্ট বই লিখলে প্রায় ১০টা পাবলিকেশনের সমান। কী আর করা, লিখেই ফেললাম একটা টেক্সস্ট বই। অতএব কোনো কিছুতেই মন খারাপের মতো তেমন বড় কিছু ঘটেনি।

আগেই বলেছি, এক লাইন গান গাইতে না পারলেও গান শুনতে তো ভালোবাসি। কানাডায় পিএইচডি করতে আসার আগে সেসব পুরনো দিনের গান ক্যাসেটে করে নিয়ে এসেছিলাম। এখানে একটা কথা আমি স্বীকার করতে চাই। তা হলো কানাডায় পিএইচডি করার সময় মনে হয়েছিল, আহা, আমার যদি বউ থাকত, সেও দেখতে পেত এসব উন্নত দেশগুলো।

বিয়ে করার যে চেষ্টা করিনি, তেমনটা নয়। কেননা, আমার অনেক শুভার্থী ছিল। তারা অনেক চেষ্টা করেছে। এমনকি আমি নিজেও অ্যাডভার্টাইজমেন্ট করেছি। কিন্তু ফলপ্রসূ হয়নি। নাহ সেজন্য আমার তেমন একটা দুঃখবোধ নেই। কিন্তু আমি তো এখনো সেই দুঃখ-দুঃখ গানগুলো শুনি। সতীনাথ ও জগন্ময় মিত্র আমার প্রিয়। এই লেখাটা লিখতে গিয়ে আমি সতীনাথের,

“যে পথে নিলে বিদায়,

আজও সেথায় বিরহ আমায় মিছে পথ চাওয়ায়”

কিংবা জগন্ময় মিত্রের এক ও অদ্বিতীয়, ‘চিঠির গানটা’।

আমার বড় মেয়ে প্রায়শ বলে গাড়িতে উঠলেই সেই দুঃখের গানের ক্যাসেট। শুধু কি বাংলা দুঃখী গান। আপনারা যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত গায়িকা এডেলির নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। তার সবচাইতে দুঃখী গান হলো ‘ইজি অন মি’- সেটাও আমার প্রিয়। তবে খুশির গান যে পছন্দ করি না অথবা শুনি না তেমন নয়। যেমন অনেক আগে ভাইরাল হওয়া ফেরেল উইলিয়ামস-এর একটি গান, ‘বিকজ ইউ আর হ্যাপি’ বারবার শুনতে পারি।

এই যে বসন্তসুখে দুঃখবোধ, তা নিয়ে সায়েন্স বা গবেষণা কী বলে?

ড. সাচ (Sach) গ্রুপ এ বিষয়ে প্রচুর গবেষণা করেছে। তাদের মতে যেসব মানুষের ভিতরে সহমর্মিতা বেশি তারাই হয়তো দুঃখবোধের গান বেশি পছন্দ করেন। অন্য গবেষকদের মতেও দুঃখবোধের গান আমাদের মস্তিষ্কের যে অংশ আমাদের কল্পনাকে পরিচালনা করে এবং আমাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই অংশকে উজ্জীবিত করে। সুতরাং আপনার, আমার, অনেকেরই ভালো লাগে দুঃখের গান।

লেখক : বিজ্ঞান ও গণিত বিভাগ, মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যান, কলম্বাস, যুক্তরাষ্ট্র

ইমেইল : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর