শিরোনাম
বুধবার, ২২ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

রবিঠাকুর, বাঙালি রেনেসাঁ ও কাজী আজিজুল হক

বিধান দাশগুপ্ত

রবিঠাকুর, বাঙালি রেনেসাঁ ও কাজী আজিজুল হক

ফিঙ্গারপ্রিন্ট সিস্টেমের আবিষ্কারক কাজী আজিজুল হক ছিলেন খুলনা জেলার ফুলতলা থানার দক্ষিণডিহি মৌজার পায়গ্রাম কসবার মানুষ। পিতৃ-মাতৃহীন আজিজুল হক কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিতের মেধাবী ছাত্র। তখন ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির পুলিশের আইজি ছিলেন এডওয়ার্ড হেনরি। প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ তার প্রিয় ছাত্র আজিজুল হককে পাঠালেন হেনরির কাছে। হেনরি তাকে নিয়োগ দিলেন পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে। কাজী আজিজুলের কাজ ছিল ‘আঙুলের ছাপ’ নিয়ে গবেষণা করা। গণিতপ্রেমী কাজী আজিজুল আঙুলের ছাপ নিয়ে কাজ করার সময় তার গণিত প্রতিভাকে কাজে লাগালেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, প্রতিটি মানুষের আঙুলের ছাপ অন্য সবার থেকে আলাদা। এটি তার নিজস্ব মুদ্রা। একজনের সঙ্গে অন্যজনের আঙুলের ছাপের মিল নেই। এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে শনাক্ত করা যায় কে অপরাধী। এখন এই আঙুলের ছাপ কম্পিউটার, মোবাইলের লক, গেটের তালা, অফিসের উপস্থিতিসহ ব্যবহৃত হয় যাবতীয় আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক সৃজনশীল কাজে। এই ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডিটেকশন সিস্টেম’-এর আবিষ্কারক বঙ্গতনয় কাজী আজিজুল হক।

তিনি এই আবিষ্কারের কথা জানালেন এডওয়ার্ড হেনরিকে। পুলিশ বিভাগের কাজকর্ম সহজ হয়ে গেল। কিন্তু হেনরি আজিজুল হকের সাফল্য ও কৃতিত্ব গোপন করে সবকিছু নিজের নামে চালিয়ে দিলেন। তিনি ব্রিটিশ কর্মকর্তা ও গোটা ইউরোপকে নিজের কৃতিত্বের কথা জানান দিলেন। পদ্ধতিটি ‘হেনরি ক্লাসিফিকেশন সিস্টেম’ নামে পরিচিতি পেয়ে গেল। অবশেষে একদিন সব গোমোর ফাঁস হলো। হেনরি আনুষ্ঠানিকভাবে কাজী আজিজুল হকের অবদান স্বীকার করে নিলেন। পুলিশ বিভাগে তার অবদানের কথা স্বীকার করে আজিজুল হককে এসপি (পুলিশ সুপার) পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়। সেই সঙ্গে ব্রিটিশরাজ কাজী আজিজুল হককে ‘খাঁন বাহাদুর’ অভিধায় আখ্যায়িত করেন।

বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা’ যেমন নয় মাসের যুদ্ধফসল নয়, তারও আগে বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন, ছয় দফা, লাহোর প্রস্তাব, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ ইত্যাদি কর্মযজ্ঞের ফসল; তেমনি দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্সের কর্মযজ্ঞ ১৯৯৫-এর ১৪ নভেম্বর দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনেরও আগের। ১৯৯৫-এর প্রায় ২০ বছর আগে আমরা কিছু তরুণ এই কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলাম। রাম জন্মাবার ষাট বছর পূর্বে মহাগ্রন্থ ‘রামায়ণ’ রচিত হয়। আমরা বাল্মিকির মতো মহৎ কাজটি করেছি। এটাই ইতিহাস। এই ইতিহাসকে যারা মান্যতা দিতে চান না, তারা নিঃসন্দেহে মতলববাজ। আর তাই কাজী রিয়াজুল হক (খুলনার জেলা প্রশাসক) সম্পাদিত ‘দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স স্মারকগ্রন্থ’-এ (প্রকাশকাল ২৬ নভেম্বর ১৯৯৫) এসব তথ্য উপেক্ষিত থাকে। দক্ষিণডিহি নিয়ে এত কাজ করা সত্ত্বেও উদ্যোক্তাদের অনেকেই ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাননি। প্রশাসনের সুবিধাভোগী সংস্কৃতিসেবী এবং সংবাদকর্মীরা জেলা প্রশাসক মহোদয়কে এ নিয়ে কোনো কথা বলেন না। শুধু স্মারকগ্রন্থে অধ্যাপক অচিন্ত্যকুমার ভৌমিক ‘রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি অবমুক্তিকরণ’ শীর্ষক নিবন্ধে লেখেন, ‘রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরালয় উদ্ধারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রচেষ্টা চলছে। এ নিয়ে লেখালেখিও কম হয়নি। স্থানীয় পত্রপত্রিকাসহ জাতীয় পত্রিকাগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে কবিগুরুর শ্বশুরবাড়ি নিয়ে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ড. আশরাফ সিদ্দিকী, বিধান দাশগুপ্তসহ বেশ কজন প্রতিষ্ঠিত লেখক এ নিয়ে লিখেছেন।’

ভাষা যে শুধু ভাবপ্রকাশের, সত্যপ্রকাশের বাহন নয়, তথ্যউপাত্ত গোপন করারও বাহন-অধ্যাপক ভৌমিকের কুশলী লেখাটি (পৃ. ১৫২) তার উদাহরণ! এভাবেই বর্তমান নিবন্ধকারের সব শ্রম ও সাধনা ঢাকা পড়ে যায়। এক ধরনের চাটুকর সংস্কৃতির প্রচলন শুরু হয়। কাজী রিয়াজুল হক দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্সের ‘রূপকার’ খেতাব পেয়ে যান। আমি স্বীকার করি যে, তিনি এগিয়ে না এলে হয়তো জমিসহ স্থাপনাটি এত শিগগির উদ্ধার হতো না। তারপরও বলব, কাজী রিয়াজুল হক বুদ্ধিবৃত্তিক সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বাঙালি রেনেসাঁর শ্রেষ্ঠ আইকন। রবিঠাকুরের আদিপুরুষের নিবাস, শ্বশুরবাড়ি, মামাবাড়ি এই দক্ষিণডিহি। তার পূর্বপুরুষরা প্রায় ২০০ বছর এই গ্রামে বসবাস করেছেন। তাই দক্ষিণডিহির ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখা বাঙালির জন্য অতি জরুরি।

ভাষা সংগ্রামী, প্রখ্যাত রবীন্দ্র গবেষক, আহমদ রফিকের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করে এই লেখা শেষ করতে চাই ‘আমরা প্রত্যেকে গণতন্ত্র, দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে যার মতো করে ব্যাখ্যা করি। ব্যবহার করি নিজের স্বার্থে, ওপরে ওঠবার সিঁড়ি হিসেবে।’...

লেখক : রবীন্দ্রগবেষক; প্রতিষ্ঠাকালীন সংগঠক, দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স

সর্বশেষ খবর