বৃহস্পতিবার, ২৩ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

বাবরের সমাধি ও সম্রাট নেবুচাঁদ নেজারের ঝুলন্ত বাগান

সাইফুর রহমান

বাবরের সমাধি ও সম্রাট নেবুচাঁদ নেজারের ঝুলন্ত বাগান

যিশুর জন্মের আনুমানিক ৬২০ বছর আগের ঘটনা। সে সময় ব্যবিলনের রাজা ছিলেন দ্বিতীয় নেবুচাঁদ নেজার। রাজা নেবুচাঁদ তখনো বিয়ে করেনি। এবার প্রজাদের দাবি তাদের প্রাণপ্রিয় রাজা বিয়ে করুন। কোনো দেশের ফুটফুটে পরির মতো রাজকুমারীকে রাজ্যের রানি করে আনা হোক।

পারস্যের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের দিকে মেডিয়া নামে যে রাজ্যটি আছে, সে রাজ্যের রাজকুমারী আমিতিসের রূপ, গুণ, শিক্ষা ও শিষ্টাচারের সুনাম সমগ্র প্রাচ্যজুড়ে। প্রজাদের অভিপ্রায় বুঝে মহামহিম নৃপতি নেবুচাঁদ নেজারও ভাবলেন, রানি যদি করতেই হয় তাহলে আমিতিসকেই ব্যবিলন রাজ্যের রানি করে আনবেন তিনি। না হলে নয়। ব্যবিলনের রাজধানী বাগদাদ সে সময় শিক্ষা, দীক্ষা ও সভ্যতার তীর্থভূমি। আর সে রাজ্যের বিখ্যাত অধিপতি সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাঁদ পাঠিয়েছেন বিয়ের সম্বন্ধ। এ তো ভাগ্যের ব্যাপার। মহা হইচই, ধুমধাম ও চোখ ধাঁধানো যজ্ঞের মধ্য দিয়ে নেবুচাঁদের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল রাজকুমারী আমিতিসের। রাজার প্রাসাদ দেখে রানিও ভীষণভাবে অভিভূত ও মুগ্ধ। সেও না হয় হলো, কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই নেবুচাঁদ লক্ষ্য করলেন রানির মুখে হাসি নেই। সব সময় মুখ কেমন যেন গোমড়া করে রাখেন রানি।

নেবুচাঁদ কৌতূহলী কণ্ঠে রানিকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন- ‘আচ্ছা রানি আপনি আমায় খুলে বলুন তো আপনার বিষণ্ণতার কী কারণ। আমি লক্ষ্য করেছি বাগদাদের এ প্রাসাদে আপনার পদরেণু পড়ার পর থেকেই আপনি কেমন যেন বিষণ্ণ ও উদাস। মনে হয় যেন রাজ্যের মলিনতা এসে ভর করেছে আপনার অবয়বে। আপনাকে সব সময় দেখায় দুঃখী, অসুখী ও বিষাদগ্রস্ত। দয়া করে আমায় খুলে বলুন এর হেতু। রানি আমিতিস ইতস্তত কণ্ঠে বললেন- কী আর বলব রাজন। মেডিয়া রাজ্যের রাজপ্রাসাদের যে কক্ষে আমি থাকতাম সেই কক্ষের গবাক্ষ দিয়ে চোখ রাখলেই আমার চোখ জুড়িয়ে যেত। আমাদের প্রাসাদের পাশ ঘেঁষে ঢেউয়ের মতো খেলানো সারি সারি পাহাড় আর সেই পাহাড়ে শোভা পায় শতসহস্র ঘন সবুজ বৃক্ষরাজি। সেখানে গান গায় কত নাম জানা-অজানা পাখি। মৌ নিতে ছুটে আসে মৌমাছির ঝাঁক। ফুলে ফুলে খেলা করে কত শত রংবেরঙের প্রজাপতি। ফুলের গন্ধে মন্ডম করে চারপাশ। সবকিছু এতটাই নিকটে যে, মনে হয় যেন আমার ঘরের জানালা দিয়ে সেই বৃক্ষরাজির ছোঁয়া যায় অনায়াসে।

আমার শৈশব, কৈশোর ও এ যৌবনের সবটুকু সময় কেটেছে আমাদের প্রাসাদ লাগোয়া ওই মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে। সারি সারি সবুজ গাছপালা, ফুল, পাখি আমার বড়ই পছন্দ। আপনার এখানে আমি বেশ সুখেই আছি বলা যায়। কিন্তু আমার অতি প্রিয় বৃক্ষরাজির সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। আপনাদের এ অঞ্চলটা বড়ই শুষ্ক, রুক্ষ ও ধূসর। সবুজ গাছপালা, ফুল, পাখি, প্রজাপতি এগুলো ছাড়া কি সৌন্দর্যের খোলতাই হয়। মহারাজ, প্রকৃতি ও গাছপালার সান্নিধ্যে কাটানো দিনগুলোর কথা ভেবে আমি ক্রমেই যেন গৃহকাতর হয়ে পড়ছি।

আমার শুধুই নিজপ্রাসাদের কথা মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন এখনই ছুটে যাই সেখানে। রাজা নেবুচাঁদ ডান হাত দিয়ে চিবুক ঘষতে ঘষতে বললেন, এই কথা!! তাহলে তো এর একটা বিহিত করতেই হয়। রানি কণ্ঠে আশ্চর্যের আভাস তুলে বললেন, এর বিহিত কীভাবে করবেন রাজন? রাজা নেবুচাঁদ কণ্ঠটা একটু চড়িয়ে বললেন, দেখাই যাক না। অসম্ভব বলে তো কিছু নেই। রাজা নেবুচাঁদ অবিলম্বে তার সভাসদ ও রাজ আমাত্যদের ডেকে পাঠালেন। তিনি তাদের উদ্দেশ করে বললেন, আমি একটা অনিন্দসুন্দর বাগানসহ প্রাসাদ করতে চাই। আপনাদের কী মত? তবে বাগানটি নির্মিত হবে ভূমিতে নয় মাটি থেকে ওপরে। যেন নিজ কক্ষ থেকে সরাসরি বাগানে প্রবেশ করা যায়। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃক্ষের পল্লব ছোঁয়া যায়। স্পর্শ করা যায় নবপত্রযুক্ত কচিডালের অগ্রভাগ। সভাসদ ও আমাত্যগণ আর্তনাদ করে উঠলেন- এতো বহু অর্থ মূল্যের অভিলাস জাঁহাপনা। হোক ব্যয় বহুল, তারপরও আমার চাই এমন একটি বিশাল বাগান যা হবে ব্যবিলন সাম্রাজ্যের দৃষ্টান্ত। দেশ দেশান্তর থেকে মানুষ আসবে সেই বাগান দেখতে। দেখে বলবে, হ্যাঁ এটি একটি বাগানই বটে!!! এটা হবে এই ব্রহ্মান্ডে প্রথম শূন্যোদ্যান। সব রাজআমাত্য ও সভাসদগণ লেগে গেলেন রাজার স্বপ্নপূরণে। সেই সময়কার পৃথিবীখ্যাত সব নগরবিদ, স্থাপত্যবিদ ও প্রকৌশলীদের নিযুক্ত করা হলো এ কাজে।

গ্রিসের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ডিওরডরাস সিকুলাস লিখেছেন, বিস্ময়কর সেই ঝুলন্ত উদ্যানটি নির্মিত হয়েছিল ভূমি থেকে প্রায় ৭৫ ফুট ওপরে। বাগানটির দৈর্ঘ্যে ৪০০ ফুট, প্রস্থও ৪০০ ফুট। বাগানটিতে সেচের জন্য প্রতিদিন প্রয়োজন হতো ৮ হাজার ২০০ গ্যালন পানি। পানি সরবরাহ হতো প্রাসাদের নিকটবর্তী ইউফ্রেটিস নদী থেকে। কিন্তু এই ৮ হাজার ২০০ গ্যালন পানি কীভাবে রোজ পাম্প করে ওপরে তোলা হতো সেটা বিজ্ঞানীদের কাছে আজও বিস্ময়।

তবে এ কথা কুণ্ঠাহীনভাবেই বলা যায় যে, ব্যবিলনের রানি আমিতিস কিংবা রাজা নেবুচাঁদ নেজারেরই যে শুধু উদ্যানপ্রীতি ছিল, তেমনটা নয়। এমন আরও অনেক রাজা, মহারাজা যারা গাছপালা, তরুলতা, ফুল-ফল এসবের গুরুত্ব বুঝতেন, যদিও সে সময় বিজ্ঞান এতদূর পৌঁছেনি। তারা হয়তো জানতেনই না গাছ আমাদের অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু তারপরও তারা বুঝতে পেরেছিলেন বৃক্ষ মানুষের জীবনে অপরিহার্য অংশ। আমার এ মুহূর্ত আরেকজন সম্রাটের কথা মনে পড়েছে।

ফরাসি সম্রাট চৌদ্দতম লুই। যিনি ১৬৪৩ সাল থেকে ১৭১৫ সাল পর্যন্ত টানা ৭২ বছর ফ্রান্সে রাজত্ব করেছিলেন। যার হাত দিয়ে নির্মিত হয়েছিল বিশ্ববিখ্যাত ভার্সাই প্রাসাদ। ফ্রান্সের প্রজারা তাকে ডাকত সূর্য রাজা বলে। সেটা ১৬৬১ সালের ঘটনা। হঠাৎ রাজার কানে এলো অর্থমন্ত্রী নিকোলাস ফুকে রাজকীয় কোষাগার থেকে অর্থ তছরুপ করে নিজ প্রাসাদের সামনে রাজকীয় এক বাগান তৈরি করেছেন। রাজা লুই অর্থমন্ত্রীকে বললেন, মহাশয়, একদিন আপনার বাড়িতে বেড়াতে যেতে চাই। স্বয়ং রাজা আগ্রহ প্রকাশ করছেন অর্থমন্ত্রীর বাড়ি যাবেন। মন্ত্রী তো আর না করতে পারেন না। লুইকে তাই নিমন্ত্রণ করতেই হলো একদিন। রাজা লুই নিকোলাসের বাগান দেখে তাজ্জব বনে গেলেন। কোনো দেশের মহারাজার বাগানও তো এতো ঐশ্বর্যমন্ডিত ও গৌরবোজ্জ্বল হয় না। রাজা লুই মন্ত্রী নিকোলাসের কাছে জানতে চাইলেন, এমন মনোরম বাগানের স্থপতি কে? তিনি আরও বললেন- এমন একটি অপরূপ দৃষ্টিনন্দন বাগান শুধু ভার্সাই প্রাসাদের সঙ্গেই মানানসই। যে তিনজন বাগানবিদ মন্ত্রী নিকোলাসের বাগানটি তৈরি করেছিলেন তাদের রাজা নির্দেশ দিলেন অবিলম্বে এমন একটি বাগান ভার্সাই প্রাসাদের সম্মুখে করতে হবে। টাকা যা খরচ হয় হোক। সেই সঙ্গে সূর্যসম্রাট লুই এও বললেন যে, তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বাগান নির্মাণের দিকনির্দেশনা দেবেন। ৮ হাজার হেক্টর অর্থাৎ প্রায় ৭০ হাজার বিঘা জমির ওপর নির্মিত হলো রাজা চৌদ্দতম লুইয়ের বাগান। তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার প্রজাতির বৃক্ষরোপণ করা হলো সেই বাগানে। কথিত আছে রাজা লুই যেহেতু কমলা ফল পছন্দ করতেন, সেহেতু পঞ্চাশ প্রজাতির শুধু কমলা গাছই রোপিত হয়েছিল বাগানে। ভারত, চীন, গ্রিস প্রভৃতি দেশ থেকে রাজা লুই আনিয়েছিলেন ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির কমলা ফলের চারা।

ইতিহাস ঘাটলে হয়তো অনেক রাজা, মহারাজা নৃপতি কিংবা সম্রাটের নাম পাওয়া যাবে যারা ব্যক্তি জীবনে হয়তো ছিলেন ভীষণভাবে বৃক্ষপ্রেমী ও বাগানবিলাসী। কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের মতো বাগান, ফুল, ফল ও বৃক্ষপ্রেমীর তুলনা বিশ্বে বিরল। ইতিহাসবিদরা তাকে আখ্যা দিয়েছেন ইতিহাসের অসামান্য বাগানবিলাসী রাজা। সম্রাট বাবর বাগান ভালোবাসতেন ভীষণ। তারই আমলে একটি নির্দিষ্ট জমিকে চার ভাগে ভাগ করে বাগান বানানো হতো, একে বলা হতো ‘চাহার বাগ’। চাহার বাগ শব্দটি হলো ফারসি শব্দ, হিন্দিতে একে চার বাগ বলা হয়। এ ধরনের বাগানে ফুলের গাছ লাগিয়ে মনোরম পরিবেশ তৈরি করা হতো। মুঘল শাসকরা তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের পাশাপাশি অন্যান্য নন্দনতাত্ত্বিক বিষয় সম্প্রসারণেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সুদূর মধ্য এশিয়া এবং পারস্য থেকে এ ধরনের বাগানের ধারণা তারাই প্রথম ভারতবর্ষে নিয়ে এসেছিল বলে অনুমান করা হয়। ব্যক্তিজীবনে সম্রাট বাবর ছিলেন কবি, লেখক ও সাহিত্যানুরাগী। তার লেখা আত্মজীবনী ইতিহাসের এক মহামূল্যবান সম্পদ। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পন্ডিতদের মতে সম্রাট বাবরের আত্মজীবনীর তুলনা চলে শুধু বিশ্বের চারখানা বইয়ের সঙ্গে। সাত শ খ্রিষ্টাব্দের দিকে চার্চের পাদ্রি সেইন্ট অগাস্টিন লিখিত ‘কনফেশন’। ১৭০০ সালের দিকে লেখা বিখ্যাত দার্শনিক রুশোর গ্রন্থের নামও ছিল ‘কনফেশন’। জ্যাক রুশো অবশ্য তার পূর্বসূরি লেখক সেইন্ট অগাস্টিনের লেখা বইটাকেই অনুসরণ করেছেন। অগাস্টিন যেমন তার বইয়ে তার জীবনের পাপ, পঙ্কিলতা ও কদর্য দিকগুলো তুলে ধরেছেন। রুশোও তাই করেছেন। অন্যদিকে বাবরের আত্মজীবনীর সঙ্গে আর যে দুটি বইয়ের তুলনা পন্ডিতেরা করেছেন তা হলো গিবন ও বিজ্ঞানী নিউটনের লিখিত স্মৃতিকথা। সে যা হোক, বাবরের আত্মজীবনী পড়লে বোঝা যায় গাছপালা, বৃক্ষ, ফুল, ফল, বাগান এসবের প্রতি তার ছিল কি সীমাহীন অনুরাগ।

সম্রাট বাবর আফগানিস্তানের কাবুল জয় করেছিলেন ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে। তারপর তিনি জয় করেন ভারত। বাবরের মৃত্যু ঘটে আগ্রায় ১৫৩০ সালে। তার শেষ ইচ্ছা ছিল কাবুলে তিনি যে ১০টি অনিন্দ্য সুন্দর বাগান তৈরি করেছিলেন তাকে সেখানেই সমাহিত করা হোক । তার সেই ইচ্ছা অনুসারে তার বিধবা স্ত্রী ১৫৪৪ সালে আগ্রা থেকে তার সমাধি সরিয়ে নিয়ে কাবুলে পাঠান। তাকে আবার সমাহিত করা হয় তার তৈরি সেই বাগানে। বাবরের আত্মজীবনীর অনেকটা অংশজুড়ে আছে কাবুলের মতো রুক্ষ ও শুষ্ক ভূমিতে তিনি কীভাবে বাগান তৈরি করেছিলেন। নিরেট পাথরে ফুটিয়েছিলেন রংবেরঙের ফুল। তিনি তার বইতে লিখেছেন, ‘কাবুল দেশটা পাথুরে। বিদেশি কিংবা শত্রুর পক্ষে এ দেশ দুর্গম। এর উষ্ণ ও শীতপ্রধান অঞ্চলগুলো পাশাপাশি। এক দিনেই তুমি এমন জায়গায় যেতে পার যেখানে তুষারপাত হয় না। আবার সেখান থেকে দুই ঘণ্টার পথ চললেই এমন জায়গায় পৌঁছে যাবে যেখানে অবিরাম তুষারপাত হচ্ছে। কাবুলের উত্তর পশ্চিমে চলকের বিস্তৃত তৃণক্ষেত্র।

এগারো বারো রকমের ভাষা কাবুলে চলতি যেমন- আরবি, ফারসি, তুর্কি, মোগলি, হিন্দি, আফগানি, পাশাই, পরাচি, গেবেরি, বেরেকি ও লামঘানি। পাহাড়ের পথে নিচে নেমে এলে তুমি এক অন্য জগতে পৌঁছে গেছ। এখানকার বড় বড় গাছ, শস্য, পশু, সবই অন্য ধরনের। এদিকের জনসাধারণের ব্যবহার রীতিনীতিও আলাদা। কাফেরিস্তানের পার্বত্য প্রদেশে নোয়ারের পিতা সাধু লোমোচের সমাধি আছে। পর্বতগুলোর প্রান্তভাগ নানা ধরনের টিউলিপ গাছে ভর্তি। আমি আমার লোকদের কত রকমের টিউলিপের গাছ আছে গুনে দেখতে বলেছিলাম। তারা নানা রকমের তেত্রিশটা গাছ এনে হাজির করে। এখানে খুব বড় বড় সুন্দর ঝাঁকড়া মাথা গাছ আছে। আমি নদীর ধারে ধারে উদ্যান রচনা করি। একটা পাহাড়ের ধারে আমি ফোয়ারা তৈরি করার আদেশ দিই। এখানে পীতবর্ণের আর খুবান ফুলের গাছ অপর্যাপ্ত। যখন সেই গাছে লাল রঙের ছিটে দেওয়া পীতবর্ণের ফুল ফোটে তখন এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য হয় যে তা দেখে আমার মনে হতো যে পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর স্থানের কথা কল্পনাতেও আনা যায় না।’ মুঘল সম্রাট বাবরের নন্দনতাত্ত্বিক এ বিষয় ভাবনাগুলো পরবর্তীকালে তাদের উত্তরসূরিদের মধ্যেও দেখা গিয়েছিল। মুঘল সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ও বাগানের প্রতি খুবই আগ্রহী ছিলেন। সে কালের ভারতের চাহর বাগের নিদর্শন বললে প্রথমেই মনে পড়বে পাকিস্তানের লাহোরে অবস্থিত শালিমার বাগের কথা।

লাহোর শহরের ৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের পাশে বাগবানপুরা এলাকায় এ উদ্যানের অবস্থান। মধ্য এশিয়া, কাশ্মীর, পাঞ্জাব, পারস্য ও দিল্লি সালতানাতের চিত্রশৈলী এতে প্রাধান্য পেয়েছে। শালিমার বাগের একটি ইতিহাস রয়েছে। বাগবানপুরার আরাইন মিয়া পরিবারের ভূমিতে এ স্থাপত্যটি নির্মিত হয়েছে। মুঘল সাম্রাজ্যকে অনবদ্য সেবা দেওয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি রাজকীয় উপাধি ‘মিয়া’ লাভ করেছিলেন। তৎকালীন গৃহস্বামী মিয়া মোহাম্মদ ইউসুফ সম্রাট শাহজাহানকে ইশাক পুরার এ জমিটিতে রাজ প্রকৌশলী কর্তৃক উদ্যান তৈরিতে ভালো অবস্থান ও মাটির গুণাগুণের কারণে স্বত্ব ত্যাগ করেন। বিনিময়ে সম্রাট শাহজাহান পরিবারটিকে শালিমার উদ্যান পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করেন। এখনো এ উদ্যানটি মিয়া পরিবার কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে।

যদিও এ উদ্যানের সার্বিক উৎকর্ষ এবং নান্দনিকতার জন্য সম্রাট জাহাঙ্গীরকেই কৃতিত্ব দেওয়া যেতে পারে। শালিমার বাগের নির্মাণ কৌশলেও রয়েছে ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর বৈশিষ্ট্য। পার্সিয়ান গার্ডেনের আদলে এটি তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ এ বাগে রয়েছে অসংখ্য ঝরনা এবং কৃত্রিম জলপ্রপাত। সমগ্র বাগিচার আয়তন প্রায় ৩১ একর। যার বিস্তীর্ণ পথ সবুজ ঘাসে মোড়া। দূর থেকে দেখলে সবুজ গালিচা মনে হতে পারে। সবুজ গালিচায় কিঞ্চিৎ বিশ্রাম নেওয়ার স্বাদ ভ্রমণকারীদের মনে জাগতেই পারে। লাল-নীল-কমলা-সাদা রংবেরঙের এবং বহু বিচিত্র প্রজাতির ফুল এবং অর্কিডের শোভা যেন বাগানটিকে আরও বেশি উৎকর্ষ দিয়েছে। শালিমার বাগের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলো সারিবদ্ধ ম্যাপেল গাছ, শুকনো ম্যাপল গাছের পাতা যখন বাগানের রাস্তায় ইতিউতি ছড়িয়ে থাকে, তখন তার নন্দনতাত্ত্বিক সৌন্দর্য মনকে শান্ত করে, আনন্দ দেয়।

শালিমার বাগের মধ্যেই চোখে পড়বে সুদৃশ্য ‘দেওয়ান-ই-আম’এর দরবার। কার্যত এ দরবার হলেই সম্রাট সবার সঙ্গে দেখা করতেন, প্রজাদের আর্জিও শুনতেন। এটি একেবারে বাগের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। মোটের ওপর শালিমার বাগের সৌন্দর্য দেখে যদি একে এক টুকরা বেহেশত বলে মনে হয়, তাহলে বোধ হয় ভুল হবে না।

ভারতবর্ষে সুলতানি এবং মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস বরাবরই ঐতিহাসিকদের বিস্মিত করেছে। তাদের সাম্রাজ্য পরিচালন নীতি, প্রজাকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি, একই সঙ্গে তাদের নন্দনতাত্ত্বিক এবং স্থাপত্যশৈলীর প্রতি এক আত্মিক টান বরাবরই সুপ্রসিদ্ধ। আজকের দিনে ক্রমবর্ধমান এ বিশ্ব-উষ্ণায়ন তথা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা যদি ফিরে যেতে পারি সেই মুঘল সাম্রাজ্যের কালে, তাহলে হয়তো পেতে পারি এক টুকরা সবুজ, সতেজ হাওয়া। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের জীবনযাত্রার নানা পরিবর্তন ঘটলেও প্রকৃতির প্রতি আত্মিক যোগাযোগ চিরন্তন। আজকের এ ব্যস্ত সময়ে দাঁড়িয়েও মানুষ যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছোঁয়া বা আভাস পেতে চায়, মুঘল শাসকরাও ঠিক তেমনইভাবে প্রকৃতিকে দেখেছে এবং প্রাকৃতিক সংরক্ষণের প্রতি এক সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। কালের বিবর্তনে বিভিন্ন নৃপতিদের বৃক্ষ, বাগান, উদ্যানপ্রীতি সেগুলোরই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

♦ লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

 

 

সর্বশেষ খবর