রবিবার, ২৬ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

সত্য বড় নির্মম

মহিউদ্দিন খান মোহন

সত্য বড় নির্মম

সত্য নাকি নির্মম হয়। কার জন্য নির্মম তা ব্যাখ্যা করে বলা হয়নি। যিনি সত্য বলেন তার জন্য, নাকি যার সম্পর্কে বলা হয় তার জন্য? স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এ নির্মমতা ভোগ বা উপভোগ করার পাত্র ভিন্ন হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। অনেক সময় সত্য যিনি উচ্চারণ করেন, তাকে কঠিন পরিস্থিতি, এমনকি কঠিন পরিণতিরও মুখোমুখি হতে হয়। আবার কখনো যার বা যাদের সম্পর্কে সত্যটি বলা হয়, তারাও সম্মুখীন হন জটিল পরিস্থিতির। তবে বর্তমান জমানায় সত্য উচ্চারণকারীকেই বিপাকে পড়তে হয়। আপ্তবাক্য ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ সবাই মানলেও সবাই সব সময় সত্য বলেন না। এ না বলার রয়েছে নানাবিধ কারণ। এগুলোর মধ্যে উচ্চারিত সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো মানুষের অভাব অন্যতম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সত্যের পক্ষে নয়, বরং অসত্যের পক্ষেই দাঁড়িয়ে গেছে বেশির ভাগ মানুষ। সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষেরা সত্যটির যথার্থতা অনুধাবন করলেও মুখ ফুটে তার পক্ষে বলার সাহস রাখেন না। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবু সাইয়িদের বক্তৃতার একটি ক্লিপ এখনো সামাজিক মাধ্যমে চলমান রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘বর্তমান সমাজে ভালো মানুষেরা বিচ্ছিন্ন, আর খারাপ মানুষগুলো সংঘবদ্ধ’। এটি একটি নির্মম সত্য কথা। তার এই বক্তব্যের যথার্থতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এর প্রতিফলন আমরা সমাজে সদা-সর্বদা প্রত্যক্ষ করে থাকি।

শুরু করেছিলাম সত্য নিয়ে। গত ২০ মে বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম সাহেবের ‘বিপদের বন্ধু ও ভুলে যাওয়া ওয়ান-ইলেভেন’ শিরোনামের উপসম্পাদকীয়টি পড়ে সত্য বলা না বলার প্রসঙ্গটির অবতারণা। কেননা, আমার বিবেচনায় তিনি তার লেখায় কতগুলো নির্মম সত্য উচ্চারণ করেছেন; যা কারও কারও পক্ষে হজম করা সম্ভব না-ও হতে পারে। তিনি যথার্থই বলেছেন, অসময়ে, মানে ‘দুঃসময়ে দুধের মাছিরা ফোন করলে ধরবে না। কাছে আসবে না। আড়ালে সমালোচনা করবে। গালমন্দ করবে। আপনাকে নীরবে হজম করতে হবে সবকিছু। আবার সুসময় শুরু হলে তারা সবার আগে ছুটে আসবে। চাটুকারিতায় ভাসিয়ে দেবে আপনাকে।’ একবিন্দু অসত্য নেই কথাগুলোতে। যারা এমন অবস্থায় পড়েছেন, তারা এর যথার্থতা সম্যক উপলব্ধি করতে পারবেন। ব্যক্তিগত হলেও বলতে হয়, এমন অবস্থায় কিছু মানুষের রূপ আমি দেখেছি। দেখেছি আর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ভেবেছি- মানুষ এমন হয় কী করে! রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর কাছাকাছি থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তখন দেখেছি তোষামুদে মানুষের ভিড়। মনে পড়ছে, ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর হাওয়া ভবনে তারেক রহমান এক দিন আমাকে হাস্যরসের ছলে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ‘মোহন সাহেব, কী কারণে আপনার মনে হয় যে, আপনি ক্ষমতায় এসেছেন?’ তাকে বলেছিলাম, প্রথমত আপনার প্রশ্নে ভুল রয়েছে। কারণ আমি না, আমার দল ক্ষমতায় এসেছে। আর যে কারণে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারটি অনুভব করছি, তাহলো, ‘গত পাঁচ বছর আমার বন্ধু-স্বজন যারা একটিবারের জন্য খোঁজ নেয়নি, তারা ইদানীং খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে।’ তিনিসহ উপস্থিত সবাই হেসে উঠেছিলেন। আমার সেদিনের কথায় এতটুকু মিথ্যা ছিল না। কেননা, এ দেশে রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চারপাশে মধুপোকার অভাব হয় না। আর যখন সে মধু থাকে না, পোকারাও কোথায় উড়ে চলে যায় কেউ জানে না। হয়তো অন্য কোনো ফুলের কাছে। সে সময় আমার চারপাশে চাটুকারের অভাব ছিল না। অফিসে, বাসায়, গ্রামের বাড়িতে, যেখানেই থাকি গুনগুন রবে প্রশস্তি গাইতে গাইতে মধুপোকারা এসে হাজির হতো সকাল দুপুর সন্ধ্যা কিংবা রাতে। গিন্নি খুব প্রাউড ফিল করতেন। স্বামীর এত ভক্ত! গর্ব হওয়ারই তো কথা। আমি তাকে বলতাম, যেদিন আমার এই ক্ষমতা থাকবে না, সেদিন এদের একজনকেও খুঁজে পাবে না। মধুলোভী পোকাদের সম্পর্কে সজাগ ছিলাম বলেই পরবর্তী প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কোনো আইনি বিপদে পড়তে হয়নি আমাকে। যদিও দেশের এক স্বনামধন্য ব্যক্তির পুত্রধন সে চেষ্টা কম করেননি।

সেই সময় যে যুবককে তার বন্ধু-স্বজনরা ফোন করলেই শুনত, ‘আমি এখন পিএম অফিসে, দাদার রুমে’, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই যুবক চোখ উল্টাতে দেরি করেনি। পুরো পাঁচটি বছর আমার পেছনে ‘রামভক্ত হনুমানের মতো’ লেগে থাকার পর সে এখন তার ‘পীর’ পরিবর্তন করেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, রাজনৈতিক মতপার্থক্যজনিত কারণে আমাকে হত্যার হুমকি দিতেও সে দ্বিধা করেনি! যারাই ঘটনাটি শুনেছেন, তারাই আমাকে নঈম ভাইয়ের বলা শেরে বাংলার গল্পটি বলেছেন। এক সুহৃদ তো বলেই ফেললেন, আপনি গাছে চড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, এখন সে ওপর থেকে আপনার মাথায় প্রাকৃতিক কর্মসম্পাদন করলে অবাক হবেন কেন? না, আমি অবাক হইনি। কেননা, অকৃতজ্ঞ মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে আমার ভালো ধারণা রয়েছে। আরেক বাল্যবন্ধু, যিনি তার ছেলের সুন্নতে খতনার অনুষ্ঠান আমি না গেলে অপূর্ণ থেকে যাবে বলে বারবার ফোনকলে অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন এবং অন্য একটি অনুষ্ঠান অসমাপ্ত রেখে আমাকে যেতে হয়েছিল, সেই তিনি গেল বছর তার সেই ছেলের বিয়েতে আমাকে দাওয়াতই করেননি। অবাক হইনি এ ঘটনায়ও। কেননা, এখন তো আমার উপস্থিতি তার অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে না।

নঈম নিজাম সাহেব প্রসঙ্গক্রমে ওয়ান-ইলেভেনের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সাইক্লোন, সিডর বা আইলাসদৃশ ওই সাময়িক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আমি একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। প্রতিটি ঘটনা অত্যন্ত কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী (প্রাক্তন) বেগম খালেদা জিয়ার সদ্যসাবেক সহকারী প্রেস সচিব ও দলের একজন কর্মী হিসেবে আমি আমার সঠিক কর্তব্য স্থির করে নিয়েছিলাম। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ভাগ্যে যা আছে হবে, কিন্তু আমার দল, ম্যাডাম এবং জিয়া পরিবারের এ দুঃসময়ে আমি তাদের পাশেই থাকব। ম্যাডামের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের নব্বই শতাংশই রাতারাতি হাওয়াই জাহাজে চড়ে এশিয়া মহাদেশ পেরিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমিয়ে নিরাপদ আশ্রয় বেছে নিয়েছিলেন। দুটি বছর আমরা ওয়ান-ইলেভেন সরকারের বিপরীতে লড়াই করেছি দলকে টিকিয়ে রাখতে। গ্রেফতার হওয়ার আগে ম্যাডাম আবদুল মান্নান ভূঁঁইয়াকে বরখাস্ত ও বহিষ্কার করে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন। কিন্তু তথাকথিত সংস্কারপন্থিরা তা মানতে রাজি ছিল না। তারা ৩১ অক্টোবর (২০০৭) মধ্যরাতে সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের বাসায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকের নামে অবৈধ একটি সভা করে সাইফুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মেজর হাফিজউদ্দিন (অব.)-কে অস্থায়ী মহাসচিব ঘোষণা করে বসল। সেই রাতে বিএনপির আজকের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদকে দিয়ে ওই বৈঠককে অবৈধ আখ্যায়িত করে কীভাবে পাল্টা বক্তব্য প্রচার করিয়েছিলাম, তার সবিস্তার বর্ণনা রয়েছে আমার লেখা ‘জরুরি অবস্থা, বিএনপি ও কিছু না বলা কথা’ বইয়ে। আর সেই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী চ্যানেল আইয়ের তৎকালীন বিশেষ সংবাদদাতা, বর্তমানে প্রবাসী সাংবাদিক সালেহ শিবলী।

ঘটনাটির অবতারণা এজন্য যে, ওয়ান-ইলেভেনের ওই দুঃসময়ে বেগম খালেদা জিয়াকে ফেলে পালিয়ে যেতে অনেকের দ্বিধা হয়নি। একবার পেছন ফিরে দেখেননি নেত্রী কী অবস্থায় রইলেন। যারা দেশে থাকলেন, তাদের বড় একটি অংশ জমায়েত হলেন আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার বাসায়। কেউ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে, কেউ টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে, আবার কেউ মান্নান ভূঁইয়ার বাসার সভায় বক্তৃতা দিয়ে নিজেরা সাধু সাজার চেষ্টা করলেন। সব দোষ খালেদা জিয়া আর তারেক রহমানের ওপর চাপিয়ে হতে চাইলেন ধোয়া তুলসীপাতা! কিন্তু রাজনীতির কী অপার মহিমা! সেদিন দল এবং বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া লোকগুলো বিপদ কেটে যাওয়ার পর কী অসাধারণ দক্ষতায় ডিগবাজি দিয়ে স্ব-স্থানে ফিরে এলো! যে ব্যক্তিটি সিটি করপোরেশন অফিসে বসে টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সর্বপ্রথম বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছিলেন, নেত্রী মুক্ত হওয়ার পর তিনিই সবার আগে গিয়ে হাজির হলেন মইনুল রোডের বাসায়। অবশ্য এক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করেছিল খালেদা জিয়ার স্বঘোষিত এক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। যে যুবক বেগম জিয়াকে মাইনাস করার উদ্দেশ্যে প্রণীত তথাকথিত ‘সংস্কার প্রস্তাবের’ কপি নিয়ে মান্নান ভূঁঁইয়ার বার্তাবাহক হিসেবে নেত্রীর বাসায় গিয়েছিল, সে এখন দলের একজন বড় নেতা! যে ব্যক্তিটি বলেছিল, ‘বিএনপির এমপি পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে’ তিনি এখন দলটির মিডিয়া সেলের প্রধান সমন্বয়কারী। কেউ হয়তো বলবেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। সেটা অস্বীকার করছি না। রাজনীতি যখন ধান্দাবাজির মাধ্যম হয়ে ওঠে, তখন এ ধরনের ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। কথাগুলো বললাম এ কারণে, সম্পাদক নঈম নিজামের মরহুম পিতার কথা, ‘বিপদে পড়লে টের পাওয়া যায়, কে আপন কে পর’-এর উদাহরণ হিসেবে। ওয়ান-ইলেভেনের ওই বিপদের দিনে বেগম খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই টের পিয়েছিলেন কে তাঁর আপন, কে তাঁর পর। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, সেদিন যারা ঝুঁকি নিয়ে তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, পরে তারা তাঁর কাছ থেকে যথাযথ স্বীকৃতি পাননি। ওয়ান-ইলেভেনের অসম যুদ্ধের সিপাহশালা খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন দলে কেমন অবহেলিত, অপমানিত হয়েছিলেন, তার চাক্ষুষ সাক্ষী আমার মতো অনেকেই আছেন।

শেষ করার আগে জনাব নঈম নিজামের লেখার দুটি লাইন উদ্ধৃত করছি। তিনি লিখেছেন- ‘জোয়ার-ভাটার এই দেশে আমরা খুব সহজে সবকিছু ভুলে যাই। ওয়ান-ইলেভেনের দুঃসহ জীবনের কথাও এখন আর কারও মনে নেই।’ কথা চরম সত্য সন্দেহ নেই। না হলে বেগম জিয়াকে মাইনাস করতে যারা মালকোচা মেরে নেমেছিল, তারা কী করে দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করে!

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর