মঙ্গলবার, ২৮ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

উপদেশ পছন্দ করতেন না মুহাম্মদ বিন তুঘলক

হোসেন আবদুল মান্নান

উপদেশ পছন্দ করতেন না মুহাম্মদ বিন তুঘলক

একবার এক ইতিহাসের শিক্ষক বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষের মুসলিম শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধর্মপ্রাণ ছিলেন মুহাম্মদ বিন তুঘলক এবং মুঘলদের শেষ শক্তিমান সম্রাট আওরঙ্গজেব। তবে দুর্ভাগ্য হলো- এ দুজনের বিরুদ্ধেই পিতৃহত্যার অভিযোগ রয়েছে’। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের প্রকৃত পরিচয় যা-ই হোক, বিগত ৭০০ বছর যাবত (১৩২৫-২০২৪) বাংলা-ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত, আলোচিত-সমালোচিত, অবিমৃষ্যকারী, উদ্ভট, অস্থির চিত্তের শাসক হিসেবে মুহাম্মদ বিন তুঘলককেই বিবেচনা করা হয়েছে। তার নামটাই একটা বিশেষ বিশেষণে অভিষিক্ত হয়ে বাংলা ভাষায় ‘তুঘলকি কান্ড’ বাগধারায় পরিণত হয়ে আছে। ভারতবর্ষের সুদীর্ঘকালের ইতিহাসে মুসলিম শাসকদের মধ্যে মুহাম্মদ বিন তুঘলকের নাম নানা কারণে বহুল আলোচিত। বলা বাহুল্য, মুঘলদের প্রথম ১০০ বছরের গৌরবময় শাসনকালের আগে সম্ভবত গজনির সুলতান মাহমুদ, (৯৯৮-১০৩০) ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি (১১৫০-১২০৬) এবং মুহাম্মদ বিন তুঘলকই সর্বাধিক পঠিত নাম। ১২৯০ সালে দিল্লিতে তার জন্ম হয়। সে যুগের তুলনায় তুঘলক ছিলেন সবচেয়ে শিক্ষিত ও অগ্রসরমান দিল্লির সুলতান। নানা শাস্ত্র ও বিষয়ে তার অগাধ লেখাপড়া ছিল। তার বাবা গিয়াসউদ্দিন তুঘলক তাকে জুনা খান নামে ডাকতেন। মুসলিম রীতিনীতি, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, কোরআন, হাদিস, ফিকাহ শাস্ত্রে তার বিশেষ পান্ডিত্য ছিল। তিনি ছিলেন একজন কোরআনে হাফেজ। এ ছাড়া আরবি, ফারসি, উর্দু, তুর্কিশ নানা ভাষা জানতেন। বিজ্ঞান, গণিত জ্যোতির্বিজ্ঞানেও পারদর্শী ছিলেন। শতভাগ নামাজ, রোজা ও ধর্মাচারে মনোযোগী ছিলেন। ইতিহাসের গবেষকরা বলেন, তিনি আজান শুনলেই শেষ না হওয়া পর্যন্ত যে কোনো অবস্থায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। সীমাহীন মাতৃভক্তি ছিল তার। কোনো নেশাজাতীয় খাবার তাকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। মদ্যপান নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। দয়ালু, পরোপকারী, সজ্জন মানুষের এক জীবন্ত প্রতিকৃতি ছিলেন তুঘলক। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ বলেছেন, সর্বগুণের সমন্বয়ে এক অভূতপূর্ব চরিত্রের অধিকারী খোদাভক্ত, পরিশ্রমী বাদশাহর আরেক নাম মুহাম্মদ বিন তুঘলক।

২. তার রাজত্বকাল সম্পর্কে জানা যায়, তিনি ১৩২৫ থেকে ১৩৫১ পর্যন্ত অর্থাৎ মৃত্যু অবধি ক্ষমতায় ছিলেন। তবে কোনো কোনো ইতিহাসবিদ ১৩২৫ থেকে ১৩৩৮ সাল পর্যন্ত রাজত্বকালের কথা বলেছেন। যদিও তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তার বাবা গিয়াসউদ্দিন তুঘলক। যিনি বজ্রাঘাতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা যায়, এ বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান ছিলেন তার পরবর্তী সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলক। তুঘলকরা ১৩২০ থেকে ১৪১৩ পর্যন্ত মোট ৯৭ বছর দিল্লি শাসন করেছেন। মুহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন একজন আবেগতাড়িত, শিক্ষিত কিন্তু বোকা, বিনয়ী কিন্তু কঠোর, মানবিক কিন্তু হঠকারী সিদ্ধান্তের মহানায়ক। ভারতের ইতিহাস তাকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেনি। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিতে তার ধার্মিকতা, সুশাসন, জনহিতকর পদক্ষেপগুলো সবই গেছে ভুল সিদ্ধান্তের কৃষ্ণ গহ্বরের অতলে। শাসককে মাঝে মাঝে আপসকামী, নমনীয়, সহনশীল ও জনসংবেদনশীল হতে হয়। বাস্তবায়ন না করলেও শাসককে পরামর্শ শুনতে হয়। যা তার শাসনে প্রায় অনুপস্থিত ছিল। তুঘলকের চরিত্রের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল মানুষের কল্যাণ করতে গিয়ে তাদের ঘোরতর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ানো। যা তিনি আমৃত্যু নিজেকে সংশোধন করে উঠতে পারেননি। তাই ইতিহাসের পৃষ্ঠাজুড়ে মুহাম্মদ বিন তুঘলক হয়ে থাকলেন হেঁয়ালি, খামখেয়ালি, বিকৃত, ধিকৃত, অস্থির মানসিকতার এক খল শাসকের তকমা নিয়ে।

৩. তুঘলক অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন এবং ত্বরিত বাস্তবায়নের পদক্ষেপের কারণে প্রায় সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বিশেষ করে তার রাজধানী স্থানান্তর এবং মুদ্রা পরিবর্তন। এ দুটো অতীব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তিনি গণমানুষকে অবহেলা, তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞার চোখে দেখেছিলেন। যা পরবর্তীকালের ইতিহাস তাকে চিহ্নিত করে এক স্বৈরাচারী অপশাসক হিসেবে।

যেই দিল্লিতে তার জন্ম এবং পূর্বপুরুষের রাজত্ব ও জয়জয়কারের গৌরবময় অস্তিত্ব রয়েছে, ১৩২৭ সালে সেই দিল্লি থেকে ৭০০ মাইল দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যের দেবগিরিতে রাজধানী নিয়ে যান। তৎকালে রাজধানীর বহুবিধ অবকাঠামো, রাজকোষ, রাজ দফতর ইত্যাদি স্থানান্তর করা কোনো সহজ কাজ ছিল না। তখন ছিল না কোনো আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা। তবু লাখ লাখ মানুষকে বাধ্য করা হয়েছিল এদের তল্পিতল্পাসহ গরুর গাড়ি, হাতি-ঘোড়ার পিঠে করে নতুন রাজধানীতে যেতে। কেবল ভৌগোলিক কারণে রাজ্য পরিচালনার সুবিধা হবে বা বহিঃশত্রুর হাত থেকে নিরাপদ থাকবে এসব বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। দেবগিরির পরিবর্তে সেখানে তিনি রাজধানীর নাম দেন দৌলতাবাদ। তখন দিল্লি-দৌলতাবাদ ডাক পরিষেবাও চালু করেছিলেন। তবে নতুন জায়গায় পর্যাপ্ত সম্পদ ছিল না, সাম্প্রদায়িক পরিবেশও ছিল প্রতিকূলে। ইতিহাসবিদদের একটি অংশ বলেছেন, স্থানান্তরকালে অমানবিকভাবে যাতায়াতে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বিশেষ করে বৃদ্ধ ও শিশু পথে পথে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এমনকি পিছিয়ে পড়লে রাজকর্মচারী কর্তৃক আঘাত করা হতো। রাজধানীর নাম দৌলতাবাদ করারও মতবিরোধ ছিল। অথচ মাত্র সাত বছর পরই সেই রাজধানীকে পুনরায় দিল্লিতে ফেরত আনতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। তখন যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছিল এটা হিন্দু ও বিধর্মীদের শহর এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অনুকূল নয়। দিল্লির ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে মানানসই হবে না। একই সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আবার দেশের অর্থনীতিও দ্রুত ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী যে দিল্লি ভারতবর্ষের মানুষের সামগ্রিক উন্নয়ন ও শিক্ষা সংস্কৃতির নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে বর্জন করা কোনো শাসকের পক্ষে কখনো যৌক্তিক সিদ্ধান্তের বিষয় হতে পারে না।

৪. তুঘলক তার রাজত্বের প্রথমদিকেই স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার পরিবর্তে তাম্র মুদ্রার প্রচলন করেন। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নতুনত্ব দিয়ে তিনি চমক সৃষ্টি করেছিলেন। তাকে ইতিহাসবিদগণ বলেছেন, Prince of moneyers বা তঙ্কা নির্মাতার রাজা। রাজধানী স্থানান্তর করার কারণে বিপুল আর্থিক ব্যয় হওয়ায় তা মোকাবিলার জন্য এবং স্বর্ণ রিজার্ভ ও রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে নিরাপদ রাখার নিমিত্ত তিনি তা চালু করেছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে এটা বৈপ্লবিক হলেও পরে তার ইতিবাচক প্রভাব ধরে রাখতে পারেননি। তাছাড়া তাম্র মুদ্রা প্রচলনের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সর্বত্র অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং জাল মুদ্রায় বাজার সয়লাব হয়ে ওঠে। জনমনে বিরূপ ধারণা জন্ম নিতে থাকে, এমনকি বিনিময় ব্যবস্থায় নেমে আসে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য। তবে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি এর লাগাম টেনে ধরেছিলেন এবং পুনরায় স্বর্ণ মুদ্রা চালু করেছিলেন। তিনি তার সিদ্ধান্তে অবিচল, অটল থাকতে পারেননি। যদিও ইবনে বতুতাসহ অসংখ্য গবেষক ও ইতিহাসবিদের মতে তুঘলক যুগান্তকারী এবং নজিরবিহীন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তার পক্ষে-বিপক্ষে অগণিত মতামত রয়েছে। উল্লেখ্য, ইবনে বতুতা ১৩৩৩ সালে ভারতে এসে টানা আট বছর তুঘলকের অধীনে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বলেছেন, তুঘলক অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি উদার, মানবিক ও সহনশীল ছিলেন।

৫. উন্নত ভূমি বা যমুনা নদী বিধৌত এলাকার উর্বর ভূমির ওপর হঠাৎ করে ২০ ভাগ কর আরোপ করেও তিনি বিপাকে পড়েছিলেন। এটাকে ইতিহাসে ‘দোয়াব’ এলাকায় করভার স্থাপন করাকে বোঝায়। এক পর্যায়ে তাকে তা-ও প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছিল। কথিত আছে যে, মুহাম্মদ বিন তুঘলক সেকালেই হিন্দু ধর্মের নিষ্ঠুরতম ‘সতীদাহ প্রথা’ বিলুপ্ত করার চিন্তাভাবনা করেছিলেন। সময়ের অভাবে বা হিন্দু রাজা ও সম্প্রদায়ের আন্দোলনের আশঙ্কায় তখন সেদিকে আর যাননি।

এ কথা সত্যি যে, অনেক জননন্দিত কাজ করেও মুহাম্মদ বিন তুঘলক গণমানুষের সমর্থন পাননি। কোনো বদ চরিত্র, অপরাধী বা প্রজাবিরোধী অন্যায় কাজ না করেও তিনি ইতিহাসের অমোঘ কাঠগড়ায় নিন্দিত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। ইতিহাস বলে, জীবদ্দশায় সাম্রাজ্যে ভাঙন দেখা দিলে ১৩৫১ সালে মুহাম্মদ বিন তুঘলক সিন্ধু প্রদেশের থাট্টা অঞ্চলে সুমরু গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে মাত্র ৬১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। আবার এমন জনশ্রুতিও আছে যে, অচেনা কোনো এক সামুদ্রিক মাছ খেয়ে এর বিষক্রিয়ায় নাকি তার মৃত্যু হয়েছিল। সেই মাছ ভক্ষণ না করার জন্য তার সভাসদগণ বারণ করলেও তিনি তা শোনেননি। দিল্লির তুঘলকাবাদ ফোর্টে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।

লেখক : গল্পকার ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর