বুধবার, ২৯ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

সাদা মানুষের কালো ধান্দা!

আবদুল মান্নান

সাদা মানুষের কালো ধান্দা!

পশ্চিমের (ইউরোপ) সাদা মানুষের এশিয়া, আফ্রিকা আর ল্যাটিন আমেরিকার শোষণ শাসনের ইতিহাস কম করে হলেও তিন শত বছর পুরনো। শুরুটা হয়েছিল অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের সময়। শিল্প বিপ্লব বিশ্বের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছিল। এই বিপ্লবের আগে বিশ্বে দুটি অর্থনৈতিক পরাশক্তি ছিল-ভারত (বাংলা-আসাম-বিহার-ওড়িশা) ও চীন। বলা হয় সেই সময় বিশ্বের গড় দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২৩ ভাগ উৎপাদন হতো ভারতে। প্রায় দুই শত বছর ব্রিটেন ভারতে শোষণ ও শাসন শেষে যখন ১৯৪৭ সালে ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হয় তখন জিডিপিতে ভারতের অবদান চার শতাংশে নেমে আসে। ব্রিটেন বা ইংল্যান্ডের পথ ধরে ইউরোপের অন্যান্য দেশ বিশ্বকে পরবর্তী তিন শত বছর শোষণ শাসন করেছে। বলা হয়, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ (এরা ইউরোপের) বাকি দুই-তৃতীয়াংশকে শোষণ শাসন করে ইউরোপে শহর নগর বন্দর গড়েছে। সপ্তদশ শতকে প্রথম সাদা চামড়ার ইংরেজ ও ফরাসিরা উত্তর আমেরিকায় বাণিজ্যের খোঁজে যাওয়া শুরু করে। উত্তর আমেরিকায়ও এই সাদা চামড়ার মানুষ এক শত বছর শোষণ শাসন করেছে। তাদের কাঁচামাল দিয়ে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের যাত্রা শুরু হয়েছিল যা ভারত বা বাংলার সম্পদ লুণ্ঠনের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা লাভ করে। ইউরোপের এই দেশগুলো আমাদের প্রজন্মকে শিখিয়েছে ‘আফ্রিকা একটি অন্ধকার মহাদেশ’, যদিও এই মহাদেশ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী দেশ। মরক্কো বা ইথোপিয়া বিশ্ব সভ্যতায় শিক্ষাসহ সভ্যতার যেসব উপকরণ জোগান দিয়েছে তা পশ্চিমা দুনিয়া এখনো কল্পনা করতে পারে না। বিশ্ব সভ্যতা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মিসরের কাছে ঋণ শোধ হওয়ার নয়।

এই সাদা চামড়ার ইউরোপীয়রাই তো বিশ্বকে উপহার দিয়েছে মানব পাচার, মাদকের ব্যবসা আর কৃতদাস প্রথা। শিখিয়েছে ফেরেববাজি আর চাতুর্যের মাধ্যমে অন্য দেশ দখলের কায়দা-কানুন। পরপর দুটি যুদ্ধ লাগিয়ে তারা বিশ্বে হাজার লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে, নগর জনপদ ধ্বংস করেছে। কোনো কালো বা বাদামি মানুষের দেশ তো এসব করেনি। সাদা আর কালোর মধ্যে বৈষম্য এই সাদা মানুষের একটি অনন্য অবদান। যুক্তরাষ্ট্রে শিকারের জন্য যখন বন্দুকের লাইসেন্স দেওয়া শুরু হয় তাতে যে সব বস্তু শিকার করা যাবে সেই তালিকার শীর্ষে থাকত পালিয়ে যাওয়া কৃষ্ণাঙ্গ কৃতদাস যাদের ইউরোপের সাদা বা শ্বেতাঙ্গ দাস ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের জ্ঞাতিভাইদের কাছে বিক্রি করতেন। এশিয়া আফ্রিকার সম্পদ লুণ্ঠন করে তা সহজে নিজ দেশে পাচার করার জন্য বাদামি ও কৃষ্ণাঙ্গদের দেশ দখল করে শ্বেতাঙ্গদের শোষণ আর লুণ্ঠনের তিন শত বছরের ইতিহাস এখন এক মহাকাব্য। লুটপাট করা সম্পদ নিজ দেশে সহজে পাচার করার জন্য ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি ফরাসিরা বানিয়েছিল সুয়েজ খাল আর বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে পানামা খাল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে প্রত্যাশিতভাবেই শুরু হয় ইউরোপীয় উপনিবেশগুলোর স্বাধীনতা লাভ। আফ্রিকাতে তা শুরু হতে একটু বেশি সময় লাগে। এক বেলজিয়ামই আফ্রিকার যত সম্পদ লুট করেছে আর মানুষ হত্যা করেছে সম্ভবত সব ইউরোপীয় দেশ মিলে তা করেনি। গত শতকের পঞ্চাশ দশকের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে অস্ত্র আর কুটচালের মাধ্যমে শুরু হয় নয়া ঔপনিবেশবাদ। সহজ পথে অন্যের সম্পদ লুট করে কীভাবে সমৃদ্ধশালী হওয়া যায় তা যুক্তরাষ্ট্র তাদের ইউরোপীয় ভায়রা ভাইদের দেখে আফসোস করেছে কেন তারা এই সহজ পথে ধনসম্পদের মালিক হতে পারেনি। যুদ্ধ শেষে তাদের সেই সুযোগ এসে গেল তবে তা অস্ত্রের মাধ্যমে তেমন একটা নয়। শোষণের জন্য তারা নতুন অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয় ষড়যন্ত্র আর দেশে দেশে গণতন্ত্রের নামে তাঁবেদার সৃষ্টি করে। এই কাজে বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করা হয় বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। এ কাজকে আরও নিবিড়ভাবে দেখভাল করার জন্য পরে সৃষ্টি করা হয় আরও বিশেষ কিছু সংস্থা যাদের অন্যতম ‘এনইডি’। এদের লেবাসে লেখা থাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও তাকে শক্তিশালী করার জন্য অকাতরে সহায়তা করাই তাদের লক্ষ্য। সাধারণ মানুষ তাদের আসল মতলব কখনো বুঝতে পারে না। এসব তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গণমাধ্যমেই নানা সময়ে বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে এই রকম বিদেশি সংস্থার অর্থায়নে চলে কম করে হলেও অর্ধডজন প্রতিষ্ঠান, আছে আরও সুশীল নামের কয়েক ডজন ব্যক্তি। আছে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আর ইউটিউবার। তারা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নিয়মিত গণতন্ত্র, মানবাধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আর দুর্নীতি নিয়ে দেশের জনগণকে সবক দিয়ে থাকেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নয়া ঔপনিবেশবাদ শুরু হয়েছিল ১৯৫৩ সালে ইরানের নির্বাচিত সরকার ও প্রধানমন্ত্রী ড. মোসাদ্দেককে উৎখাতের মধ্য দিয়ে। তার ‘অপরাধ’ যুক্তরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানিগুলোর ইরানের প্রাকৃতিক সম্পদ লাগামহীন লুটপাট বন্ধ করে দেওয়ার জন্য তিনি সব তেল আর গ্যাস ক্ষেত্র জাতীয়করণ করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু একই কাজ করেছিলেন তবে তাঁকে তাঁর নিজের জীবন দিয়ে এর মূল্য দিতে হয়েছিল। অবশ্য সেখানে অন্য কারণও ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের এই নয়া ঔপনিবেশবাদের শিকার হয়ে কত নগর বন্দর দেশ যে ধ্বংস হয়েছে, কত মানুষের প্রাণ গিয়েছে তার সঠিক হিসাব বের করা দুরূহ। ধ্বংস হয়েছে ভিয়েতনাম, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, লেবাননের মতো সমৃদ্ধশালী দেশ ও জনপদ। বিরামহীনভাবে লুট হয়েছে ইন্দোনেশিয়া, ইরান, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ। এই নয়া ঔপনিবেশিক শক্তির কথা মতো না চলার কারণে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে এক ডজনেরও বেশি সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান। নিহত হয়েছেন প্রায় সমান সংখ্যক রাষ্ট্রীয় নেতা। তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তাদেরই তাঁবেদার কোনো সেনাশাসক বা একনায়ক। ইন্দোনেশিয়া, চিলি, নিকারাগুয়া, হাইতি, মিসর, বাংলাদেশ, সাইপ্রাস, পূর্ব তিমুর, পাকিস্তান, পানামা, আফগানিস্তান, মিয়ানমার, লেবানন, ইরানসহ আরও অনেক দেশ এই তালিকাভুক্ত।

বাংলাদেশ কখনো এই নয়া ঔপনিবেশিক শক্তির দৃষ্টির বাইরে যায়নি যার অন্যতম কারণ তার ভৌগোলিক অবস্থান। এ অবস্থানগত কারণে শত শত বছর ধরে এই অঞ্চল আরব ও পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পূর্ব ভারতে তাদের প্রবেশ এই অঞ্চল দিয়ে। বাংলাদেশের সঙ্গে যখন আন্তর্জাতিক আদালতে ভারত আর মিয়ানমারের সমুদ্রসীমা বিষয়টি সুরাহা হয়ে গেল তখন বাংলাদেশের প্রতি বিভিন্ন পরাশক্তি ও ভারতের আকর্ষণ আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। একেকটি পরাশক্তির একেক উদ্দেশ্য। ভারতের জন্য তাদের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশ সব সময় তাদের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য নিরাপদ অস্ত্র চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে যা এখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণিত। সব পরাশক্তি চায় দেশ-মহাদেশ ছাড়াও বিশ্বের সমুদ্র-মহাসমুদ্রে তাদের আধিপত্য বজায় থাকুক। তা করতে হলে প্রয়োজন এসব জলরাশির সীমানা ঘেঁষে যেসব দেশের অবস্থান তাদের ওপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করা। বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় ভৌগোলিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই সব পরাশক্তির কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র পুরো ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখার জন্য এই অঞ্চলের অধিকাংশ দেশেই তাদের সেনা ও নৌঘাঁটি নির্মাণ করেছে। বর্তমানে এমন ঘাঁটির সংখ্যা প্রায় ৮০টি যেখানে প্রায় চার লাখ মার্কিন সেনা সদস্য মোতায়েন আছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে তাদের সব চেয়ে বড় প্রতিরক্ষা স্থাপনা জাপানে। সেই দেশে ওকিনাওয়া দ্বীপটি বস্তুত পক্ষে মার্কিনিদের দখলে।

এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিরঙ্কুশ করার জন্য ২০০৭ সালে তাদের উদ্যোগে গঠিত হয় চারদেশীয় নিরাপত্তা জোট ‘কোয়ড’। এতে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আছে জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশের অবস্থানগত কারণে যুক্তরাষ্ট্র সব সময় প্রত্যাশা করেছে এই দেশ এই জোটে যোগ দিক। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই বাংলাদেশের ওপর এই জোটে যোগ দেওয়ার জন্য নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয় যা বাংলাদেশ এতদিন পর্যন্ত অত্যন্ত সফলভাবে প্রতিহত করতে পেরেছে। ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’-এ পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশের আস্থা। এমন একটি জোটে যোগ দেওয়ার অর্থই হচ্ছে চীন বা রাশিয়ার মতো পরাশক্তির রোষানলে পড়া। অন্যদিকে কখনো যদি যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে নিয়ে চীনের সঙ্গে যুদ্ধ জড়িয়ে পড়ে তখন তো এই জোটের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাকতে হবে যার অর্থ চীনের প্রতিপক্ষ হয়ে যাওয়া। চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী। বাংলাদেশ কেন এই ঝুঁকি নেবে? ২০২৩ সালে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের পরম মিত্র দেশ জাপান সফরে যাওয়ার আগে এই অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থানের রূপরেখা ঘোষণা করে বলেন, এটি হবে সবার জন্য উন্মুক্ত অঞ্চল, কারও একক আধিপত্য থাকা উচিত নয়। বলা বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের এই অবস্থানে খুব বেশি খুশি নয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র কখনো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসুক বা থাকুক চায়নি। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় না ফেরার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ গ্যাস রপ্তানি করতে চায়নি বলে শেখ হাসিনা শুরু থেকে বলে আসছেন যা আজ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র তেমন জোরালোভাবে প্রতিবাদ করেনি। শেখ হাসিনাকে বশে আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সব সময় চেষ্টা করে যাচ্ছে যেমনটি ছিল বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে। তাঁর সময় ছিল হেনরি কিসিঞ্জার আর এখন এই দায়িত্ব নিয়েছেন ডোনাল্ড লু, যার সরকার উৎখাতের দক্ষতার একটি খ্যাতি আছে বলে জানা যায়। গত বছর দুয়েকের তার কর্মকাণ্ডে মনে হয়েছে এমন একটি মিশন নিয়ে তিনি ঘন ঘন বাংলাদেশ সফর করছেন। ওপরে ওপরে সব ঠিক হয়ে গেছে দেখালেও যুক্তরাষ্ট্রের এসব কর্মকর্তাকে বিশ্বাস করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। গত ২৩ তারিখ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪-দলীয় নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেন, ‘একজন সাদা সাহেব বঙ্গোপসাগরে একটি বিমান ঘাঁটি করার সুযোগ দিতে অনুরোধ করেছিলেন এবং বলেছিলেন তারা আমার ক্ষমতায় থাকাকে মসৃণ করে দেবেন।’ শেখ হাসিনা স্পষ্ট ভাষায় না বললেও বুঝতে অসুবিধা নেই এই বিমান ঘাঁটির সম্ভাব্য স্থান সেন্টমার্টিন দ্বীপ যার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি স্বাধীনতার পর থেকে। সাদা মানুষটি কে তা প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার না করলেও তিনি কে তা বুঝতে তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। এত সব চাপের মুখেও শেখ হাসিনা মাথা নত করেননি। তারপর শুরু হলো সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদকে নিয়ে নতুন খেলা।

২০১৮ সালের ২৫ জুন থেকে ২৪ জুন ২০২১ পর্যন্ত জেনারেল আজিজ সেনাপ্রধান ছিলেন। অনেকের প্রশ্ন তাকে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কি কোনো বিশেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল? তাকে দুর্বল করতেই কি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ শাখা এনইডির অর্থায়নে স্বেচ্ছানির্বাসিত তাসলিম খালিল ও ডেভিড বার্গমনের নির্মিত এক ঘণ্টার কল্পকাহিনি ‘অল দ্য প্রাইমমিনিস্টার্স ম্যান’ যা কাতার ভিত্তিক ‘আলজাজিরা’ টিভিতে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রদর্শিত হয়েছিল?

নির্মিত কল্পকাহিনির মূল বিষয় ছিল জেনারেল আজিজের ক্ষমতার ‘অপব্যবহার ও দুর্নীতি’। আলজাজিরা এই কল্পকাহিনির প্রচারিত হওয়ার কিছু আগে ২৯ জানুয়ারি ১৫ দিনের সফরে জেনারেল আজিজ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আমন্ত্রণে সে দেশ সফর করেন। এই সময় জেনারেল আজিজ জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের সঙ্গে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের সদস্যদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েও আলোচনা করেন। জেনারেল আজিজ যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে কি তিনি সেই দেশের কোনো প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার কারণে ১ তারিখ আলজাজিরা সেই কল্পকাহিনি প্রচার করে তাকে দুর্বল করতে চেয়েছিল? কোনো কিছুই খাটো করে দেখা উচিত নয়। এই যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই তো ইন্দোনেশিয়ার জেনারেল সুহার্তো, চিলির জেনারেল পিনোসে, পাকিস্তানের জেনারেল আইউব খান, মিসরের জেনারেল সিসি আর বাংলাদেশের জেনারেল জিয়া তৈরি হয়েছিল। এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন একমাত্র জেনারেল আজিজ। জেনারেল আজিজ ও তার পরিবারের ওপর গত ২০ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের দেশে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আলজাজিরা টিভিতে জেনারেল আজিজের যে সব ‘অপরাধ’ বর্ণনা করা হয়েছিল ঠিক একই ‘অপরাধে’ জেনারেল আজিজ ও তার পরিবারের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা।

সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে। শেখ হাসিনাকে চাপ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চীন ও রাশিয়া থেকে দূরে রাখতে চায়। বর্তমানে বেশ কিছু বাণিজ্য স্বার্থ এর সঙ্গে জড়িত হয়েছে তার একটি যুক্তরাষ্ট্র হতে বিমান বাংলাদেশের জন্য বোয়িং ক্রয়। বাংলাদেশ ফ্রান্স থেকে এয়ারবাস ক্রয়ের আগ্রহ দেখিয়েছে তবে তা চূড়ান্ত হয়নি। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীন ও ভারতের বেশ কিছু তেল উত্তোলনকারী কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তেমন সুখকর নয়। এরই মধ্যে যে সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের ‘এনইডি’র মতো প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে চলে তারা পরিষ্কার করে ঘোষণা করেছেন, ‘আরও আজিজ আসছে’। তাদের অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তবে দেশের মানুষ এখনো শেখ হাসিনার সাহস ও দৃঢ়তার ওপর আস্থা রাখে। তবে জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশ তার নিজস্ব স্বার্থে তা তদন্ত করে দোষী প্রমাণিত হলে তারও শাস্তি হওয়া উচিত। কোনো ব্যক্তিই আইনের ঊর্ধ্বে থাকা উচিত নয়। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। দেশের মানুষ তার বাস্তবায়ন দেখতে চায়। প্রধানমন্ত্রীর ‘সাদা’ মানুষটি নিয়ে দেশের মানুষের কৌতূহল আছে। সত্য প্রকাশিত হোক।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

সর্বশেষ খবর