বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

নিউইয়র্কে বাংলা কালচার

তসলিমা নাসরিন

নিউইয়র্কে বাংলা কালচার

কিছুদিন আগে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হলো সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্র উৎসব। আয়োজক ছিলেন বাংলাদেশি অভিবাসী। আর এই তো নিউইয়র্কে শেষ হলো বাংলা বইমেলা এবং সাহিত্যানুষ্ঠান। এরও আয়োজক বাংলাদেশি অভিবাসী। দেখে মনে হয় আমেরিকায় বাঙালিরা সবাই বোধহয় খুব প্রগতিশীল, সবাই বোধহয় খুব সাহিত্যপ্রেমী বা সংস্কৃতিপ্রেমী। কিন্তু আসলেই কি তাই?

ঢাকা আর নিউইয়র্কে পার্থক্য আছে নিশ্চয়ই। বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রে যে পার্থক্য, সে পার্থক্যও ঢাকা আর নিউইয়র্কে। বাংলাদেশ থেকে নানা ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র উন্নত এবং সভ্য বলে বাংলাদেশ থেকে মানুষ যে কোনও উপায়েই যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেয় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বাস করার জন্য। যারা মৌলবাদী মুসলিম, ধর্মে আকণ্ঠ বুঁদ হয়ে আছে, ইহুদি নাসারাদের ঘৃণা করে, অকথ্য ভাষায় তাদের গালাগালি করে, তারাও সুযোগ পেলেই আমেরিকায় বাস করার ফন্দি ফিকির খোঁজে। তারা ইচ্ছে করলেই আরব দেশে পাড়ি দিতে পারে, কিন্তু পাড়ি দেয় না। স্থায়ী বসবাসের জন্য খ্রিস্টান-ইহুদি-নাস্তিক অধ্যুষিত দেশই তাদের পছন্দ। কেউ কেউ তো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও পাশ্চাত্যের দেশগুলোয় ঢুকতে চেষ্টা করে। রাতের অন্ধকারে ডিঙ্গি নৌকোয় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছোয়। নৌকোডুবিতে প্রচুর লোক প্রাণ হারায়। তারপরও কিন্তু ডিঙ্গি নৌকো সাগরে ভাসাতে তারা দ্বিধা করে না। আরব দেশে হজ করতে গেলেও, আরব দেশের পোশাক পরলেও, আরবদের ভাষা আর আচার-আচরণ রপ্ত করার চেষ্টা করলেও, আরবদের মহামানব জ্ঞান করলেও, আরব দেশে বাস করার জন্য বাংলাদেশের কেউ মরিয়া নয়। বরং আরব দেশে শ্রমিকের কাজ করতে যাওয়া পুরুষেরা দেশে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে, আর বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর চাকরি করা নারীরা তো জীবন বাঁচাতেই দেশে ফিরে যায়, অনেকে অবশ্য লাশ হয়ে ফেরে।

বাংলাদেশিদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকা বিরাট এক আকর্ষণ। জীবন তাদের ধন্য হয় আমেরিকার নাগরিকত্ব পেলে। এদেশে চাকরি করার, ব্যবসা করার, ধর্ম পালন করার, বাচ্চাদের ফ্রিতে স্কুলে পড়াবার সুযোগ পায়, টাকাপয়সা না থাকলে ফুড স্ট্যাম্প পায়, ফ্রি চিকিৎসা পায়- ওষুধপত্র পায়, দরকারে নার্স পায়, আয়া পায়। সবচেয়ে বড় যেটা পায়, সেটার নাম মানবাধিকার। যে মানবাধিকার বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। এমন স্বর্গরাজ্যে বাস করার সুখ কেউ খোয়াতে চায় না। আমেরিকার আদর্শে একবিন্দু বিশ্বাস না করেও আমেরিকায় বুক ফুলিয়ে বাস করার লোক কম নেই।

আমেরিকায় বাংলাদেশি অভিবাসীদের মধ্যে উদার এবং মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী মানুষ যে নেই, তা নয়। আছে, তবে সবচেয়ে বেশি আছে সংকীর্ণমনা, রক্ষণশীল, মৌলবাদী, ধর্মান্ধ। পুরুষেরা স্ত্রী-কন্যাদের বোরখা পরতে বাধ্য করছে। নিজেরাও বারবার মসজিদে দৌড়োচ্ছে। বাংলাদেশের হিন্দুরা যারা স্থায়ীভাবে আমেরিকায় বাস করছে, বাংলাদেশে যেটা পারতো না, সেটা আমেরিকায় পারছে। মন্দির গড়ে তুলছে এবং সাধ মিটিয়ে পুজো-আর্চা করছে।

অবসরে বাংলাদেশি অভিবাসীরা ব্যস্ত থাকে বাংলাদেশ চর্চায়। বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতি চর্চায়। সংস্কৃতিপ্রেমীরা বাংলাদেশের সংস্কৃতির খবর রাখছে। সাহিত্য যারা করে, তারা বাংলাদেশের সাহিত্যের খবর রাখছে। আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে তারা আমেরিকায় ভোট দেয় বৈকি, কিন্তু অধিকাংশেরই আমেরিকার ইতিহাস, ভূগোল, আমেরিকার নারীবাদীদের এবং মুক্তচিন্তকদের সংগ্রাম, বর্ণবাদীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, গণতন্ত্রের দীর্ঘযাত্রা, মানবতাবাদীদের অবদান, বিজ্ঞানের অগ্রগতি, আমেরিকার শিল্প সাহিত্য সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান নেই। তারা আমেরিকায় যুগের পর যুগ বাস করেও সত্যিকার আমেরিকান হতে পারে না। দিন রাত তাদের টেলিভিশনে চলছে বাংলাদেশের সিনেমা বা নাটক, হিন্দি সিনেমা বা হিন্দি সিরিয়াল বা ইন্ডিয়ান রিয়ালিটি শো। ঘরে যদি সংবাদপত্র থাকে, তা নিউইয়র্ক টাইমস বা ওয়াশিংটন পোস্ট বা এল এ টাইমস নয়, থাকে আমেরিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশের খবর ছাপানো বাংলা সংবাদপত্র।

তারা আমেরিকায় বাস করেও আমেরিকায় বাস করে না। তারা আসলে আমেরিকায় যুগের পর যুগ বাস করেও মনে মনে বাংলাদেশেই বাস করে। বাংলাদেশে জন্ম, বাংলাদেশে শৈশব কৈশোর, সুতরাং বাংলাদেশের প্রতি আলাদা টান থাকবেই, বাংলাদেশকে ভালোবাসবেই, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশকে ভালোবাসা, আর অতীতে পড়ে থাকা এক নয়। যে মানসিকতা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে তারা বেরোয়, কোনও উন্নত আর সভ্য দেশে দীর্ঘকাল বাস করার পর তাদের মানসিকতা কি সামান্যও উন্নত হয়, তারা কি আগের চেয়ে সভ্য হয় আরও? তারা কি আগের চেয়ে বেশি উদার, আগের চেয়ে বেশি মানবিক হতে পারে? বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করা শেখে? এসবের উত্তর কিন্তু একটিই, না। অধিকাংশই পারে না। অধিকাংশের সেই চেষ্টা নেই। তাই হালাল দোকানে ভরে যায় বাঙালি এলাকা, মাথায় টুপি আর টাকনুর ওপর পাঞ্জাবি পরা লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে, নিকাব পরা নারী এবং শিশুদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ধর্মান্ধের সংখ্যা বাড়ে, যারা বিশ্বাস করে তাদের ধর্ম অন্যান্য সব ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, বিশ্বাস করে মোহাম্মদ আতা এবং তার দল টুইন টাওয়ার গুঁড়িয়ে দিয়ে চমৎকার কাজ করেছে, কেউ কেউ তো এমনও স্বপ্ন দেখে যে মুসলমানে ভরে গেছে পাশ্চাত্যের দেশগুলো, পৃথিবীটা শুধু মুসলমানের পৃথিবী হয়ে উঠেছে।

নতুন প্রজন্মের মধ্যে আমেরিকান হওয়ার প্রবল ইচ্ছে। নিজের পিতামাতার বাংলাদেশি পরিচয় নিয়ে তারা বাইরে বিব্রতবোধ করে। ওদিকে বাড়িতে ইসলাম দ্বারা মগজধোলাইয়ের কারণে কেউ কেউ আবার অতিমাত্রায় নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম ভাবতে শুরু করে, অন্যান্য দেশের মুসলিমদের তড়িঘড়ি নিজের লোক ভেবে নেয়। আবার এও ঠিক, আমেরিকায় জন্ম হওয়া নতুন প্রজন্মের অনেকে বাংলায় কথা বলছে, বাংলায় গান গাইছে, এ অবশ্য সম্পূর্ণ নির্ভর করছে মা বাবা কতটা বাংলা সংস্কৃতি ভালোবাসেন, কতটা পরিশ্রম করেন পুত্র কন্যাদের বাংলা সংস্কৃতি শেখাতে, তার ওপর।

বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত বাঙালিরাই বাংলা নাচ গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, নিউইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে শতকণ্ঠে বাংলা নববর্ষ পালন করে। রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তীর উৎসবও হয়ে উঠছে ঝলমলে। দিন দিন বাড়ছে বাংলা সংস্কৃতির চর্চা, একই সঙ্গে বাড়ছে ধর্মান্ধতা, অনুদারতা, অসহিষ্ণুতা। সে কারণেই আমি নিউইয়র্কে থেকেও নিউইয়র্কের বাংলা অনুষ্ঠানগুলোয় যাই না, কারণ আমি সেসব অনুষ্ঠানে নিষিদ্ধ। উদার লোকেরা আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে চাইলেও সংখ্যাগুরু অনুদার বাক স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ নারীবিদ্বেষীরা খড়গহস্তে দাঁড়িয়ে যায়। সে কারণে সাবিনা ইয়াসমিনের গানের অনুষ্ঠানে যে কেউ টিকিট করে ঢুকতে পেরেছে, শুধু আমি পারিনি। আমার জন্য ছিল নিষেধাজ্ঞা। পৃথিবীর প্রখ্যাত গণতন্ত্রে বাস করে গণতন্ত্রের সব সুবিধে নিজেরা নিয়ে গণতন্ত্র আর বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। গত বছর নিউইয়র্ক বইমেলা আর সাহিত্যানুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে চেয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানাননি। কেন জানাননি, সে কথা অবশ্য আমাকে বলেননি। আমি বুঝে নিয়েছিলাম অনুষ্ঠানের আয়োজকদের মধ্যেই নিশ্চয়ই সেই বাক স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি উপস্থিত। তাঁরা সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, কিন্তু তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতায়, উদারতায়, সহিষ্ণুতায়, মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী নন। এঁদের দেখলে যে কেউ মনে করতে পারে এঁরা প্রগতিশীল লোক। আসলে তা নন। সত্যিকারের প্রগতিশীল লোক কাউকে ভিন্নমত প্রকাশ করতে বাধা দেয় না, কারও পথরোধ করে না, কাউকে কোনও অনুষ্ঠানে প্রবেশ করতে বাধা দেয় না। ভিন্নমতকে পছন্দ না করতে পারে, কিন্তু ভিন্নমতের কারণে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করে না।

বাংলাদেশিরা আমেরিকার বিভিন্ন শহরে এক একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলেছে। পাশ্চাত্য তাদের জীবন যাপনে, ভাবনা চিন্তায় কোনও বদল আনতে পারেনি। তারা এখনও জাত-পাতে বিশ্বাসী, কুসংস্কারে বিশ্বাসী, এখনও পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী, তারা এখনও দেশীয় যে নারীবিরোধী ঐতিহ্য, সেই ঐতিহ্যকে বঙ্গোপসাগরের কিনার থেকে বয়ে নিয়ে গেছে অতলান্তিক আর প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে। অভিবাসীরা হয়তো যুগে যুগে এমনই হয়, তারা যে মাটি থেকে আসে, সে মাটির কালচারকে লালন করে, জীবিকার প্রয়োজনে অন্য কালচারের যেটুকু দরকার সেটুকু গ্রহণ করে, কিন্তু চিন্তার দারিদ্র্য থেকে রেহাই পেতে কোনও দর্শন তাদের আর শেখা হয় না। তারা শুধু যা শিখেছিল দেশে, তারই চর্চা করে চলে বাকি জীবন।

আমি বলছি না, নিউইয়র্কের বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির কর্ণধারেরা শুধু আমাকেই নিষিদ্ধ করেছেন। হয়তো আরও লেখক-শিল্পীকে, যাদের নিয়ে বিতর্ক হয়, নিষিদ্ধ করেছেন বা করবেন। এবং আমন্ত্রিত পুরস্কৃত লেখক-বুদ্ধিজীবীরা একটি শব্দও উচ্চারণ করবেন না নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে। এভাবেই বছরের পর বছর বাংলা বইমেলা চলবে, ভিন্নমত প্রকাশের অধিকারকে লঙ্ঘন করে চলবে। এই কারণেই বলি ঢাকায় আর নিউইয়র্কে পার্থক্য থাকলেও, ঢাকার আর নিউইয়র্কের বাঙালির মধ্যে পার্থক্য নেই। ঢাকার বইমেলার অনুষ্ঠানে যেমন আমার প্রবেশের অধিকার নেই, নিউইয়র্কের বইমেলার অনুষ্ঠানে তেমন আমার প্রবেশের অধিকার নেই। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে গেলেও হীনমন্য-বাঙালি হীনমন্যই থেকে যায়।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর