বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

ভোটযুদ্ধে কলকাতা মহানগর

জয়ন্ত রায় চৌধুরী

ভোটযুদ্ধে কলকাতা মহানগর

কলকাতা মহানগরে ভোটযুদ্ধের দিন যত এগিয়ে আসছে, ততই শহরের তিনটি লোকসভা কেন্দ্রে তিন প্রধান প্রতিপক্ষ- তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি আর সিপিআই(এম)-কংগ্রেস জোটের প্রচারের লড়াই তুঙ্গে উঠছে। সন্ধে নামার মুখে প্রচারে বেরিয়েছেন দক্ষিণ কলকাতা আসনে সিপিআই(এম)-এর নজরকাড়া প্রার্থী সায়রা শাহ হালিম। রাসবিহারি এভিনিউ ধরে চলেছে তাঁর নির্বাচনি প্রচারের মিছিল। প্রার্থী নিজে গাড়িতে সওয়ার। তরুণ ও মধ্যবয়সী পার্টিকর্মীরা লাল ব্যানার নিয়ে গোটা রাস্তাটা স্লোগানে স্লোগানে ভরিয়ে তুলেছেন। স্লোগানের তালে তালে বাতাসের বুকে ওঠানামা করছে তাঁদের মুষ্টিবদ্ধ হাত। অন্যদিকে উত্তর কলকাতার গিরিশ পার্কের এক তস্য গলিতে ভোটারদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে করতে হেঁটে চলেছেন ঊনআশি বছরের প্রবীণ কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য। তাঁর দুই ধারে কংগ্রেস ও বাম সমর্থকদের ভিড়। বয়সের ভার সত্ত্বেও ঝড়-বৃষ্টি কিংবা তাপপ্রবাহের চোখরাঙানিকে পাত্তা না-দিয়ে নাছোড় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ভট্টাচার্য মশাই।

এক সময় কলকাতাকে বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মহানগরী। বাইরের দুনিয়ার কাছে কিংবা এই একুশ শতকের ডিজিটাল ভারতের কাছেও কলকাতার সে গুরুত্ব অনেক ম্লান হয়ে এসেছে। কিন্তু তবু এই শহর আজও পশ্চিমবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র। তাই কথায় বলে, কলকাতাকে যারা জয় করতে পারে, তারাই শেষমেশ বাংলার মসনদও দখল করে। এবারের নির্বাচনে তৃণমূল কিছুটা উৎকণ্ঠায় ভুগছে, তাদের সামনে শক্ত প্রতিপক্ষ বিজেপি। অন্যদিকে নতুন করে লড়াইয়ে ফিরেছে সিপিআই(এম)। তাদের আশা, হালিম কিংবা যাদবপুরের প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্যের মতো তরুণ তথা নতুন মুখেরা তাদের আবার কলকাতা শহরের দখল ছিনিয়ে আনতে সাহায্য করবেন।

“দেখতেই পাচ্ছেন যে বামেরা নতুন করে লড়াইয়ে ফিরেছে। আমাদের মিছিলে-জমায়েতে রেকর্ড ভিড় হচ্ছে। আমাদের বহু পুরনো ভোটার আবার আমাদের দিকে ফিরে আসছেন। দক্ষিণ কলকাতা আর যাদবপুরে আমাদের ভালো ফল করার কথা”, বলছিলেন হালিম। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বামেরা যাদবপুরে পেয়েছিল ২১ শতাংশ ভোট। কিন্তু সেবার দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রে তাদের প্রাপ্ত ভোট ১২ শতাংশয় নেমে যায়, আর উত্তর কলকাতায় তাদের ভোটের হার নেমে গিয়েছিল ১০ শতাংশেরও নিচে। তার কারণ তাদের ভোটারদের একটা বড় অংশ সে সময় বিজেপির দিকে চলে গিয়েছিল।

তবে বছর দুয়েক আগে বালিগঞ্জ বিধানসভা আসনের টানটান উপনির্বাচনে সায়রা হালিম দারুণভাবে নিজের দলকে লড়াইয়ে ফিরিয়ে এনেছিলেন। সেবার তৃণমূল কংগ্রেসের গায়ক থেকে নেতা হয়ে ওঠা প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয় বালিগঞ্জ থেকে জিতেছিলেন বটে, কিন্তু ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে হালিম এই আসনে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। আর বিজেপি প্রার্থীর ঠাঁই হয়েছিল তৃতীয় স্থানে, তাদের ভোট শতাংশও ছিল অনেক কম।

সায়রার উৎসাহী সমর্থকরা লাল রঙে লেখা স্লোগান দিয়ে রাঙিয়ে দিয়েছে তাঁর নির্বাচনি কেন্দ্রের দেয়াল। তার দু-একটা নমুনা এরকম : “দক্ষিণে মালা বদলের পালা এলো” (এর আক্ষরিক অর্থ পরিষ্কার হলেও দ্বিতীয় একটা অর্থও এ স্লোগানের মধ্যে লুকিয়ে আছে, ইঙ্গিতটা দক্ষিণ কলকাতার তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ মালা রায়ের দিকে) এবং ‘হৃৎপিণ্ড বাম দিকে, রক্তটাও লাল/আমরা ফিরব, আজ নয় তো কাল।”

“কলকাতা বরাবরই বাংলার রাজনীতিকে পথ দেখিয়েছে। শহুরে উচ্চবর্গীয় বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন কোনো একটা মতাদর্শের পক্ষে আনতে পারলে সে মতাদর্শ অন্যত্র ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা সহজ হয়ে যায়”, বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের সদস্য রজত রায়। “পশ্চিমবঙ্গ জয় করার ভিত্তিটা অবশ্য গ্রামাঞ্চল থেকেই আসতে হবে, কিন্তু অনেক সময়েই গ্রাম বাংলাকে পথ দেখিয়েছে শহর। শহুরে মধ্যবিত্তর মন পেতে তাই সব পার্টিই চায়।”

১৯৬৯ সালে কলকাতা পুরসভার মেয়র হয়েছিলেন প্রশান্ত সুর। তার আগে সেই ১৯২৪ সাল থেকে এই শহর মেয়র হিসেবে পেয়ে এসেছে কোনো না কোনো কংগ্রেস নেতাকে। প্রশান্তবাবুই সেই দীর্ঘ ঐতিহ্যকে ভেঙে দেন। তখনই স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছিল যে বাংলা এবার ‘লাল’ হতে চলেছে। তার আট বছর পর প্রশান্তবাবুর পার্টি বিধানসভা নির্বাচনে অনায়াস জয় পায়। এ রাজ্যে শুরু হয় ৩৪ বছরের বাম শাসনের পালা।

তবে গত শতকের শেষাশেষি তৃণমূল কংগ্রেসের সুব্রত মুখোপাধ্যায় আবার কলকাতার মেয়রের পদটি ছিনিয়ে নিতে পেরেছিলেন। উল্লেখ্য যে, এ পদে একসময় আসীন ছিলেন সুভাসচন্দ্র বসুর মতো ব্যক্তিত্বও। সুব্রতবাবুর সেই জয়ের এগারো বছর পর মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিপক্ষকে স্রেফ গুঁড়িয়ে দিয়ে জয় করে নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা। সূর্যাস্ত হয়েছিল বাংলার বার্ধক্যের ভারে ন্যুয়ে পড়া কমিউনিস্টদের রাজত্বে। “পশ্চিমবঙ্গে যে কোনো দলের উত্থানের মূল কেন্দ্রবিন্দু কলকাতা”, বলছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ইতিহাসের অধ্যাপক কিংশুক চট্টোপাধ্যায়। কয়েক সপ্তাহ আগেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই ‘চেম্বার্স বুক অব ইন্ডিয়ান ইলেকশন্স’।

২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আসন সংখ্যা এক লাফে ন’ গুণ বেড়ে আঠেরোতে উঠলেও কলকাতার তিনটি আসনেই তাদের হারতে হয়েছিল। গত বিধানসভা নির্বাচনেও তারা এ শহরের ২১টি বিধানসভা আসনের মধ্যে একটিতেও জিততে পারেনি।

কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের কলকাতা জয়ের সংকল্প গুঁড়িয়ে যায়নি। সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে শুরু করে আইনজীবী কিংবা লেখক-শিল্পীর মঞ্চ পর্যন্ত তাদের একগুচ্ছ শাখা সংগঠন শহরের বুকে অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছে। এ কথা তো মানতেই হবে, দেশের প্রথম লোকসভায় দক্ষিণ কলকাতার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন বিজেপির পূর্বসূরি জন সংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। বিজেপি নেতা ও শিল্পপতি শিশির বাজোরিয়ার কথায়, “রাজ্যের মানুষ সরকারের সংগঠিত দুর্নীতির জেরে জেরবার, আর তার সুবিধা পাচ্ছি আমরা।”

তাছাড়া কলকাতা শহরের পরিবর্তিত জনবিন্যাসও বিজেপিকে বাড়তি সুবিধা জোগাচ্ছে। ৪৫ লাখ মানুষের এই শহরের শিল্পক্ষেত্রে ক্ষয়রোগের ছায়া। তবু আজও কলকাতায় ভিড় জমান প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর পরিযায়ী শ্রমিকরা। ১৯৯১ সালে এ শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে বাংলাভাষী মানুষদের অনুপাত ছিল ৬৪ শতাংশ; ২০১১ সালে সেটা ৬১.৫ শতাংশ নেমে আসে। অন্যদিকে এ শহরে হিন্দিভাষীদের অনুপাত এখন ২৩ শতাংশ।

চিনা, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, ইহুদি কিংবা আর্মেনীয় বাসিন্দাদের পুরনো পাড়াগুলো হু হু করে ফাঁকা হয়েছে। তাঁদের জায়গাটা দখল করে নিয়েছেন নতুন পরিযায়ীরা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, হিন্দি বলয়ের মানুষরা চান যে, রাজ্যের রাশ থাকুক তৃণমূলের হাতে, আর কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকুক বিজেপি।

কিংশুকও মানছেন, “বিজেপি যে আস্তে আস্তে পরিণত হয়ে উঠছে, তার সত্যিকারের ইঙ্গিত পাওয়া যায় এটা দেখে যে শহরের কিছু এলাকায় তারা প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে।”

“ভোটে ত্রিমুখী লড়াই হলেও শাসক তৃণমূলের জেতার সম্ভাবনাই বেশি। বিজেপি আর সিপিআই(এম) কিছু ভোট টানলেও তারা আসলে পরস্পরের প্রভাব কমিয়ে দেবে”, মন্তব্য করলেন মৌলানা আবুল কালাম ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ-এর প্রাক্তন অধিকর্তা রণবীর সমাদ্দার।

তবে এককালে “পূর্বের লেনিনগ্রাদ” নামে পরিচিত যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র প্রসঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমনকল্যাণ লাহিড়ির মতো, “এখানে লড়াইটা আসলে তৃণমূল কংগ্রেস আর সিপিআই(এম)-এর মধ্যে। বিজেপির ইতিহাসবিদ প্রার্থী অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় সেখানে অনেক পিছিয়ে আছেন।”

সন্ধে গড়াতে যাদবপুরে জমায়েত হয়েছেন বিপুল সংখ্যক বাম সমর্থক। বেশির ভাগই মধ্যবয়সী- আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে বামেদের স্বর্ণযুগের নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত। মাঝেমধ্যে অবশ্য চোখে পড়ে কিছু উৎসাহী তরুণ মুখ। একের পর এক বক্তা সভার মঞ্চে উঠে আক্রমণ শানাচ্ছেন দক্ষিণপন্থি বিজেপি আর রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভিড়ের বহর।

দুপুরবেলা চামড়া-পোড়ানো গরম আগ্রাহ্য করে গোটা যাদবপুর কেন্দ্র ঘুরে প্রচার সেরেছেন তৃণমূলের অভিনেত্রী থেকে নেত্রী হয়ে ওঠা প্রার্থী সায়নী ঘোষ। তাঁর সঙ্গী ছিলেন ঢাকি আর তৃণমূল কর্মীদের দল। দলের কর্মীরা লিফলেট বিলি করছিলেন মূলত মহিলা ভোটারদের মধ্যে। আধা-গ্রামীণ এলাকা কিংবা বস্তি এলাকার মহিলারাই বোধহয় তৃণমূলের কট্টর সমর্থক।

এ প্রসঙ্গে রণবীর সমাদ্দারের মন্তব্য, “কোনো কেন্দ্রের অর্ধেক ভোটারদের মধ্যে বেশির ভাগ যদি কোনো পার্টির হাতে চালু হওয়া মহিলাকেন্দ্রিক সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের জন্য সেই পার্টিকে সমর্থন করেন, তাহলেই অন্যান্য প্রার্থীদের জন্য লড়াইটা কঠিন হয়ে পড়বে।”

লেখক : পিটিআই-এর পূর্ব ভারতের প্রাক্তন প্রধান

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর