বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

জিয়াউর রহমান : অম্লান যার স্মৃতি

খায়রুল কবির খোকন

জিয়াউর রহমান : অম্লান যার স্মৃতি

মাত্র ৪৫ বছরের জীবনকালে একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক যে নিজ রাষ্ট্র ও দেশবাসীকে ভালোবেসে সংগ্রামে, লড়াইয়ে আত্মত্যাগে নিজেকে কোন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।

আজ ৩০ মে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮১ সালের এইদিনে চট্টগ্রামে ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁকে হত্যা করে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সেনা কমান্ডার মেজর জেনারেল মনজুর ও তাঁর অধীনস্থ কিছু সেনা অফিসারকে এই হত্যাকাণ্ডে দায়ী করা হলেও এর পেছনে সেনাবাহিনীর তৎকালীন শীর্ষ পদধারীরা কেউ কেউ সরাসরি যুক্ত ছিলেন বলে তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়া এবং ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় সুবিধাভোগী হয়েছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। জিয়াউর রহমানের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারের কাছ থেকে অবৈধ পন্থায় জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের ইতিহাস এই দেশের সব মানুষই জানেন।

আমরা যাব আমাদের জাতীয় বীর জিয়ার মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক সংগ্রামের ঘটনাবলির পর্যালোচনায়। ১৯৭১ সালের মার্চে মেজর জিয়া ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়নের ডেপুটি কমান্ডার। তিনি তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন ও পরবর্তীকালের স্বাধীনতার সংগ্রামের ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করেছেন এবং জেনেছেন। জেনে বুঝে নিজের কর্তব্য পালনের অপেক্ষায় থেকেছেন। মেজর জিয়া সেই মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে সারাক্ষণ অপেক্ষায় ছিলেন বাঙালির জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনার জন্য। পাক দখলদার সেনাদের ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যাযজ্ঞ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়া সেই ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে (রাত একটা/দুটোর দিকে) চট্টগ্রাম নগরীতে তাঁর সহযোগী বাঙালি সেনা অফিসার ও সৈনিকদের (প্রায় তিন শো) নিয়ে পাক হানাদার সেনাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং দখলদার বিতাড়নের প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। পরবর্তী তিরিশ/চল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই মেজর জিয়া কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

মেজর জিয়া প্রথমে মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের কমান্ডাররূপে পাকিস্তানি দখলদারদের বিরুদ্ধে তাঁর বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান। জুলাই মাসের (১৯৭১) মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর প্রথম ব্রিগেড ‘জেড ফোর্স’ প্রতিষ্ঠিত হলে লে. কর্নেল পদোন্নতিপ্রাপ্ত জিয়া তখন ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে বাংলাদেশে পাক সেনাদের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জিয়া নজিরবিহীন সাহসিকতায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন। আওয়ামী লীগ সরকার জিয়াকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘বীরউত্তম’ খেতাব প্রদান করে।

১৯৭২ সালের মধ্যভাগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। যদিও ‘সবচেয়ে সিনিয়র অফিসার’ হিসেবে জিয়াউর রহমানের প্রথম সেনাপ্রধান (চিফ অব স্টাফ) হওয়ার কথা ছিল। জিয়াউর রহমান সেনা উপপ্রধানের দায়িত্ব যথারীতি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে পালন করেন। জিয়াউর রহমান পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ফারুক রশীদ ডালিম ‘বিদ্রোহী গোষ্ঠীর’ কোনো তৎপরতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। আওয়ামী লীগ নেতারা ইদানীং যে অভিযোগ জিয়ার বিরুদ্ধে করছেন তাতে সত্যতার লেশমাত্র নেই। তখনকার পরিস্থিতি এমনি ছিল যে, সেনাপ্রধানকে ডিঙিয়ে সেনা উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়ার পক্ষে কোনো বিদ্রোহে জড়ানোর প্রশ্নই আসে না এবং জিয়াউর রহমান সে রকম নির্বোধ সামরিক অফিসারও ছিলেন না।

পঁচাত্তরের আগস্টে পটপরিবর্তনের পরে তখনকার সরকার জিয়াকে সেনাপ্রধান করেন তাঁর দক্ষতা, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান ও সেনাবাহিনী পরিচালনায় তাঁর যোগ্যতা বিবেচনায় রেখেই। সেই পদোন্নতি জিয়ার পক্ষে গ্রহণ না করার প্রশ্ন আসছে কেন? যেখানে আওয়ামী লীগ ও বাকশাল সরকারের বেশির ভাগ মন্ত্রী ও নেতা পরবর্তী সরকারের মন্ত্রী ও অন্য কর্মকর্তা হয়েছেন।

জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার অভ্যুত্থানে সবার সমর্থনে নতুন সরকারে দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত হন-ডেপুটি চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর পদ লাভ করেন। বস্তুত, জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান হিসেবে সেই পদে বসান সিপাহি জনতার অভ্যুত্থানকারীরা। দেশবাসীর সমর্থনেই তিনি এ দেশে জনগণের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপরের ইতিহাস জিয়াউর রহমানের আরেকটি নতুন যুদ্ধ শুরুর। তিনি দেশব্যাপী স্বেচ্ছাশ্রমে খাল কাটা কর্মসূচি, গ্রামে গ্রামে জনগণের দুয়ারে দুয়ারে হেঁটে পৌঁছে যাওয়া, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের মানবসম্পদ রপ্তানি কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া, দেশে তৈরি পোশাক শিল্পের ভিত তৈরি করা ও শিল্পকারখানা গড়ার কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে নেওয়া, গণচীনসহ মধ্যপ্রাচ্য ও অন্য সব মুসলিম দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, ইসলামী সম্মেলন সংস্থায় নেতৃত্ব দেওয়া, সব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করা, ইরান ইরাক যুদ্ধ বন্ধে আন্তর্জাতিক উদ্যোগে নেতৃত্বদান, আর নিজ রাষ্ট্রে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের প্রচেষ্টায় সেচ কাজসহ সার্বিক কৃষি উৎপাদন কার্যক্রম আধুনিকায়নে ভূমিকা রাখেন। এবং অবিরাম ফসল বাড়ানো, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি প্রতিষ্ঠা, নিজ রাষ্ট্রকে সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনা-ইত্যাদি কাজে আহার নিদ্রা সময়মতো না করে প্রচণ্ড বেগে ঝাঁপিয়ে পড়া ছিল জিয়ার একমাত্র ধ্যান জ্ঞান।

সাফল্যও তিনি পেয়েছেন ব্যাপকভাবে। দেশি-বিদেশি ভূ-রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছেন, জিয়াউর রহমান ১৯৭৫, ৭৬, ৭৭, ৭৮ সময়কালে বাংলাদেশের নেতৃত্ব গ্রহণের সুযোগ না পেলে বাংলাদেশ আফগানিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতো। আর লাখ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা পড়ত। তাঁরা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বের প্রশংসা করে অনেকেই তাঁকে একজন রাষ্ট্রনায়ক আখ্যায়িত করেছেন। সার্কের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন তিনি।

এটা স্বীকার করতেই হবে-জিয়ার মধ্যে অসাধারণ দেশপ্রেম সৃষ্টি হয়েছিল সেই পঞ্চাশ-ষাট দশকে পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং একজন জুনিয়র অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়। তিনি সাহসিকতায়, যুক্তি বুদ্ধিতে, সামরিক কৌশলের দক্ষতায় একজন নজিরবিহীন সেনানায়ক ও পরে রাষ্ট্রনায়ক হতে পেরেছিলেন। আমাদের এই রাষ্ট্রে তাঁর স্মৃতি চির অম্লান থাকবে।

লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক ডাকসু সাধারণ সম্পাদক

সর্বশেষ খবর