শুক্রবার, ৩১ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

গণতন্ত্র বিষয়টাই এখন পিচ্ছিল

এম জে আকবর

গণতন্ত্র বিষয়টাই এখন পিচ্ছিল

নির্বাচনি প্রচারণার কথা নির্ণয়ের বিজ্ঞানে আমার অবদান রুশ প্রবাদগুচ্ছ সমন্বয়ে তৈরি একটি ধাঁধা। প্রবাদগুলোর এক বা একাধিকের মধ্যে সুপ্ত থাকে সেই ধাঁধার সব যোগসূত্র। বুদ্ধি খাটিয়ে জট ছাড়ানোর সময়টায় হয়তো কেউ কেউ ক্লান্ত হতে পারেন। তবে ৪ জুন (ভারতে সাধারণ নির্বাচনের ভোট গণনার দিন)-এর বিজয়বেদির দিকে এগিয়ে যাওয়ার আনন্দও এতে পাওয়া যাবে। প্রবাদগুলো এ রকম :

* মুখের বুলি চড়ুই পাখি নয় যে উড়ে গেলে আর ধরা যাবে না।

* পুরনো এক বন্ধু নতুন দুই বন্ধুর চেয়ে ভালো।

* অতীত হলো বাতিঘর, বন্দর নয়।

* দুই খরগোশকে ধাওয়া করলে, একটাও ধরা যায় না।

* নেকড়ে থেকে পালিয়ে ভালুকের খপ্পরে যেও না।

* ব্যথাহীন জাগরণ মৃত্যুতেই সম্ভব।

* আপন নিয়ম পরের আস্তানায় খাটাতে যাবে না।

* নিজের কনুই কামড়ানো যায় না।

* মিথ্যার চুম্বনের চেয়ে সত্যের চড় ভালো।

* মাগনায় পনির শুধু ফাঁদে পড়া ইঁদুরেতে খায়।

খেলটা কেমন বুঝতে হলে স্বঘোষিত বিশ্লেষকদের গুরুগম্ভীর আওয়াজ উপেক্ষা করা চাই না কারণ এদের বেশির ভাগই আয়নায় নিজ প্রতিবিম্বের ভিতর থেকে উঠে আসা। এখন খতিয়ে যাক ইঁদুরের ফাঁদে থাকা পনিরের অবস্থা।

পনির যখন এজেন্ডায় চলে আসে, তখন নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এটা স্নায়ুর একটা ব্যাপার। একটি রাজনৈতিক দল প্রচারণার মাঝামাঝি হঠাৎ ঘোষণা করে যে, তারা নির্বাচনে জিতলে প্রত্যেক নারী বছরে ১ লাখ রুপি করে পাবে। এত টাকা কোথা থেকে আসবে, কেউ তা খোলাসা করল না। এ নির্বাচনে প্রায় ৫০ কোটি মহিলা ভোটার। ভোটার তালিকার বাইরেও অনেক মহিলা ওই টাকার দাবিদার হবে। এ বিশেষ নির্বাচনি টোপটি আরও কয়েক কোটি টাকা ব্যয় যোগ করবে। এ অঙ্ক আমার পাটিগণিতের হিসাবনিকাশের বোধগম্যতার বাইরে। ভারতীয়রা তাদের অর্থ উৎসর্গ করবে যদি এটি ট্যাক্স রাজস্বের মাধ্যমে জোগাড় না করে জনগণের খাজাঞ্চিখানা থেকে টেনে আনলে ভারতীয়রা মুদ্রাফতুর হয়ে যাবে। এ ধরনের উদ্ভট প্রতিশ্রুতির কানাকড়ি মূল্যও নেই। কারণ যা সাধা হচ্ছে তা শুধুই বিভ্রম। অনুগত লোকেরাই এতে মাথা নেড়ে ‘জি হুজুর’ বলবে। ভোটারের অধিকাংশই পরীক্ষিত পন্থায় বিশ্বাসী, অর্থহীন কিছুতে নয়।

শ্রীনগরে প্রায় চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি দেখা গেছে। ৩০ বছর আগে ১৯৯০-এর দশকে, শহরটি নজিরবিহীন সহিংসতার শিকার হয়েছিল, রক্তে ভেসে যাচ্ছিল এর রাস্তাঘাট। এর পাশাপাশি কট্টরপন্থি মহল থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী স্লোগান আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়েছিল। আজ, পাকিস্তানের বেআইনিভাবে দখল করা কাশ্মীরের অংশের রাজধানী মুজাফফরাবাদে একটি বিদ্রোহ চলমান। পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীর (পিওকে) জুড়ে কাশ্মীরিরা বঞ্চনা ও অবিচার থেকে, ধসে পড়া অর্থনীতি থেকে, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার ধোঁয়াশা থেকে মুক্তি চায়। পাকিস্তান শিশুদের থালা থেকে খাবার কেড়ে নিয়েছে, তাদের সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছে, এবং গণতন্ত্রকে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত অলিগার্কি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করেছে। এই সেই পাকিস্তান যা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ব্রিটিশদের সঙ্গে যোগসাজশে অখণ্ড ভারতের বুকে নির্মম ছুরি চালিয়ে তৈরি করেছিলেন।

ভারতের রাস্তাঘাটে পাকিস্তানের নাগরিকদের উদ্দেশে যা বলাবলি হয় তা এখানে উপস্থাপন করা যায়। পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রতি ভারত একটা জীবন্ত হুমকি-এ ধাপ্পাবাজির প্রচারণা চালিয়ে ৭৫ বছর ধরে জনগণের খরচে আপনারা সেনাবাহিনীকে মোটাতাজা করেছেন। ২০২০-এর দশকের খবর হলো যে, ভারতে কেউই ওই ঘেয়ো-পচা জমিন আর ফিরে পেতে চায় না। পাকিস্তানের সাধারণ, বিপথগামী জনগণের জন্য ভারতের একমাত্র সহানুভূতি থাকতে পারে-সেটি হলো মানবিকতা, যারা কি না ১৯৪৭ সালে একটি মন্দ, অশুভ, প্রতারণামূলক মিথ্যা প্রচারণার শিকার হয়েছিলেন। যে অভিজাতরা পাকিস্তান পয়দা করেছেন তারা ইতিহাসের সবচেয়ে শোষণমূলক ভাঙনের সুবিধাভোগী। তারা এখন দেশটির ডুবন্ত অর্থনীতির মচমচে উপরিভাগকে পুষ্ট করতে সচেষ্ট।

আমি আমার বই ‘টিন্ডারবক্স’-এ পাকিস্তানকে জেলি-রাষ্ট্র বলে বর্ণনা করেছি; যে দেশ জেলির মতো স্থিতিশীলও হবে না, আবার জেলির মতো গলে গিয়ে হারিয়েও যাবে না। নিজেদের তৈরি ফাঁদে আটকে যাচ্ছে পাকিস্তান। এ স্ব-আরোপিত রক্তক্ষরণ থেকে বাঁচতে তাদের এখন দরকার আরও বেশি দূরদর্শী, আরও সাহসী নেতার। মনে হয়, সেই নেতা এখনো জনসাধারণের অধরা অবস্থায় রয়েছেন। যদি সে রকম নেতার উদ্ভব হয়, তবে তাকে একটা সত্য মেনে নিতে হবে : পাকিস্তান যতক্ষণ তার অতীতের মৌলিক অসংগতি সংশোধন না করবে, মানে, মেয়াদোত্তীর্ণ রাজনৈতিক মতাদর্শ বর্জন করে নিজেকে আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে নতুন করে উপস্থাপন না করবে, ততদিন সে তার ভবিষ্যতের দেখা যাবে না।

নামের ধারা বহন করে পিতা-মাতা, সন্তান নয়। শিশুরা কেবল তাদের জন্মদাতাদের প্রেমময় আকাক্সক্ষায় রঞ্জিত হয়। অমর দার্শনিক পি জি ওডহাউস চমৎকার কথা বলে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সব শিশু দেখতে একই রকম’। তাঁর কথাটা অবশ্যই ফেলে দেওয়ার মতো নয়। কিন্তু টাকার বান্ডিল দেখলে সব বাবা-মার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং তারা তাদের কল্পনায় আসা সবচেয়ে সুন্দর নামটি সন্তানকে দেন যে নামকরণ শুরু হয় ঈশ্বরীয় গুণবাচক নাম দিয়ে। মধ্যপন্থি কেউ কেউ প্রাকৃতিক বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে মিল করে নামকরণ করেন। তবে, অনেকেই সবচেয়ে সুন্দর ও উৎকৃষ্ট ধরনের নাম দিতে যান, যার মধ্যে থাকে খুব সুন্দর ফুলের নামও। ব্যতিক্রমী পিতা হিসেবে ইলন মাস্কের নামোল্লেখ হয়তো করা যাবে যিনি সন্তানের নাম রেখেছেন ‘বর্ণ (অক্ষর)’র নামে। কিন্তু তিনি তো তার সন্তানদের আগামী দিনে ভিন্নগ্রহে অভিযাত্রার অধিনায়কত্বের জন্য গড়ছেন।

আমার দেখা সবচেয়ে সততাপূর্ণ নামটি যিনি দেন তিনি ঘাটকোপারের ভবেশ ভিন্দে। ইনি এখন পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন। ভিন্দে তার বিজ্ঞাপন সংস্থার নাম রেখেছেন ইগো মিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড। ইগো শব্দটি হলো অকপটের শব্দের সমার্থক।

ভিন্দের এখন জীবন কাটছে মুম্বাই পুলিশের একজন সাময়িক অতিথি হয়ে, কেননা দুই বছর আগে তিনি নগরীর আইনপ্রণেতা এবং প্রশাসনের দুর্নীতিবাজদের সহায়তা নিয়ে বিশাল এক বিলবোর্ড খাড়া করেছিলেন নিয়মকানুনের পরোয়া না করে। এ বিশাল বিলবোর্ডটি দুই বছর ধরে কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ল না-এটা বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে রেকর্ড বুকে জায়গা করে নেওয়ার মতো। বিলবোর্ড সরিয়ে নেওয়ার জন্য দিন পনেরো আগে, পুলিশ তাকে একটি নোটিস দেয়। কিন্তু প্রভাবশালী দোস্তদের খাইয়ে-দাইয়ে তুষ্ট রাখায় নোটিসের বিষয়টি তিনি উপেক্ষাই করেছিলেন, যেন এ ব্যাপারে তার কোনো দায়ই নেই। বিলবোর্ডটি ঝড়ে বিধ্বস্ত হলে তাতে ১৬ জন নিরীহ মানুষ মারা যায়, আহত হয় ৭৪ জন। নইলে তিনি বড়জোর ২০২৬ সালে একটি ফলোআপ নোটিস পেতেন। এ মর্মান্তিক ঘটনায় হতাহতের সংখ্যাই প্রমাণ করে এখানে দুর্নীতির মাত্রা কতটা তীব্র ছিল।

মুম্বাই মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন নির্বাচনে বিজয়ের জন্য কেন সংসদ নির্বাচনের চাইতে বেশি খরচ করতে হয়? বিলবোর্ডের কারণে এটা হয়। দিল্লির সংসদের চেয়ে মুম্বাইয়ের মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের আসনে থাকলে বেশি টাকা বানানো যায়।

ভিন্দে স্বচ্ছ লোক ছিলেন। তাঁর কোম্পানির নাম ছিল ইগো, যার সমার্থক শব্দ হলো আত্মশ্লাঘা/আত্ম অহংকার এবং তিনি সম্ভবত এটিতেই সাফল্য লাভ করেছিলেন। হয়তো তিনি খুব সাধারণ অবস্থা থেকে এসেছিলেন, কিন্তু মুম্বাইয়ের অবৈধ বিলবোর্ডের ব্যবসায় বিনম্রতা দিয়ে কেউ খুব ওপরে যেতে পারে না। সে কাজটা ইগো বা আত্মশ্লাঘা দিয়ে হয়। আত্ম অহংকার ব্যবসায়ীর কবজায় নিয়ে আসে পৌর কাউন্সিলরদের এবং অপঅর্জনের ভাগও দেয়। এটা একটা প্রবাদ মনে করিয়ে দেয় : অহংকারের আগমন বিলবোর্ড ধসের আগে।

বহুজাতিক বিপণনে চতুর লোকেদের উদ্ভাবিত একটি শব্দ বর্তমানে সবার মনোযোগ কেড়েছে : ‘স্পেভিং’ (স্পেনডিং ইন অর্ডার টু সেভ)-সঞ্চয়ের জন্যই খরচ করো। এটি এক চাতুরীভরা কথা যেমন ‘তিনটি সাবান কিনলে একটি সাবান ফ্রি’-এর মতো প্রতারণামূলক ব্যাপারকে ন্যায়সংগত বানানো। জাতীয় বা বহুজাতিক কোম্পানি থেকে কেউ ক্রেতাকে বলে না যে প্রতিটি কেকের দাম আসলে এক ধরনের জোর করে অর্থ আদায়ের সমতুল্য। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সময় ‘স্পেভিং’ অর্থবোধক হতে পারে যখন টাকার মূল্য কমে যায়, কিন্তু পণ্যের উপযোগিতা স্থিতিশীল থাকে। শব্দটি হতাশাবাদীদের অভিধানেও অনুপ্রবেশ করতে পারে। নতুন বই রচনার জন্য বিষয়সন্ধানী অর্থনীতিবিদও শব্দটিতে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন।

নির্বাচনি রাজনীতিতে ‘স্পেভিং’-এর বৈধ জায়গাও থাকতে পারে। মানে, পরবর্তীতে ভোটিং সিদ্ধান্ত অনুকূলে আনতে এখনই দানের নামে খরচ করুন। গণতন্ত্র বিষয়টাই এখন পিচ্ছিল, তা সে আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা বা ভারত-যেখানকারই গণতন্ত্র হোক না কেন। এ ক্ষেত্রে পদ্ধতিতে ভিন্নতা থাকতে পারে, মতলবে নয়। এখানে লুকোছাপারও কিছু নেই।

লেখক : ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী

সর্বশেষ খবর