শুক্রবার, ৩১ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

রাইসির মৃত্যুরহস্য ও রয়ে যাওয়া প্রশ্ন

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

রাইসির মৃত্যুরহস্য ও রয়ে যাওয়া প্রশ্ন

জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত কফিনের সারি। প্রতিটি কফিনের সঙ্গে আছে ভিতরে থাকা প্রাণ হারানো মানুষটির ছবি। কফিনের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে লাখো জনতা। আরও আছেন বিভিন্ন দেশ থেকে আগত রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিবৃন্দ, দেশ-বিদেশের মন্ত্রীবর্গ এবং অন্যান্য শুভাকাক্সক্ষী। নির্দিষ্ট সময়ে হাজির হলেন দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। একজন সহকারী ভরাটকণ্ঠে মাইকের গগনবিদারী শব্দে কয়েকবার বললেন ‘সালাহ’, ‘সালাহ’ (নামাজ)। সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে জানাজার নামাজ শুরু করলেন। ভাবগম্ভীর পরিবেশে নামাজ শেষ হলো।

সামনের কফিনগুলোর মধ্যে একটি বিশেষ কফিনের ওপর ছিল কালো পাগড়ি। সে দেশের প্রচলিত রীতিতে ‘আওলাদে রসুল’ অর্থাৎ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশধর দাবিদার একটি বিশেষ গোষ্ঠী এমন কালো পাগড়ি পরিধান করে। এই পাগড়ির নিচে কফিনের ভিতর থাকা নিথর দেহের মানুষটি সম্পর্কে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ছোট্ট করে শুধু একটি কথাই বললেন, ‘হে আল্লাহ, (তুমি সাক্ষী থাকো) আমরা তার ভিতরে যা কিছু দেখেছি, তার সবই ছিল ভালো’। নেতার দেওয়া এই সাক্ষ্য শুনে কেঁদে উঠল লাখো জনতা। কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত হাজার হাজার নারী অশ্রু বিসর্জন দিল আর বোবা কান্নায় ভেঙে পড়ল। কালো পাগড়ির নিচে থাকা কফিনে ছিল গত ১৯ মে ২০২৪ তারিখে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো ইরানি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃতদেহ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদুল্লাহিয়ানসহ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো অপর সাতজনের মৃতদেহ ছিল বাকি সাতটি কফিনে।

২২ মে বুধবার ইরানের রাজধানীর সব পথ এসে মিশেছিল তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। নিরাপত্তা চাদরে ঢাকা রাজধানীতে ঢোকার সব পথ দিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে লাখো মানুষ নানাভাবে প্রবেশ করে। আর রাজধানী তেহরানের প্রায় সব পুরুষ এবং অধিকাংশ নারী জড়ো হয়েছিল তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। অধিকাংশের পরনে ছিল কালো পোশাক। দিনটি ছিল শুধুই শোকের, যে শোকের নেপথ্যে ছিল একটি দুর্ঘটনা, আটটি মৃত্যু, শত কল্পনা ও হাজারো প্রশ্ন। ইরানে ক্ষমতার শিখরে আছেন দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। আর খামেনির ডান হাত, অন্ধ অনুসারী এবং সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে ইরান এবং বহির্বিশ্বে সুপরিচিত ছিলেন ২০২১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করা ইব্রাহিম রাইসি। ইরান ও পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র আজারবাইজানের যৌথ উদ্যোগে নবনির্মিত কিজ কালাসি নামক স্থানে দুটি বাঁধ উদ্বোধন করতে পশ্চিম জলফা অঞ্চলে গিয়েছিলেন রাইসি। সঙ্গে ছিলেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদুল্লাহিয়ান, ধর্মীয় নেতার (খামেনি) প্রতিনিধি ও তাবরিজের শুক্রবারের ইমাম সৈয়দ মোহাম্মদ আল হাশেম, আজারবাইজানের গভর্নর মালিক রাহমাতি, প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মেহদি মৌসাভি, পাইলট কর্নেল মহসেন দারইয়ানুস এবং কর্নেল সৈয়দ তাহের মোস্তাফাভি। এ ছাড়াও ছিলেন টেকনিশিয়ান মেজর বাহরুজ কাদিমি এবং কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী ও ক্রু। ইরানের ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট এজেন্সির প্রধানের তথ্য অনুযায়ী, দুর্ঘটনার পরও ইমাম সৈয়দ মোহাম্মদ আল হাশেম এক ঘণ্টা বেঁচেছিলেন এবং প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন।

প্রেসিডেন্টের অপরাপর সফরসঙ্গীরা দুটি হেলিকপ্টার নিয়ে উড়াল দিলেন যার যার গন্তব্যে। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইব্রাহিম রাইসিকে বহন করা হেলিকপ্টারও রওনা দিল। শেষ হেলিকপ্টার উড়াল দেওয়ার পর আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টকে ঘিরে ধরলেন গণমাধ্যমকর্মীরা। সবার জিজ্ঞাসা শেষ মুহূর্তে কী কথা হলো বিশ্বের বুকে নানা কারণে ঝড় তোলা ও উপসাগরীয় এলাকার অকুতোভয় নেতা ইরানি প্রেসিডেন্ট রাইসির সঙ্গে। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, ‘আমি বন্ধুত্বপূর্ণ বিদায় জানিয়েছি রাইসি’কে। তবে সেটাই যে রাইসির জীবনে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান বা একজন রাজনীতিবিদ তথা একজন মানুষের কাছ থেকে নেওয়া শেষ বিদায় হবে, তা কে জানত। উড়াল দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই হেলিকপ্টারটি একটি পাহাড়ি এলাকায় আছড়ে পড়ে। এতে পাইলট ও ক্রুসহ সব যাত্রী মারা যান। ইরানের বর্তমান প্রশাসনের একজন পরীক্ষিত নেতা হিসেবে রাইসিকে বিভিন্ন স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দীর্ঘ সময়জুড়ে পদায়ন করা হয়েছিল। কালের পরিক্রমায় বিশেষত বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট ইরানের রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ও তাঁর অধীনে থাকা সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী গোষ্ঠীর সব আদেশ ও উপদেশ বিনাবাক্যে এবং অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন ইব্রাহিম রাইসি। ২০২১ সালে তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের আনুগত্য, শক্তি, সাহস ও দক্ষতার বিচারে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি রূপে তাকে নির্বাচিত করা হয়। তাই রাইসির মৃত্যুকে ঘিরে চলছে যত আলোচনা। মূলত ইব্রাহিম রাইসির জীবনটাই ছিল সংগ্রামমুখর। সত্তর দশকের শেষ ভাগে ইরানের প্রবাদপুরুষ ও তাত্ত্বিক গুরু আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে পরিচালিত ইসলামী বিপ্লবে পশ্চিমা সমর্থিত শাহ সরকারের পতন হয়। ১৯৮১ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ইরানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখনই সদ্যপ্রয়াত রাইসিকে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির হাতে প্রশিক্ষণ প্রদান-পূর্বক রাষ্ট্রের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

‘ঘাতক কমিটি’ নামে পরিচিতি পাওয়া চারজন বিচারকের অধীনে ১৯৮৮ সালে এক বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জেলে থাকা কয়েক হাজার বন্দির নতুন করে বিচার শুরু হয়। ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন এমন বিচারকদেরই একজন। এই বিচারের পর ঠিক কতজনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আশঙ্কা অন্তত ৫ হাজার নারী-পুরুষকে এ সময় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে রাইসি দাবি করেন যে, দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির ফতোয়া অনুসারে দেওয়া এই মৃত্যুদণ্ডাদেশ যুক্তিসংগত ছিল। অন্যদিকে দেখা যায়, আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির পর ক্ষমতার পাদপীঠে আসেন ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। তাঁরই সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও ইরানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন সে দেশের ইসলামী বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর প্রধান এবং বিশেষ চোরাগোপ্তা বাহিনীর সমন্বয়ক মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি ইরাকের বাগদাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমান হামলায় তিনি নিহত হন। কাসেমির পাশাপাশি ইসলামী বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীকে দেখভালের দায়িত্ব ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির আবদুল্লাহিয়ানের ওপর। সাম্প্রতিক দুর্ঘটনায় এই আমির আবদুল্লাহিয়ানেরও মৃত্যু ঘটে।

তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এরপর কার পালা? কে হতে পারেন পরবর্তী হত্যাকাণ্ডের শিকার? ২০২২ সালে ইরানে নারীদের বাধ্যতামূলক হিজাব পরার আইন যথাযথভাবে অনুসরণ করেননি ২২ বছর বয়সি নারী জিনা মাশা আমিনি। এ কারণে গ্রেফতারের পর পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে। এতে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে ইরানের বিভিন্ন শহর ও আন্তর্জাতিক মহলে। রাইসি সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার আশীর্বাদ নিয়ে এমন আন্দোলন কঠোর হাতে দমন করেন এবং এ ধরনের আন্দোলনকে আমেরিকা ও ইসরায়েলের চক্রান্ত বলে মন্তব্য করেন।

দেশের অভ্যন্তরের এমন বহু ঘটনাবলির আলোকে অনেকেই বলছেন, কোনো বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী এমন করুণ ঘটনার সূত্রপাত করে থাকতে পারে। আবার অনেকের ধারণা, ক্ষমতার বৃত্তে বিরাজমান অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলেও এমন অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।

অতি সম্প্রতি (১ এপ্রিল ২০২৪) যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে অবস্থিত ইরানি দূতাবাসের একটি ভবনে মার্কিন জঙ্গি বিমান থেকে বোমা ফেলা হয়েছিল। এ সময় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে ইরানি পৃষ্ঠপোষকতায় চোরাগোপ্তা হামলা এবং গোপনে সামরিক অভিযান পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ইরানি জেনারেল মো. রেজা জাহিদীসহ বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা প্রাণ হারান। এমন আক্রমণের জবাব দিতে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং ইরানের ভূখণ্ড থেকেই সরাসরি ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ক্রুজ মিসাইল, ব্যালাস্টিক মিসাইল ও ড্রোন ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেন। কাজে লাগান ইসরায়েলবিরোধী বিভিন্ন দেশের জঙ্গিদেরও। আমেরিকা এবং ইসরায়েলের জন্য এ ছিল এক অশনিসংকেত। এ হামলার ৩৭ দিনের মধ্যেই প্রাণ হারালেন আক্রমণের আদেশদাতা ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। এ কারণে এ দুটি ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার অবকাশ আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি ছিল অন্তত ৪৫ বছরের পুরনো। আমেরিকার একটি কোম্পানিতে নির্মিত এমন হেলিকপ্টার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রাংশ দীর্ঘদিন ধরে চলা মার্কিন বাণিজ্যিক অবরোধের কারণে ইরানের পক্ষে আমদানি করা সম্ভব হয়নি। এমন একটি হেলিকপ্টারে রাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় দুজন নেতাকে বহন করার বিষয়টি বিস্ময়কর। খারাপ আবহাওয়ায় সাধারণত কোনো হেলিকপ্টার উড়ার কথা নয়। যাত্রাস্থল থেকে গন্তব্য পর্যন্ত গোটা পথের আবহাওয়া জেনেই যাত্রা করে একটি হেলিকপ্টার। অপর দুটি হেলিকপ্টার একই আবহাওয়ায় নিরাপদে পাড়ি জমালেও এই হেলিকপ্টারটি কেন তা পারল না, সে নিয়েও রহস্য থেকে যায়। তারপরও বলা যায়, ইসরায়েলি বর্বরতা দেখেও আরব নেতারা যেখানে নিজ স্বার্থ তথা নিজের গদি বাঁচানোর লোভে নীরব, তখন এক বিপরীত অবস্থান নেন ইরানের সদ্যপ্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। এমন জাঁদরেল নেতার এহেন মৃত্যু তাই অনেক প্রশ্ন রেখে গেল।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

email : [email protected]

সর্বশেষ খবর