রবিবার, ২ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

ফেসবুক নিয়ে যত কথা

জীবেন রায়

ফেসবুক নিয়ে যত কথা

২০০১ সালে চার মহিলাকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছিলাম। ছোট্ট মহিলাটির বয়স ছিল দুই বছর। ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপকের চাকরি নিয়েই প্লেনে উঠেছিলাম। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার চার্লসটন এয়ারপোর্টে নামলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা আমাদের নিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক ড্রাইভ করে ক্যাম্পাসের একটি গেস্ট হাউসে আমাদের পৌঁছে দিল। তখন প্রায় রাত ১০টা। সঙ্গে সঙ্গে খাঁচা ভর্তি নানা ফল এসে গেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্টের শুভেচ্ছা নিয়ে। পরদিন সকালে প্রভোস্টের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। কিছুক্ষণ কথা বলার পর, ভদ্রমহিলা আমাকে সরাসরি কেমিস্ট্রি ল্যাব ক্লাসে নিয়ে গেল। এক ডজন ছাত্রছাত্রী তখন এক্সপেরিমেন্ট করছিল। প্রথম দিনটা আর বিশ্রাম নেওয়া হলো না। শুরু হয়ে গেল আমার শিক্ষকতার জীবন এই যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে।

একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি। রীতিমতো আনন্দের সঙ্গেই কাজটা করেছি। আজ আমার গর্ব হয়- অসংখ্য ছাত্রছাত্রী দেশে-বিদেশ ছড়িয়ে আছে। জীবনে ভালোভাবেই তারা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আমার এখনো মনে আছে, জাহাঙ্গীরনগর ছেড়ে আসার প্রাক্কালে আমাকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। অভূতপূর্ব। বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির চেয়ারম্যান, এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরগণ এসেছিলেন। আমার বক্তৃতায় আমি কী বলেছিলাম আজ আমার মনে নেই। কিন্তু দারুণ জমেছিল অনুষ্ঠানটি। প্রায় ৩০ বছর আগের কথা তো। ইমিগ্রেশন নিয়ে চলে গেলাম অস্ট্রেলিয়ায়।

বলা চলে আমি শুধু পথই চলেছি- দেশ থেকে দেশান্তর। অবাক হলেও সত্য, পকেটে পয়সা জমেনি। সেই ছোট্ট বয়সে রিটায়ার্ড বাবা, পয়সা গুনে গুনে সংসার চালাতেন এবং সব লিখে রাখতেন। সেজন্য আমি ধনবান হওয়ার স্বপ্ন কখনো দেখিনি এবং পয়সা জমাতে হবে তাও বুঝতাম না। পয়সা গোনার তো প্রশ্নই আসে না। অনেক কাল পরে আমার স্ত্রী এক দিন বলল, বাংলাদেশে কয়েক লাখ টাকা জমা আছে। কীভাবে? আমি তখন স্কয়ারে কাজ করতাম। আমাকে অবাক করে অস্ট্রেলিয়াতে তপনদা এসে বলল, তোমাকে এই, এই দেওয়া হবে, তুমি আমাদের সঙ্গে জয়েন কর। আমি তো ভাবতেই পারিনি। ড্রাইভারসহ গাড়ি, উত্তরায় ফার্নিশড অ্যাপার্টমেন্ট, তারপর এত টাকা। এদ্দিন পর আমার স্ত্রীর স্বর্ণ যুগের সূচনা। সেই পাঁচ বছরেই আমার শার্ট, পেন্টের খুচরো টাকা জমিয়ে অনেক টাকা নাকি হয়েছিল। আমি টেরই পাইনি। অর্থাৎ টাকা-পয়সার প্রতি উদাসীনতা। পরোক্ষভাবে আমার বাবার প্রতি শ্রদ্ধা।

২০০১ সালে আমার স্ত্রীর স্বর্ণ যুগকে ঠেলে দিয়ে চলে এসেছিলাম ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় একাডেমিক জব নিয়ে। চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি, কাকাবাবুকে (স্যামসন চৌধুরী) বলি কী করে? যুক্তরাষ্ট্রে আমার চাকরি, বেতন ইত্যাদি জেনে খুশিই হয়েছিলেন। আমি অবাকও হয়েছিলাম, আমাকে এক্সট্রা কয়েক হাজার টাকাও দেওয়া হয়েছিল।

আমি আমাদের মেয়েদের বলি, টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি তোমাদের জন্য রেখে যেতে পারছি না হয়তো, কিন্তু তিনটি দেশের নাগরিক করে দিয়ে যাচ্ছি। এটাও কম কীসে?

ফিরে যাই ২০০১ সালের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার কথায়। এর পরের বছর যুবক মার্ক জাকারবার্গ হার্ভার্ডে ফ্রেশম্যান হিসেবে অ্যাডমিশন নিয়েছে। কিন্তু সফমোরেই তার ইতি ঘটিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে হার্ভার্ডের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফেসবুক ডটকম খুলে ট্রায়াল শুরু করল। এবং ২০০৬ সালে পাবলিকের জন্য খুলে দেয়।

এর মাঝে ২০০৪ সালে আমি ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ছেড়ে মিসিসিপিতে চাকরি নিয়ে চলে আসি। সেই থেকে শিখর অনেক লম্বা হয়ে গেছে। এদিকে মার্কের ব্যবসা দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করছে। ২০১২ সালে পাবলিক কোম্পানি করে বাজারে স্টক ছাড়ে। তখন একটি স্টকের মূল্য ছিল ৩৮ ডলার আর এখন তা বেড়ে ৪৭৫ ডলার।

তখন স্টক মার্কেট কিছুটা বুঝতে শিখছিলাম। গুগল, ফেসবুক আরও অনেক সম্ভাবনাময় স্টক বাজারে ছিল। এই প্রথম, কয়েক মাস ইনভেস্ট করে পাঁচ/ছয় হাজার ডলার লাভ করেছিলাম। এটা অনেকটা জুয়া খেলার মতো।

এখন এই ফেসবুক প্রায় হাফ এ ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি। আর সবচেয়ে বড় কথা, গড়ে প্রতি মাসে সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ২.৯ বিলিয়ন। বর্তমান বিশ্বের এক- তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছে। কিন্তু আমি হয়তো ব্যতিক্রম। আমার বউয়ের হাজারে হাজারে ফলোয়ার, বেশির ভাগ সময়টাই প্রতিদিন মার্ক জাকারবার্গকে স্মরণ করে। আমি অনেককাল আগে প্রিয় ডটকমে লেখার জন্য ফেসবুক খুলতে হয়েছিল। তখন প্রিয় ডটকমে খুব লিখতাম। একটি লেখা ১ লাখেরও বেশি পাঠক পড়েছিল। এর জন্য পুরস্কার ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে গিয়ে সশরীরে আনতে হতো। অতি সম্প্রতি আমার বউ ও ছোট মেয়ে খুলে দেবেই ফেসবুক। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম আমার একটি অ্যাকাউন্ট আছে অনেক আগের। আইডি-পাসওয়ার্ড দিলাম। এই হলো আমার ফেসবুকের যোগ দেওয়ার ইতিকথা। কিন্তু আসল কথা, এখনো বলা হয়নি। আমার মাত্র কয়েক সপ্তাহের অভিজ্ঞতা। এখনো সবকিছু বুঝি না, আবার হয়তো বুঝতে চাইও না। কেননা আমি নেশায় নিমজ্জিত হতে চাই না।

এ পর্যন্ত আমার একটিমাত্র নেশা আছে। বলেই ফেলি। আমার জীবনে বন্ধু-বান্ধবের অভাব হয়নি। গ্রাম্যবন্ধু, গরিব বন্ধু থেকে শুরু করে অনেক বিলিয়নিয়ার বন্ধুও হয়েছে এবং আছে। স্কয়ারে চাকরি করা কালে, কাকাবাবু (স্যামসন চৌধুরী) অহরহ আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে নিতেন। বেশির ভাগ সময়ে কাজের কথা- ওষুধ উৎপাদন থেকে শুরু করে, মার্কেটিং কিংবা ফ্যাক্টরি সম্প্রসারণ অথবা নতুন কোনো আইডিয়া, তারপর কিছুটা খোশগল্প। আমার কলিগরা আমি চেয়ারম্যানের ওখানে থাকলে, বেশি করে আসত। ধমকানোটা একটু কম হবে ভেবে। আমার ভালো লাগত দুপুরের দিকে লাঞ্চ করার সময় অথবা পরে দুই পেগ হুইস্কি শেষ করে কাকাবাবু রেস্ট নিতে যেতেন। আমি যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালেই বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ড্রিংকসে হাতেখড়ি হয়ে যায়।

আমার প্রায়ই মনে হতো এক দিন আমার বাড়িতেও একটা ড্রিংকের ব্যবস্থা থাকবে। আয়েশ করে ড্রিং করব। আড্ডা দেব। তিন বেডরুমের বাসায় তেমন ব্যবস্থা করতে পারিনি কিন্তু কাপবার্ডের একটি সেলভ সর্বদাই হুইস্কি, ভটকা থাকে। ব্যাকইয়ার্ডে একটা স্ক্রিন্ড রুম করলাম আড্ডা দেওয়া এবং ড্রিং করার জন্য। কভিডের সময় খুব কাজে লেগেছে ঘরটি। কয়েক বছর চলল। তারপর বাড়ির সামনের পর্চে একটা আধা স্ক্রিন ও আধা কাঠ দিয়ে একটা আড্ডাখানা করলাম। আমার বউ সেই আড্ডাখানার ভিতরটা সাজাল।

এবার বলা যাক, ফেসবুকের অভিজ্ঞতার কথা। আমার একটা ধারণা ছিল এবং এখনো আছে, ফেসবুক বেশকিছু সৃজনশীল যুবক-যুবতীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া অনেক ক্ষেত্রে ভালোই করে থাকে, কিছু খারাপ ফলশ্রুতি যে হয় না তেমন নয়। তবে আমি তো অবাক, এ তো দেখি সবাই প্রোগ্রেসিভ এবং জিনিয়াস। তাদের কথোপকথন এককথায় উচ্চমার্গের এবং সহমর্মিতাসম্পন্ন। এমনকি অনেক প্রফেশনালও আছেন, দারুণ স্বাচ্ছন্দ্যে মিশে যাচ্ছেন সবার সঙ্গে। তাছাড়াও অনেক ক্রিয়েটিভ প্লাস অ্যানিমেল কিংডমের স্নেহ, ভালোবাসা ভিডিও অচিন্তনীয়। ইউটিউবের দ্বিতীয় সংস্করণ। এত কিছু ভালোর পরেও মানুষ ভায়োলেন্ট হয়ে পড়ে। বিশেষ করে পুরুষ নারীদের ওপর অত্যাচার করে, ধর্ষণ করে, মেরে ফেলে।

আমি জানি না মানুষকে ভালো মানুষ বানানো, সমাজের কল্যাণে ফেসবুক পার্টি বা দল হয়েছে কি না কোথাও। একটা ফেসবুক এনজিও হতেই পারে। জয়তু মার্ক জাকারবার্গ।

লেখক : অধ্যাপক, বিজ্ঞান ও অঙ্ক বিভাগ, মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যান, কলম্বাস, যুক্তরাষ্ট্র

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর