রবিবার, ২ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ধরন বদলেছে

সোহেল সানি

বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ধরন বদলেছে

সর্বোচ্চ ও চরম শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড। আদিকাল থেকে এ মৃত্যুদণ্ডাদেশের প্রচলন। কার্যকারিতা এখন সোজা হলেও প্রাচীনকালে ছিল নিষ্ঠুর এবং নির্মম। উল্লেখ্য, ১৩ মে বাংলাদেশের হাই কোর্ট ‘মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিকে কনডেম সেলে রাখা যাবে না’ মর্মে রায় প্রদান করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই রায় স্থগিত করে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত। এ বিষয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ২৫ আগস্ট দিন ধার্য করা হয়েছে। ফলে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে আপিল বিভাগের রায়ের ওপর। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীজুড়েই মৃত্যুদণ্ড কার্যকারিতার ধরন বদলেছে যুগে যুগে। সেসবের কিছু চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। যেমন একটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর কীভাবে করা হয়েছিল, সেটা বলছি। মাননীয় বিচারক একটি হত্যাজনিত অপরাধের জন্য এক ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করলেন। তিনি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পদ্ধতিও বাতলে দিলেন। ঐতিহাসিক রায়ে বিচারক আদেশ করলেন, ‘অপরাধীর ডান হাত তপ্ত লৌহদণ্ড দ্বারা এমনভাবে পোড়াতে হবে, যাতে তার হাড় থেকে মাংসপেশি চিমটি দিয়ে টেনে তোলা যায়। অপরাধীর প্রতিটি অঙ্গ থেকে মাংসপেশি এমনভাবে তুলতে হবে যাতে অপরাধী প্রচণ্ড কষ্ট পায় কিন্তু জীবিত থাকে। অধিকন্তু অপরাধীর শরীরকে এমনভাবে ঝলসাতে হবে, যাতে তার শরীর থেকে মাংসপেশি মোমের মতো গলে ঝরে পড়ে। অবশেষে তার হৃৎপিণ্ডে যখন আগুনের আঁচড় লাগবে এবং পুরো শরীর অবশ হয়ে যাবে তখন তার মুণ্ডু কর্তন করতে হবে।’ বিচারকের সেই আদেশ অনুযায়ী অপরাধী ব্যক্তির ওভাবেই দিনের পর দিন চরম নির্যাতনের মুখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি হচ্ছেন ফ্রান্সের অভিজাত গিরার্ড। আর যে ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলেন, সেই ব্যক্তি হলেন উইলিয়াম দ্য অরেঞ্জ। যাকে নেদারল্যান্ডসের Father of the Motherland (মাতৃভূমির জনক) বলা হয়, যাঁর নামে জাতীয় সংগীত Het William... ১৫৩৩ সালের ২৪ এপ্রিল জন্মগ্রহণকারী উইলিয়ামকে ১৫৮৪ সালের ১০ জুলাই ডেলফটের বাসভবনে (প্রিন্সেনহপ) ঘাতক গিরার্ড ফ্রান্সের অভিজাত পরিচয়ে সাক্ষাৎ করতে এসে গুলি ছুড়ে হত্যা করে। এটিই বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের প্রথম হত্যা। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগকালে উইলিয়ামের মুখে শেষ শব্দটি ছিল, ‘হে ঈশ্বর এ অভাগা লোকটির প্রতি আপনি সহানুভূতি দেখান, আর আমার আত্মাকে শান্তি দিন।’ মাননীয় বিচারক উইলিয়ামের হত্যাকারীর প্রতি উপরোক্ত অনুকম্পার বিষয়টি আমলে নেননি, বরং নিষ্ঠুর শাস্তি প্রদান করে ইতিহাস রচনা করেছেন। রাশিয়ান জাতির জনক পিটার ১৬৯৮ সালে বিদ্রোহী হয়ে ওঠা ১২০০ বিশ্বাসঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরও ছিল চরম নির্যাতনমূলক। শুধু তাই নয়, সতর্ক বার্তাস্বরূপ বিশ্বাসঘাতকদের লাশ প্রকাশ্যে টাঙিয়ে রাখা হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদেরও ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পরে উচ্চ আদালতের রায়ে প্রচলিত পদ্ধতিতেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এমনকি জনগণের চরম ঘৃণা ক্রোধ থাকা সত্ত্বেও হত্যাকারীদের কবরস্থ করার সুযোগ দেওয়া হয়। যা হোক, মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে একমাত্র পদ্ধতি যার মাধ্যমে সমাজের অপরাধীদের নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব। মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি যতটা নিবারণমূলক অন্য কোনো শাস্তি ততটা নয়। বিশ্ববরেণ্য অপরাধ বিজ্ঞানী Garofalo-এর মতে, মৃত্যুদণ্ড অবলোকনে অন্য ব্যক্তিরা আপনা থেকেই সংশোধিত হয়ে যায়। কারণ মৃত্যুদণ্ড তাদের কাছে যেন এক সমূহ বিপদ সংকেত। যে সংকেত সহজে উপেক্ষীয় নয়। বস্তুত, নির্মম হত্যাকারী মৃত্যুদণ্ড ভোগ করলে বিচারপ্রত্যাশী জনগণ খুশি হয়। তাদের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তাবোধ জাগ্রত করে। মৃত্যুদণ্ডও প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থার অন্যতম দৃষ্টান্ত। যদিও প্রতিশোধমূলক নীতি শাস্তির ক্ষেত্রে ক্রমে পরিত্যক্ত হয়ে আসছে, তারপরও এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। কেননা, কোনো ব্যক্তি হত্যা করে যদি কারাগারে কিছুকাল থাকার পর মুক্তি পেয়ে যায় তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ তৃপ্ত হয় না, বরং তারা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে প্রতিশোধ নিতে চায়। তাই মৃত্যুদণ্ড প্রতিশোধমূলক হলেও এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

তাছাড়া মৃত্যুদণ্ড সামাজিক সংহতিকে দৃঢ়তর করে। প্রকৃত অপরাধী মৃত্যুদণ্ড ভোগ করলে সমাজে ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি হয়। ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ মৃত্যুদণ্ডই কেবল সুগম করতে পারে। মৃত্যুদণ্ড মারাত্মক অপরাধীদের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করে। অপরাধীকে পুনরায় অপরাধ করার সুযোগ দেয় না। সেহেতু সমাজ অপরাধীর কার্যকলাপ থেকে রেহাই পায়। যদিও ইউরোপের ৩৪টির মতো দেশ মৃত্যুদণ্ডের প্রচলন বাতিল করেছে। তারা বলছে, মৃত্যুদণ্ড সুস্থ মস্তিষ্কে স্বত্বঃস্ফূর্তভাবে আরেকটি হত্যাকাণ্ডের নামান্তর। এটা মানবিক মূল্যবোধ ও অনুভূতিকে আঘাত করে। মৃত্যুদণ্ডের নির্মম সাজা মানবীয় মূল্যবোধকে ঘায়েল করে। কিন্তু ইউরোপের বাস্তবতা আর আমাদের সমাজচিত্র এক নয়। এই দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আজ বাতিল হলে কাল হত্যার মিছিল বেরোবে। শাস্তির ধরন ও প্রকৃতিও অনেকটা পাল্টে গেছে। যেমন আদিম সমাজে ভয়ংকর শাস্তির মধ্যে ছিল অঙ্গচ্ছেদ। প্রাচীন ভারতেও কেউ চুরি করে ধরা পড়লে তার হাত কেটে দেওয়া হতো। মধ্যপ্রাচ্যে আজও এ আইনের প্রচলন থাকলেও পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালিসহ অনেক দেশে লোহা পুড়িয়ে অপরাধীর গায়ে ছাপ দেওয়ার রীতিই প্রচলিত ছিল। ১৮২৯ সালে নির্মম এ শাস্তি বিলোপ করা হয়। পিলোরি অর্থ কাঠ নির্মিত শাস্তিস্তম্ভ। এর মধ্যে অপরাধীর মাথা ও হাত ঢুকিয়ে আটকে রাখা হতো। ১৮৩৭ সালে এ প্রচলনও বিলুপ্ত করা হয়।

নিঃসঙ্গ কারাবাস : কারাবাসের চেয়ে অধিকতর কষ্টদায়ক শাস্তি হলো নিঃসঙ্গ কারাবাস। এ ধরনের শাস্তির ক্ষেত্রে অপরাধীর সামাজিক জীবনকে সম্পূর্ণভাবে অবদমিত করা হয়।

লেখক : সহকারী সম্পাদক বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর