সোমবার, ৩ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

ষড়যন্ত্র বাংলাদেশকে থামাতে পারবে না

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

ষড়যন্ত্র বাংলাদেশকে থামাতে পারবে না

কয়েক দিন আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের একজন রিপোর্টার আমার সাক্ষাৎকারের জন্য আসেন। বিষয় জানতে চাইলে তিনি আমাকে একটা ভিডিও দেখান। ভিডিওটি তৈরি করেছে জার্মানভিত্তিক সংবাদ সংস্থা ডয়চে ভেলে। ভিডিওটির মূল বার্তা হচ্ছে- বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য, যারা এক সময়ে র‌্যাব বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন এবং সেখানে দায়িত্ব পালনকালে বিচারবহির্ভূত  হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, তারা এখন জাতিসংঘের শান্তি মিশনে আছেন, যা জাতিসংঘের মৌলিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অর্থাৎ বহু কৌশলে বলার চেষ্টা করা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘের মিশন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর আগে একটি দৈনিকের একজন সাংবাদিক একই বিষয়ে আমার সাক্ষাৎকার নেন এবং তাতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে প্রশ্ন করেন, এর ফলে কি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন বাংলাদেশের জন্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে। একজন সাংবাদিকের মনে যখন এরকম প্রশ্ন তৈরি হয় তখন অন্যান্য মানুষের মনেও একই রকম প্রশ্ন তৈরি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। পত্রিকার সাংবাদিককে আমি বলেছি, দেশি বা বিদেশের কিছু সংবাদ সংস্থা কর্তৃক এ ধরনের একপেশে এবং উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার চালিয়ে বাংলাদেশের জন্য শান্তি মিশন বন্ধ করতে পারবে না, সামান্যতম কোনো সুযোগ নেই। যারা এটা করেছে, হতে পারে তারা জাতিসংঘের শান্তি মিশনের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানে না, অথবা হতে পারে নিজস্ব দূরভিসন্ধিমূলক কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এটা করেছেন। সম্পূর্ণ ভিডিওটি দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবেন অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার জন্য এটা করা হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন, জনমানুষ ও সেনাবাহিনীর সাধারণ সদস্যদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেওয়াটাও একটা উদ্দেশ্য। ঢাকার অদূরে রাজেন্দ্রপুরে অবস্থিত জাতিসংঘের মিশনের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভিডিও ধারণ, সেখানকার কমাড্যান্ট ও সেনা সদরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার দেখলে প্রথমভাগে অনেকের কাছে মনে হতে পারে খুব সৎ উদ্দেশ্যে বোধ হয় ডিভিওটি তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে ডয়চে ভেলের পূর্বে নেতিবাচক প্রচারণা সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা এবং আলোচ্য ভিডিওটির শেষাংশ পর্যন্ত যারা দেখবেন তাদের সবার কাছে ডয়চে ভেলের অসৎ উদ্দেশ্য বুঝতে কিছু বাকি থাকবে না। ভিডিওটির শেষাংশে দেখা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যিনি আগে র‌্যাব বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন এবং বর্তমানে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে নিয়োজিত আছেন, তিনি কিছু কথা বলছেন। ওই অফিসারের চেহারা ভিডিওতে দেখানো হয়নি। একটি ছায়াসংবলিত ও ভৌতিক চেহারার সঙ্গে অডিও বার্তাটি প্রচার করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, ওই অফিসার বলছেন, তিনি র‌্যাবে কর্মরত থাকার সময় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যায় অংশ নিয়েছেন এবং এমনো ঘটনা আছে যেখানে ভিকটিমের রক্ত তার পোশাকে এসে লেগেছে। ভিডিওটি দেখার পর আমি বলেছি এখানেই ডয়চে ভেলে ধরা খেয়েছে। সেনাবাহিনীতে দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা এবং জাতিসংঘের শান্তি মিশনের অভিজ্ঞতা থেকে এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি, চাকরিরত একজন অফিসার এমন কথা মিডিয়াতে কখনো বলবেন না, বলতে পারেন না। যদি কেউ কোনো অপরাধ করেও থাকে, তা সে যে কারণেই হোক, তাহলে নিজেই সেই অপরাধের স্বীকারোক্তি নিজ ইচ্ছায় মিডিয়াতে বলে দেবেন, তা একেবারেই অযৌক্তিক ও উদ্ভট। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির সুপার উৎকর্ষতার যুগে একজনের গলার স্বর চিহ্নিত করা মোটেও কষ্টকর কিছু নয়, যে কথা সবাই জানেন। সুতরাং ভৌতিক ছবির আড়ালে যে কথাগুলো প্রচার করা হয়েছে তা যে ডয়চে ভেলের নিজস্ব তৈরি তা বুঝতে বড় বুদ্ধিমান হওয়ার প্রয়োজন হয় না। ১৯৮৮ সাল থেকে শুরু করে বিগত ৩৬ বছরে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের যে আকাশচুম্বী সুনাম ও রেকর্ড রয়েছে তাতে ডয়চে ভেলে অথবা অন্য কোনো সংস্থা এবং দেশের কোনো উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার কাজে আসবে না। এ কথাটি ডয়চে ভেলেও জানে। কিন্তু জেনেও তারা এ অপকর্মটি করেছে। কারণ, তাদের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা। এটা তারা করছে বাংলাদেশকে ঘিরে বৈশ্বিক ভূরাজনীতির সমীকরণে তাদের নিয়োগদাতাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টার অংশ হিসেবে। বিভ্রান্তি দূর করার জন্য আরও একটু ব্যাখ্যা দিই। কোনো সংস্থা অথবা রাষ্ট্র ইচ্ছা করলেই শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশকে বাদ দিতে পারবে না। তার প্রথম কারণ জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অসাধারণ সাফল্যের রেকর্ড। যে কথা জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রকাশ্যে বলেছেন। দ্বিতীয়ত এরকম কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে জাতিসংঘের ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সেই প্রস্তাব পাস হতে হবে এবং সেই প্রস্তাবে যে কোনো ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ না ভোট দিলে তা পাস হবে না। বাংলাদেশ এখন আর বন্ধুহীন রাষ্ট্র নয়। সুতরাং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক প্রস্তাব কেউ উঠাবে বলে আমি মনে করি না। তবে কেউ উঠালে তা বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র কর্তৃক ভেটোতে পড়বে, কখনো পাস হবে না। সেই ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। তাতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের একাংশ এবং কিছু সুশীল নামধারী ব্যক্তি তখনো ছিল এবং এখনো জড়িত আছে। এ ষড়যন্ত্রের কবলে পড়েই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। তারপর দুই সামরিক শাসক ও তাদের উত্তরসূরি রাজনৈতিক পক্ষ রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র বদলে এখানে বাংলাদেশ নামে আরেকটি পাকিস্তানপন্থি ও আদর্শের রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করেছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশের ওপর গ্রেনেড হামলা তারই বহির্প্রকাশ। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে বিগত ১৫-১৬ বছরে বাংলাদেশ নিজস্ব শক্তিতে যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে এবং তার সঙ্গে চলমান বৈশ্বিক ভূরাজনীতির সমীকরণে বাংলাদেশের যে গুরুত্ব তাতে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক কোনো ষড়যন্ত্রই বাংলাদেশকে আর থামাতে পারবে না। দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ছিল, আছে এবং থাকবে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি শক্তিশালী থাকে তাহলে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করে কেউ সফল হবে না। হয়তো উন্নয়নের গতিধারাকে কিছুটা শ্লথ করতে পারবে। এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। দুর্নীতি ক্ষয়রোগের মতো। বাইরে থেকে এর প্রভাব সব সময় বোঝা যায় না। একজন সাবেক আইজিপি ও একজন সাবেক সেনাপ্রধানের দুর্নীতির বিষয়টি যেভাবে এখন সামনে এসেছে তা সরকার ও রাষ্ট্রের জন্য দুর্ভাগ্যজনক এবং ক্ষতিকর। তারা কতটুকু দোষী অথবা দোষী নয় তা কেবল আদালতই বলতে পারবে। তবে মানুষ এটাকে ভালোভাবে নিচ্ছে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা এবং তাতে যদি সফল হয় তাহলে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার থেকেও বড় অমরত্ব লাভ করবেন। কিন্তু বিষয়টি এখন অত্যন্ত কঠিন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। গোষ্ঠীতন্ত্র এখন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী হয়ে গেছে। স্বার্থহানি হতে দেখলেই তারা ভয়ানক ছোবল দিতেও পিছপা হবে না। বঙ্গবন্ধু যখন দেশের স্বার্থে, সারা জীবনের স্বপ্ন দেশের দুঃখী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে যুগান্তকারী বড় পদক্ষেপ নিলেন, তখন ওই গোষ্ঠীর ছোবলে সপরিবারে প্রাণ হারালেন। তবে এখনকার রাষ্ট্র, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। ওই ছোবলকারীদের প্রতিহত করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র ও ভূরাজনৈতিক সমীকরণের মধ্যে যথেষ্ট ব্যবস্থা এখন রয়েছে। শুধু প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধুর মেয়ের পাশে কিছু মানুষ, যারা ডানে, বামে, সামনে, পেছনে কামান আছে জেনেও শুধু লক্ষ্য বাস্তবায়নে যুদ্ধে নামতে দ্বিধা করবে না। এমন মানুষ বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্য এখনো অনেক আছে। দুর্নীতি বাংলাদেশের জন্য অনেক পুরনো সমস্যা। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় বাংলাদেশ টানা চারবার দুর্নীতিতে পৃথিবীর মধ্যে এক নম্বর হয়েছে। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। রাজনীতিকে সব বিবেচনায় শক্তিশালী করতে না পারলে দুর্নীতিমুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। মৌলিকভাবে রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের চরম বিভাজনই রাজনীতিকে দুর্বল করার প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। জাতির পিতা মানি না, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ছুড়ে ফেলে দিই, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত রাজনৈতিক মূল্যবোধকে পদদলিত করাই মূলত বিভাজিত রাজনীতি ও রাজনীতিকে দুর্বল করার জন্য দায়ী। কারা এগুলো করছে তাদের সবার সম্মিলিত চেহারা দেখা গেছে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার মতিঝিলে হেফাজতের সমাবেশে। এ সম্মিলিত গোষ্ঠীর বড় শত্রু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুর মেয়ে, দেশি-বিদেশি কারও অন্যায্য দাবির কাছে মাথানত করবেন না, তিনি মুচলেকা দিয়ে রাজনীতি করবেন না। তাই দেশি-বিদেশি বহু পক্ষ তাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্য বহু চেষ্টা করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে। যার নগ্ন বহির্প্রকাশ পুনরায় দেখা যায় বিগত জাতীয় নির্বাচনের সময়। নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য ওই সম্মিলিত গোষ্ঠী এমন চেষ্টা নেই, যা করেনি। কিন্তু বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশ যেখান থেকে যেখানে এসেছে, তার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্রহণযোগ্যতা এবং বৈশ্বিক আঞ্চলিক ভূরাজনীতির সমীকরণের বাংলাদেশের গুরুত্বের কারণে তাদের সব অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তারা থেমে নেই। ডয়চে ভেলের সাম্প্রতিক ভিডিও চিত্রটি তারই প্রমাণ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি সংস্কৃতির জোটবন্ধন বাংলাদেশের বড় রক্ষাকবচ।  এ কারণেই এ তিন উপাদানের ওপর অনবরত আঘাত করে চলেছে দেশীয় চক্রান্তকারী ও একাত্তরে পরাজিত পক্ষের উত্তরসূরিরা। কিন্তু বিগত ৫৩ বছরে প্রমাণিত হয়েছে ষড়যন্ত্র বাংলাদেশকে থামাতে পারবে না। অকস্মাৎ কোনো কারণে অঘটন ঘটলেও ফিনিক্স পাখির মতো পুনর্জন্ম নিতে পারে বাংলাদেশ, যার উদাহরণ ১৯৭৫ পরবর্তী ঘটনা এবং আজকের বাংলাদেশ।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

সর্বশেষ খবর