সোমবার, ৩ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

গণতন্ত্র কথা নয় চর্চার বিষয়

মোশাররফ হোসেন মুসা

গণতন্ত্র কথা নয় চর্চার বিষয়

বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলা শুরু করেছেন গণতন্ত্র হলো একটি সংস্কৃতি। সে জন্য গণতন্ত্র শুধু মুখে প্রচারের বিষয় নয়, অন্তরে ধারণের বিষয় এবং সর্বক্ষণ চর্চার বিষয়ও। জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে সেই চর্চায় অংশগ্রহণ করে।  একটি গণতান্ত্রিক দলের প্রাণ হলো নির্বাচন। তবে যারা বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায় তারা নির্বাচন বিশ্বাস করে না। তাদের মধ্যে একটি হলো চরম বামপন্থি; অপরটি হলো চরম ডানপন্থি। চরম বামপন্থিরা ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হলেও চরম ডানপন্থিরা ধর্মকে আশ্রয় করে বেশ বাড়বাড়ন্ত। চরম বামপন্থিদের বক্তব্য হলো- একটি দেশে শ্রমিক শ্রেণির মানসিকতাসম্পন্ন লোকের সংখ্যা কম থাকে। তাদের ভোটে কখনোই শ্রমিক দরদি নেতৃবৃন্দ নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে যেতে পারবেন না। অপরদিকে চরম ডানপন্থিদের বক্তব্য হলো- একটি মুসলিমপ্রধান দেশে প্রকৃত ইমান-আকিদাসম্পন্ন লোকের সংখ্যা সীমিত থাকে। তাদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে একজন খাঁটি মুসলমান কখনোই পার্লামেন্টে যেতে পারবেন না। সেজন্য বিপ্লব দরকার। বিপ্লবের পর বাছাইকৃত ব্যক্তিরা শাসনকার্য পরিচালনা করবেন। সে কারণে আসন্ন মহাবিপদ থেকে দেশকে রক্ষার জন্য নির্বাচন পদ্ধতি বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। ২০২৪ সালকে নির্বাচনের বছর বলা হচ্ছে। পৃথিবীর ৭০টি দেশে নির্বাচন হচ্ছে। প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী নির্বাচনে থাকছে। ভøাদিমির পুতিন ইতোমধ্যে শপথ নিয়েছেন। যদি ভারতে নরেন্দ্র মোদি এবং যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হন, তাহলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হোঁচট খাবে বলে অনেকে আশংকা প্রকাশ করছেন। নির্বাচন ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যত কথাই বলা হোক না কেন, দিন শেষে আমাদের গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলতে হয়। কারণ বর্তমান গতিশীল সমাজের যুগে এর চেয়ে উপযোগী মতাদর্শ দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া গণতন্ত্রের সুবিধা হলো এ মতাদর্শে অন্যান্য মতাদর্শ থেকে কল্যাণকর বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আওয়ামী লীগ সরকার এবং বিরোধী দল বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো ক্ষমতায় থাকার ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি দিলেও নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের পক্ষে কোনো রূপরেখা দিচ্ছে না। ধরা হয়, স্বাধীনতার পর ১৯৯১ সাল, ১৯৯৬ সাল, ২০০১ সাল ও ২০০৮ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। এটি রাজনীতিকদের জন্য বড়ই অবমাননাকর। কারণ নির্বাচনগুলো হয়েছে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দ্বারা। সবার জানা রয়েছে খ্রিস্টপূর্ব আমলে গ্রিক নগর রাষ্ট্র থেকে গণতন্ত্রের সূচনা ঘটে। তৎকালীন দার্শনিকরা গণতন্ত্রকে নিকৃষ্ট শাসনের মধ্যে উত্তম শাসন বলে বিবেচনা করতেন। মধ্যযুগে টমাস একুইনাস বলেছেন, যদিও রাজতন্ত্র একটি উত্তম সরকার; তবে সম্ভাব্য উত্তম সরকার হচ্ছে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্রের মিশ্র সরকার। তার কথার সত্যতা পাওয়া যায় মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডাসহ কিছুসংখ্যক ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে। তবে যেসব দেশ সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়েছে সেসব দেশে গণতন্ত্র বিলম্বে এসেছে (সম্ভবত এ কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা জেলখানায় থাকাকালীন এ সংকটটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি পূর্বেকার শ্বেতাঙ্গ শাসকদের সঙ্গে সমন্বয় করে সরকার পদ্ধতি চালু করেন)। ভারত ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ না করায় দেশটিতে নির্বাচন পদ্ধতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো লাভ করেছে। কিন্তু সর্বস্তরে গণতন্ত্রায়ণ হয়নি। সুষম নিয়মে সব রাজ্যে উন্নয়ন হচ্ছে না, জাতিভেদ-বর্ণভেদ দূর হয়নি, সর্বোপরি ধনী ও গরিবের বৈষম্য ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা দুরূহ ব্যাপার ছিল। বারবার সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন তার বড় প্রমাণ। তবে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর জবরদস্তিমূলক মানসিকতা এবং দলের পূর্বসুরিদের অন্ধ অনুসরণ মোটেই কাম্য নয়। কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা বর্তমানে ব্যক্তির শাসন নিয়ে এসেছে। এ ব্যবস্থা এখন তৃণমূল পর্যায়েও দৃশ্যমান হচ্ছে। সেজন্য একই সঙ্গে জাতীয় ও স্থানীয়তে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডিজাইন গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের আয়তন, ভৌগোলিক অবস্থান, ভূপ্রকৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে দুই ধরনের সরকারব্যবস্থাই বাস্তবায়নযোগ্য। তাহলো- কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থা। কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য বৈশ্বিক ও জাতীয় কাজ নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। আর যাবতীয় স্থানীয় কাজ (গ্রামীণ ও নগরীয়) স্থানীয় সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। অব্যাহত নগরায়ণ এখন কঠিন বাস্তবতা। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেজন্য জলবায়ুর বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য পরিকল্পিত নগরায়ণ জরুরি। প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিয়ে (তথা জেলা সরকার, নগর সরকার, ইউনিয়ন সরকার ইত্যাদি) স্থানীয় সরকারের কাজগুলো এককভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। লক্ষণীয়, শিক্ষক নির্বাচন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন, শ্রমিক সংগঠনের নির্বাচন, প্রেস ক্লাবের নির্বাচন, ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাচন ইত্যাদি যদি স্ব স্ব ব্যবস্থাপনায় হতে পারে তাহলে সামান্য ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন কেন স্থানীয় মানুষ করতে পারবে না! সেজন্য জাতীয় গণ্যমান্য ও গ্রহণযোগ্য রাজনীতিকদের নিয়ে জাতীয় নির্বাচনি বোর্ড এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে স্থানীয় নির্বাচনি বোর্ড  গঠন করতে হবে। এ ব্যবস্থা গৃহীত হলে জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বৃদ্ধিসহ নাগরিকবোধ জাগ্রত হবে। সেই সঙ্গে গড়ে উঠবে আস্থার সমাজ।

লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক

E-mail: [email protected]

সর্বশেষ খবর