শিরোনাম
শনিবার, ৮ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

আমার বন্ধু হুমায়ূন ফরীদি

ইমদাদুল হক মিলন

আমার বন্ধু হুমায়ূন ফরীদি

॥ দুই ॥

একটা সময়ে এক দিন দুদিন পরপরই ফরীদির ফ্ল্যাটে সন্ধ্যা কাটাতে যেতাম আমি। ফরীদি তখন ভিকারুননিসা নূন স্কুলের উল্টোদিককার একটা ফ্ল্যাটে থাকে। বিটিভিতে ফরীদিকে নিয়ে আমি ধারাবাহিক নাটক করছি। নাটকের নাম ‘ভূমিকা’। প্রডিউসার কামরুন নেসা হাসান। কামরুন নেসা হাসানের একটা ডাকনাম আছে। মহাভারতের চরিত্র, মেনকা। আমরা ডাকি মেনকা আপা। আমার এবং ফরীদির খুবই প্রিয় মানুুষ তিনি। ওই নাটক চলাকালীন দুই-একদিন পরপরই সন্ধ্যাবেলা ফরীদির ফ্ল্যাটে যাই। আড্ডায় আড্ডায় রাত হয়। ফরীদির কাজিন ‘পাখি’ নামের এক যুবক থাকে ফরীদির সঙ্গে। আমরা আড্ডা দেই, কখনো কখনো আড্ডায় সুবর্ণাও থাকে। আর নয়তো সে টিভি দেখে, নয়তো মোটকা একটা ইংরেজি পেপারব্যাক নিয়ে আড্ডার মধ্যেই আলাদা হয়ে যায়। আমি তখনো গেন্ডারিয়ায় থাকি। ছোট্ট লাল রঙের একটা মারুতি গাড়ি ছিল। চলতে চলতে প্রায়ই সেটার স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। শাহজাহান নামে একজন ড্রাইভার ছিল। সেটা আবার মহা গ্যাস্টিকের রোগী। রাত জাগতে পারে না। গাড়ি এবং ড্রাইভারের অজুহাত দেখিয়েও ফরীদির হাত থেকে ছাড়া পেতাম না। অনেকটা রাত হয়ে যেত। আর রাত হওয়া মানে ফরীদি না খাইয়ে ছাড়বে না। নিজের নিয়মিত পানটুকু সে ইতোমধ্যেই সেরে নিয়েছে। কিন্তু ফরীদি কখনো অস্বাভাবিক হয় না। আমি তাকে কখনো অ্যাবনরমাল হতে দেখিনি। কোনো কোনোদিন নিজে খেতে বসত না, আমাকে বসাত। রহমান খাবার রেডি করে দিচ্ছে, ফরীদি দাঁড়িয়ে আছে আমার পিঠের কাছে। এটা-ওটা তুলে দিয়ে যেন কোনো বাচ্চা ছেলেকে খাওয়াচ্ছে এমন আদুরে গলায় বলছে, ‘খা বাবু খা। মাগুর মাছটা অসাধারণ রান্ধে রহমান। খাইয়া দেখ।’ রহমানের রান্নার স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। সেসব দিনে যত রাতেই বাড়ি ফিরেছি, ফেরার সঙ্গে সঙ্গে ফরীদির একটা ফোন। ‘মিলন, আমি ফরীদি। পৌঁছাইছিস?’ বন্ধু বাড়ি পৌঁছালো কি না এই খবর না নিয়ে ফরীদি ঘুমাত না।

বিজয়নগরের গলির ভিতর একটা ফ্ল্যাটে থাকে ফরীদি। ‘গ্রেটওয়াল চায়নিজ রেস্টুরেন্টের উল্টোদিকে গলিটা। মাত্র সিনেমায় নেমেছে। নেমেই মাত করে দিয়েছে। শহিদুল ইসলাম খোকনের একটা ছবিতে দোতলা থেকে লাফ দিয়ে পড়ার দৃশ্য। খোকন সাহেব বললেন, ‘ড্যামি ব্যবহার করব। ফরীদি বলল, ‘আরে না। আমি নিজেই লাফ দেব।’ ইউনিটের সবাই না করল। ফরীদি কেয়ার করল না। আঠার ফুট উঁচু থেকে দিল লাফ। পা ভেঙে ফেলল। প্লাস্টার করা পা নিয়ে বাসায় শুয়ে থাকে। আমি রোজ যাই ফরীদিকে সঙ্গ দিতে। এক দিন এক বোতল রেডওয়াইন খেলাম দুই বন্ধু মিলে। রেডওয়াইন কোনো নেশার জিনিস না। অ্যালকোহলের পরিমাণ তিন-চার পার্সেন্ট। ইউরোপ আমেরিকা জাপান অস্ট্রেলিয়ায় লোকে ডিনারের সঙ্গে খায়। আমিও খেয়েছি অনেক। কিন্তু ফরীদির সঙ্গে রেডওয়াইন খেয়ে আমি সেদিন কিঞ্চিত এলোমেলো হয়ে গেলাম। ফরীদির হলো না কিছুই, আমি এলোমেলো। এ কথা সে কথা বলতে বলতে এক সময় দেখি একটা কথাই বারবার বলছি, ‘বুঝলি ফরীদি, তোরচে’ সুবর্ণাকে আমি বেশি ভালোবাসি।’ ফরীদি শুনছে আর হাসছে। কিন্তু এক কথা কতবার শোনা যায়। ফরীদি এক সময় গম্ভীর গলায় বলল, ‘হ হ বুজছি। তুই অহন যা।’ ওই সময় এক দিন বাচ্চুভাই আর শিমুল এলো ফরীদিকে দেখতে। আমিও আছি। সেদিনের আড্ডা মানে শিমুলের গান। খালি গলায় একটার পর একটা গান গাইল শিমুল। এই গান, সেই গান। শেষদিকে গাইল লতা মুঙ্গেশকরের একটা সিনেমার গান, ‘ইয়ারা সিলি সিলি’। সেই গান এখনো আমার কানে লেগে আছে। কী যে সুন্দর গাইল শিমুল!

আমার প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘কোন কাননের ফুল’ প্রথম পর্ব প্রচারিত হয়েছে। বিটিভিতে আমি বসে আছি দুলালের রুমে। ফরীদি এসে হাজির। ‘ওই, আমি এই নাটকে অভিনয় করুম।’ ফরীদি তখন দুর্বিনীত, হইচইপ্রিয়, ঠোঁটকাটা। কিন্তু অভিনেতা হিসেবে সবাইকে জয় করে ফেলেছে। আমি ভালো রকম একটা ফাঁপরে পড়ে গেলাম। গল্পের পরিকল্পনা করে ফেলেছি। ফরীদিকে এখন কোথায় নেব? দুলালকে বললাম। দুলাল বলল, ‘নিতে পারলে খুব ভালো হয় দোস্ত। অভিনয় কইরা ফাটাইয়া ফালাইবো।’ আমি গল্পের পরিকল্পনা বদলে ফেললাম। নতুন করে লিখতে শুরু করলাম। দ্বিতীয় পর্বের শেষ দৃশ্যে অযথাই ফরীদিকে এনে দাঁড় করাল দুলাল। ফরীদির চেহারায় ফ্রিজ করল। অর্থাৎ ‘আসিতেছে’। তখনো পর্যন্ত আমি জানিই না ফরীদিকে নিয়ে কী লিখব? তার চরিত্র কী? কোন পর্ব থেকে সে স্ক্রিনে আসবে!

শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ এর নাট্যরূপ দেওয়ার জন্য আমাকে ডাকলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। আমি তখন টিভি নাটক লেখা শিখিইনি। মামুন ভাই ধরে ধরে শেখালেন। এ নাটকের ‘রমজান’ হচ্ছে ফরীদি। সত্যি সত্যি অভিনয় করে সে ফাটিয়ে ফেলল। মামুন ভাইয়ের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় ছিলেন আল মনসুর। সঙ্গে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রডিওসারও ছিলেন, তিনি একজন অভিনেতাও। নামটা আমি ইচ্ছা করেই বলছি না। আউটডোর শুটিংয়ে গেছি আমরা। শুটিং চলছে। বিটিভির বাসে বসে আড্ডা দিচ্ছি আমি ফরীদি আর ওই অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রডিওসার। কী কথায় ভদ্রলোক খুবই আফসোস করে বললেন, ‘এদেশে ভালো শিল্পীদের মূল্যায়নই হয় না। এই যে আমি এতদিন ধরে এত অভিনয় করলাম, কত ভালো ভালো চরিত্রে অভিনয় করেছি, আমার কোনো মূল্যায়নই হলো না।’ শুনে ফরীদি সেই ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে নির্বিকার গলায় বলল, ‘আপনেরে অভিনয় করতে কইছে কে? আপনের অভিনয় কোনো অভিনয়? এই অভিনয়ের আবার মূল্যায়ন? আপনের অভিনয় নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত।’ সেই লোক হতভম্ব আর আমি মুখ নিচু করে হাসতে লাগলাম। কলকাতার গায়ক নচিকেতা ফরীদির খুব ভক্ত। ঢাকায় প্রোগ্রাম করতে এসে সে ফরীদির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। রাতে খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। ফরীদি আমাকে ফোন করল। ‘আয়। নচি আসছে।’ গেছি। নচিকেতা একটা হারমোনিয়াম নিয়ে প্যা পো করছে। দুচার লাইন গান শোনাচ্ছে। শ্রোতা ফরীদি সুবর্ণা আর আমি। একসময় নচিকেতা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। সুনীলদা তাকে পছন্দ করেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে আমি কলকাতায় গিয়ে সুনীলদার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ঠিক করে দেব।’ ফরীদি তখন আর কিছু বলল না, আমি বাড়ি আসার পর ফোন করল। ‘ওই ব্যাটা, নচিকেতা কে রে, যে ওরে সুনীলদা পাত্তা দিব?’ ফরীদির হিসাব ছিল এই রকম।

‘ভূমিকা’ ধারাবাহিক করছি। ফরীদি প্রধান চরিত্র। সে সিনেমার শুটিং করতে চলে গেল কক্সবাজার। আমাকে বলল, ‘কক্সবাজার চইলা আয়। আমি শুটিং করুম, তুই হোটেলে বইসা লেখবি। রাতে দুই বন্ধু আড্ডা দিমু।’ একা একা বাসে করে আমি কক্সবাজার চলে গেলাম। যেদিন গেলাম, আমাকে পাওয়ার আনন্দে ফরীদি শুটিংয়েই গেল না। হোটেলে বসে দুই বন্ধু দিনভর আড্ডা দিলাম। দুপুরবেলা রাজকীয় খাবার এলো। বড় একটা ট্রেতে বিশাল এক কাতল মাছের মাথা। এত বড় মাছের মাথা আমি কোনোদিন দেখিনি। ভয় পেয়ে গেলাম। এই জিনিস কজনে খাবে? ফরীদি বলল, ‘তোর জন্য দিতে বলছি। খা।’ অসাধারণ টেস্টি রান্না। কিন্তু এত বড় জিনিস একা খাব কী করে? ফরীদিকে বললাম, ‘চল দুজনেই খাই।’ ফরীদি সিগ্রেট টানতে টানতে বলল, ‘আমার ভাল্লাগে না। তুই খা।’ চার ভাগের এক ভাগও আমি খেতে পারলাম না।

তিন-চার দিন থাকলাম ফরীদির সঙ্গে। যে কাজে গেছি সেই কাজের কিছুই হলো না। একটা লাইনও লেখা হলো না। আমার ঘুম ভাঙে খুব সকালে। সাড়ে পাঁচটা-ছটা বাজে। পাশের রুমে ফরীদি ঘুমাচ্ছে। রুম লক করে ভোরবেলার স্নিগ্ধ আলোয় বিশাল বালিয়াড়ি ভেঙে সমুদ্রের দিকে হাঁটতে গেলাম। দুই-তিন ঘণ্টা এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরেছি। ফরীদি চা-নাশতা নিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখে বলল, ‘কই গেছিলি?’ বললাম। শুনে ফরীদি কথা বলল না। মুহূর্তকাল কী ভাবলো! প্রথম দিনই সকালবেলার সমুদ্র আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে। পরদিনও একই সময়ে গেছি। ভোরবেলার সমুদ্র গভীর নির্জন। কোথাও কেউ নেই। আমি একা একা হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি বেশ অনেকটা পেছনে দুজন লোক। আস্তে ধীরে হাঁটছে তারা। আমি কোথাও দাঁড়ালে তারাও দাঁড়ায়। আমি যতক্ষণ সমুদ্রতীরে থাকলাম তারাও থাকল দূরে দূরে। বুঝতে পারলাম না কিছুই। ফিরে আসার পর ফরীদি বলল, ‘কেমন বেড়াইলি?’ বললাম, ‘খুব ভালো।’ ‘কী কী দেখলি?’ ‘কী দেখব? সমুদ্র?’ ‘আর কিছু দেখছ নাই?’ ‘না তো!’ ‘ফরীদি অবাক। দেখছ নাই কিছু?’ আমি মজা করে বললাম, ‘দুইটা লোক দেখছি। তারাও সি বিচে গেছিল।’

‘কী করছে লোক দুইটা?’ ফরীদির আগ্রহে আমি অবাক। কোথাকার কোন দুটো লোকের কথা বললাম, ফরীদি তাদের নিয়ে এত আগ্রহ দেখাচ্ছে কেন? বললাম, ‘দূরে দূরে ছিল।’ ‘তোর দিকে চোখ রাখছে?’ ‘আমার দিকে চোখ রাখব ক্যান?’ ফরীদি হাসল। ‘রাখছে, রাখছে। তুই বুঝতে পারছ নাই। লোক দুইটারে আমি তোর পেছনে লাগাইয়া রাখছি। ওরা তোর বডিগার্ড। সকালবেলা এইরকম নির্জন জায়গায় তুই যদি কোনো বিপদে পড়ছ, ওরা তোরে সেভ করব। দুইজনেই গানম্যান।’ শুনে আমি স্তম্ভিত। এই ছিল হুমায়ূন ফরীদি। এই ছিল ফরীদির বন্ধুত্ব।

তিন-চার দিন কেটে গেছে, সারা দিন ‘ভূমিকা’ লেখার চেষ্টা করছি, লেখা হয় না। এক দিন দুপুরের পর রুমের বারান্দায় বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছি। ফরীদি এলো। মুখটা ম্লান। চোখে হতাশার দৃষ্টি। আমি অবাক। ‘কী রে?’ ‘শুটিং প্যাকাপ কইরা দিছি। মনটা ভালো না। তুই মন খারাপ করিছ না। কান্নাকাটি করিছ না।’ আমার বুকটা ধক করে উঠল। ‘কী হইছে ফরীদি?’ চোখের জল সামলাতে সামলাতে ফরীদি বলল, ‘ইলিয়াস ভাই মারা গেছেন!’ ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস?’ ফরীদি সিগ্রেটে টান দিয়ে মাথা নাড়ল। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খুবই ভক্ত ফরীদি। ইলিয়াস ভাইও ছিলেন ফরীদির ভক্ত। তাঁর মৃত্যু সংবাদে আমরা দুটি বন্ধু তারপর স্তব্ধ হয়ে রইলাম। ফরীদি উদাস গলায় বলল, ‘খবরটা শোনার পর আর শুটিং করতে ইচ্ছা করল না। চল ঢাকা চলে যাই।’

এই ছিল ফরীদি।

‘খুঁজে বেড়াই তারে’ নামে একটা ধারাবাহিক করব। শুটিং করব বিক্রমপুরের কুমারভোগ গ্রামে। আমাদের গ্রামের পাশের গ্রাম। বাড়িটা আমার এক বড় ভাইয়ের। শীতকাল। ভয়াবহ শৈত্যপ্রবাহ চলছে। ফরীদি ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট আছে। কিন্তু চরিত্রটি ফরীদি ছাড়া আর কারও পক্ষে করা সম্ভব না। একে ঠান্ডা তার ওপর গ্রাম। পাঁচ দিন একনাগাড়ে থেকে শুটিং করতে হবে। ফরীদির মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করবে আমার বড় মেয়ে নির্বাচিতা হক। তীব্র শীতে আউটডোরে থেকে শুটিং করে না ফরীদি। দিনেরবেলা করে, সন্ধ্যার আগে আগে ফিরে আসে। সবই আমি জানি। তবু গেলাম ফরীদির ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে। বললাম তাকে। শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। ‘তোর মেয়ে অভিনয় করব? সারা দিন শুটিং করে সন্ধ্যায় ফেরা যাবে না?’ ‘যাবে কিন্তু পরদিন শুটিং শুরু করতে দেরি হয়ে যাবে। তোর পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে যাবে। শীতেরবেলা, দুপুরের পরই সন্ধ্যা। কাজ হবে না।’ ফরীদি আর কিছুই ভাবল না। বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’ পাঁচ দিন সেই গ্রামের বাড়িতে থেকে একটানা শুটিং করল ফরীদি। কী যে শীত পড়েছে তখন, দুপুর হয়ে যায় কুয়াশা কাটে না। অবিরাম ইনহেলার স্প্রে করছে ফরীদি আর শুটিং করছে। নাটক শেষ করে আমার মেয়েকে ডেকে বলল, ‘তুমি আমার বন্ধুর মেয়ে, তোমার সম্মানে এরচে’ও বেশি শীত আমি উপেক্ষা করতাম।’ এই ছিল ফরীদি।

বিটিভিতে আবদুল্লাহ আল মামুনের রুমে ঢুকেই ফরীদি বলল, ‘কী রে মামুন, কেমন আছিস?’ মামুন ভাই মুহূর্তের জন্য চমকালেন, তারপরই বিনীত ভঙ্গিতে ওঠে দাঁড়ালেন, ‘জি ভালো আছি। আসুন, আসুন ফরীদি ভাই।’ দুজনেই তুখোড় অভিনেতা। অভিনয়টা নিখুঁত হলো। তারপরই ফরীদির বিখ্যাত ঠা ঠা করা হাসি। আমি বসেছিলাম মামুন ভাইয়ের সামনে। দুজনের অভিনয়ে এমন হতভম্ব হয়েছি, কথা বলতে পারছি না। ফরিদুর রেজা সাগরের রেস্টুরেন্ট ‘খাবার দাবার’ ছিল আমাদের আড্ডার জায়গা। ফরীদি প্রায়ই আসত। সাহিত্য পাঠের নেশা আছে। আমরা তখন শীর্ষেন্দুর লেখায় খুব মজেছি। শীর্ষেন্দুর ‘ঘুণ পোকা’ আমার কাছ থেকে পড়তে নিয়ে হারিয়ে ফেলল ফরীদি। আমার তখন একটা সাহিত্যিক ভাব হয়েছে। কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করে কথা বলি। ফরীদিকে গম্ভীর গলায় বললাম, এসব বালখিল্যতার মানে হয় না। এখনো শব্দটা ভোলেনি ফরীদি। মাঝেমধ্যেই শব্দটা বলে ঠা ঠা করে হাসে। ফরীদির কমোডে সব সময় সিগ্রেটের পিছন দিকটা পড়ে থাকে। অর্থাৎ কমোডে বসে সে সিগ্রেট টানে, ফ্লাশ করার পর হয়তো সিগ্রেট শেষ হয়, কমোডে ফেলেই বেরিয়ে আসে। আমাকে এক দিন বলল, ‘তুই আমাকে নিয়ে একটা বই লেখ। খানিকক্ষণ পর বলল, বইটা কোত্থেকে শুরু করবি বল তো?’ আমি নির্বিকার গলায় বললাম, ‘তোর কমোড থেকে।’ শুনে ফরীদির সেই ঠা ঠা করা হাসি। ফরীদিকে নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যেতে পারি আমি। এত এত বছরের বন্ধুত্ব। এই এতদিনে কত আনন্দ-বেদনার স্মৃতি আমাদের, কত সুখ দুঃখের মুহূর্ত। কতরাত একসঙ্গে কাটিয়েছি আমরা, কতদিন! কত নাটক করেছি একসঙ্গে, কত গল্পকথা। ফরীদির বাইরেরটা সবাই দেখেছে, আমি তার ভিতরটা দেখেছি। ফরীদির ভিতর ফরীদির হাইটের চেয়ে অনেক অনেক বেশি উচ্চতার একজন মানুষ বাস করত। সেই মানুষ যেমন শিক্ষিত, তেমন মেধাবী, তেমন প্রতিভাবান, তেমন মানবিক, তেমন হৃদয়বান, তেমন তীক্ষè, তেমন ঠাট্টাপ্রিয়, তেমন স্পষ্টবাদী, তেমন বন্ধুবৎসল, তেমন নিঃসঙ্গ, তেমন দুঃখী। এক সন্ধ্যায় ফরীদির ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে গেছি। গিয়ে দেখি ফ্ল্যাটে কেউ নেই। ফরীদি একা একটি সোফায় বসে সিগ্রেট টানছে। এমন একা ফরীদিকে আমি কোনোদিন দেখিনি। আমার বুকটা হু হু করে উঠেছিল। কথায় কথায় ফরীদি বলল, ‘আমি মরে গেলে তোরা আমাকে দেখতে আসবি না।’ কোন অভিমানে বলেছিল কে জানে! আমি চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলাম।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ওই তো ওইখানে শুয়ে আছে ফরীদি। চারপাশে হাজার হাজার লোক। ফুল, শ্রদ্ধা, টিভি ক্যামেরা। দেশের কত কত বিখ্যাত মানুষ আসছেন, যাচ্ছেন। আমরা কয়েক বন্ধু দাঁড়িয়ে আছি ফাঁকা একটা জায়গায়। আরেফিন দিদার আলম ইফতেখার ফিরোজ সারোয়ার হানিফ সংকেত, আনোয়ার হোসেন বুলু। আমি ফরীদির মৃত মুখ দেখিনি। এত মানুষের মধ্যে থেকে একা হয়ে গেছি। মন চলে গেছে ফেলে আসা জীবনে। কত দিনকার কত স্মৃতি, কত আনন্দ বেদনা, সুখ-দুঃখ হাসি মজার কথা মনে পড়ছিল। শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে আমরা সবাই কাঁদছিলাম। ফরীদি আমাকে ডাকত ‘বন্ধু’। আমি তাকে ডাকতাম ‘বন্ধু’। ফরীদি, আমাদের ছেড়ে তুই কোথায় চলে গেলি, বন্ধু?

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর