শনিবার, ৮ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী থেকে গরুর খামারি

শাইখ সিরাজ

তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী থেকে গরুর খামারি

শিল্প-কারখানায় নরসিংদীর পলাশ উপজেলার খ্যাতি অনেক আগে থেকেই। বাণিজ্য ও শিল্পের প্রসারে সেখানকার গ্রামগুলো অনেকটা শহরের মতোই। সপ্তাহখানেক আগে গিয়েছিলাম শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে পলাশের ভিরিন্দা গ্রামে। ওখানে এক তরুণ ব্যবসায়ী গড়ে তুলেছেন আধুনিক এক গরুর খামার। গিয়েছিলাম সেই খামারটি দেখতে।

আমাদের দেশে কোরবানিকে ঘিরে গরু মোটাতাজাকরণের একটি শক্তিশালী অর্থনীতির বলয় গড়ে উঠেছে গত এক দশক ধরে। একেবারে গ্রামের সাধারণ গৃহিণী থেকে শুরু করে শিক্ষিত তরুণ এমনকি শিল্পোদ্যাক্তাদের কেউ কেউ যুক্ত হয়েছেন গরু মোটাতাজাকরণ কার্যক্রমে। গ্রামের একজন গৃহিণী হয়তো একটি দুটি গরু লালনপালন করে কোরবানির সময় বিক্রি করে সারা বছরে এককালীন একটা নগদ অর্থের ব্যবস্থা করতে পারে, এতে তার সংসারে সচ্ছলতা আসে, নিজেরও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটে। কিংবা যে শিক্ষিত তরুণটি চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেই স্বাবলম্বী হওয়ার একটা অবলম্বন খুঁজে নিয়েছে গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পে তারও চোখভর্তি স্বপ্নের স্ফূরণ এ কোরবানিকে ঘিরে। গত কয়েক বছরে দেখেছি বেশকিছু উদ্যোক্তা গরুর খামারকে রূপ দিয়েছেন শিল্প-কারখানার আদলে। মাংসের জন্যই হোক কিংবা দুধ উৎপাদনের জন্যই, শিল্পোদ্যোক্তাদের হাত ধরে এক বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে গবাদি পশু খাতে। এ সময়ে প্রাণিসম্পদ খাতে তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, বাড়ছে এ খাতে শিল্পোদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ। কোনো একটি খাত সম্প্রসারণ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সরকারের নীতি সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তার প্রমাণ সারা দেশে বেড়েছে গরুর খামারের সংখ্যা। বছর পাঁচ আগেও আমরা কোরবানির গরুর জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। এখন নিজেরাই উৎপাদন করছি।

পলাশে যে খামারটি আমি দেখতে গিয়েছিলাম সেই খামারটি গড়ে তুলেছেন ইছাদ চৌধুরী। তিনি মূলত সফল তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী। ২০২০ সালে করোনার লকডাউনের সময় কিছু করার ছিল না। সে সময়টায় তিনি ভাবলেন কৃষি নিয়ে কিছু একটা করা যাক। শৈশব থেকে কৃষির প্রতি তার অনুরাগ। ইছাদ চৌধুরী বলছিলেন, ‘বাবা কৃষি ভালোবাসতেন। তিনি কখনোই টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠান মিস করতেন না। তাঁর সঙ্গে বসে আমিও দেখতাম। তখন থেকেই গরুর খামার করার স্বপ্ন মনে মনে ছিল। করোনার অবসরে ২০টি গরু দিয়ে শুরু করি গরুর খামার। শুরুর আগে সকালের খাবার টেবিলে স্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলছিলাম। কী নাম হতে পারে খামারের? সে বলল, ছোট বয়সে সবাই গরুকে হাম্বা ডাকে, তুমি খামারের নাম দাও হাম্বা ফার্ম। শুরু হলো হাম্বা ফার্মের যাত্রা।’

ইছাদ চৌধুরীর বয়স ৪০ কি ৪২ হবে। নতুন কিছু করার প্রত্যয় তার চোখে মুখে। আছে নিষ্ঠার দৃঢ়তাও। তাকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলাম হাম্বা ফার্মে। দূর থেকে দেখলে হাম্বা ফার্মকে মনে হবে কোনো শিল্প-কারখানা। ইছাদ চৌধুরীকে নিয়ে ঘুরে দেখলাম তার খামারটি। দেখে বুঝলাম খামারটিতে প্রাণিসম্পদ লালন পালনের স্বাস্থ্যগত বিধিমালা কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়।

করোনার লকডাউনে নেওয়া উদ্যোগটি এখন বেশ বড় আকারের খামারে পরিণত হয়েছে। ২০টি গরু দিয়ে শুরু করে এখন ৩০০টি গরুর খামার। খামারটির বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সবকিছু পরিকল্পিত, গোছানো এবং পরিচ্ছন্ন। দেখেই বোঝা যায় প্রতিটি গরুর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশের দিকে নজর রাখেন উদ্যোক্তা।

স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরে বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাতে অভাবনীয় পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ করে গত ১০ বছরে একটা বিপ্লব ঘটে গেছে। গ্রামে তো বটেই, শহরতলী ও শহরেও গবাদিপশুর খামার গড়ে উঠেছে অসংখ্য। গরু মোটাতাজাকরণ ও দুধ উৎপাদন উভয় ক্ষেত্রে খামার বেড়েছে। খামারিরা নানান জাতের গরু লালন-পালন করছেন। বৈধ-অবৈধ উপায়ে দেশে আনা হচ্ছে বিদেশি জাতের গরু। হচ্ছে গরুর সংকরীকরণ। তবে এ খামারি গুরুত্ব দিচ্ছেন শাহীওয়াল জাতের গরু লালনপালনে। খামারের কর্মীদের জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থাপনা।

বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বেই খামারের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। আমাদের দেশের খামারিরা নিজেদের মতো করে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন। প্রাণী খাদ্যের দাম নিয়ে কয়েক দিন আগে কথা বলছিলাম ঢাকার ভাটারায় অবস্থিত নর্থবেঙ্গল ডেইরির স্বত্বাধিকারী প্রকৌশলী মকবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনিও বলছিলেন খামার ব্যবস্থাপনায় সুপরিকল্পনা ও পরিমিতি বোধ জরুরি।

হাম্বা ফার্মে সুবিধা হচ্ছে- তাদের রয়েছে নিজস্ব জমিতে প্রচুর ঘাস উৎপাদনের সুযোগ। পরিকল্পিত বলেই উদ্যোক্তার কাছে খামারের লাভ-লোকসানের হিসাব একেবারে স্পষ্ট। খামারে বিনিয়োগ করছেন ভেবেচিন্তেই। আগামীর বাণিজ্য কৃষিতে এ কথা তিনিও বিশ্বাস করেন। সম্ভাবনাময় বলেই সফল পোশাক ব্যবসায়ী হয়েও এ উদ্যোক্তা গরুর খামারে বিনিয়োগ করেছেন। রয়েছে তার সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। তিনি শুধু কোরবানির গরু উৎপাদনকে মাথায় রেখে তার খামার পরিচালিত করতে চান না। আরও বহুদূর যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তিনি বললেন, সারা পৃথিবীতে খাদ্যের চাহিদা কখনো ফুরাবে না। আর মানসম্পন্ন কোনো কিছু উৎপাদন করতে পারলে তার চাহিদা থাকবেই। এ চিন্তা থেকেই আমি খামার বড় করছি। আমার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য গরুর মাংসের আন্তর্জাতিক বাজার ধরার। এ ছাড়াও আমি গাড়লের খামারও করব। দুগ্ধ খামার করার ইচ্ছা আছে। পাশাপাশি আমি দুগ্ধজাত পণ্য তৈরির কারখানাও করতে চাই।

বিদেশে মাংসের রপ্তানির বাজার পেতে নিশ্চিত করতে হবে নিরাপদ মাংস উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সরবরাহের পরিবেশ। তা না করতে পারলে, বিদেশিরা আমাদের মাংস নেবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাইরের দেশগুলোতে আমাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মান নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। সেসব সন্দেহ দূর করার জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। মাংস রপ্তানির লক্ষ্যে, খামারিদের আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পশুপাখি পালনে উদ্বুদ্ধকরণ, প্রশিক্ষণ দেওয়া ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের খামারিদের সঙ্গে কথা বলে যা জেনেছি, তা হলো বাজারে গবাদিপশুর খাদ্যের দাম অনিয়ন্ত্রিত। প্রয়োজনে ভেটেরিনারি ডাক্তারের পরামর্শ পাওয়া যায় না। গবাদিপশু লালন-পালনে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী অনেক তরুণ আমাকে প্রচুর ফোন ও ইমেইল পাঠায়। বেকার অনেকেই যুক্ত হতে চান গবাদিপশু লালন-পালনে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ কোথায় পাবেন- এমন প্রশ্ন অনেকের। গবাদিপশু লালন-পালনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা যেমন বাড়াতে হবে, দেশব্যাপী আধুনিক খামার স্থাপন ও মাঠপর্যায়ে আরও বেশি ভেটেরিনারি ডাক্তার নিয়োগ দিয়ে খামারিদের দোরগোড়ায় প্রাণীসেবা নিশ্চিত করাসহ সার্বিক বিষয়ের বাস্তবায়নে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। সবচেয়ে বড় কথা, মাংস রপ্তানির বিষয়টি সরকারি পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাহলে এ খাত আমাদের অর্থনীতির শক্তিশালী একটা খাত হয়ে উঠবে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।

আবহমান বাংলা ও বাঙালির ঐশ্বর্য বোঝাতে ‘গোলাভরা ধান’ এর পরেই ‘গোয়ালভরা গরু’র কথা আসে। আজ কৃষি সমৃদ্ধি ও বাণিজ্যের যুগেও এ ঐতিহ্য হারিয়ে যায়নি বরং সারা দেশে প্রান্তিক কৃষিজীবীর ঘরে একটি দুটি দুধের গরু কিংবা দুয়েকটি মাংসের গরু তার আর্থসামাজিক নিরাপত্তা হিসেবেই কাজ করে। এর পাশাপাশি ভিতরে ভিতরে ইছাদ চৌধুরীর মতো শিক্ষিত তরুণদের হাতে বিনিয়োগমুখী বাণিজ্যিক খামার সম্প্রসারিত হচ্ছে। একেকটি প্রাণিসম্পদের খামারও যেন এখন একেকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর