শনিবার, ৮ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

কমাতে হবে ঢাকার ওপর জনসংখ্যার চাপ

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

কমাতে হবে ঢাকার ওপর জনসংখ্যার চাপ

নগরমুখী মানুষের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৭১ সালে ৭ শতাংশ মানুষ নগরে বাস করত। ২০০১ সালে তা ২৩ দশমিক ১০ শতাংশ হয়। ২০২২ সালে ৩১ দশমিক ৫১ শতাংশে দাঁড়ায়। এ হিসাবে নাগরিক জনসংখ্যা এখন ৫ কোটি ২০ লাখ ১০ হাজার। ২০৪১ সালের মধ্যে নগরে জনসংখ্যার হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। নগরে বেপরোয়া লোকসংখ্যা বৃদ্ধি উদ্বেগজনক। নগরে নাগরিক সুবিধা তুলনামূলকভাবে বেশি। এটা গ্রাম থেকে মানুষের নগরে আসার একটি কারণ। কর্মসংস্থানের সুযোগ এর মধ্যে প্রধান।

ঢাকা নগরের গত অর্ধশতাব্দীতে অবিশ্বাস্য রকম সম্প্রসারণ ঘটেছে। স্বাধীনতার আগে যেখানে এ নগরে কয়েক লাখ লোক বসবাস করত, সেখানে এখন লোকসংখ্যা ২ কোটির ওপর। কিন্তু নগর যতই বাড়ুক সেই তুলনায় সেবা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি। গ্যাস সংকট, পানি সংকট, বিদ্যুৎ সংকট, পরিবহনের সংকট, জলাবদ্ধতার সংকট ইত্যাদি নগরজীবনকে বিপর্যয়কর করে তুলেছে।

নগর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক গড়ে উঠলে এবং নাগরিক সেবা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ঢাকাসহ বড় নগরগুলোতে মানুষের মিছিল আপনা-আপনিই ছোট হয়ে আসত। নগরের সেবা-সুবিধা গ্রামে গেলে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া মানুষ নগরমুখী হতো না। এটা অস্বীকার করা যাবে না, কর্মসংস্থানের প্রত্যাশা নিয়েই সাধারণত মানুষ গ্রাম থেকে নগরে পদার্পণ করে। নানানরকমের কাজের সুযোগ আছে নগরে, যেটা গ্রামে নেই। কুলি, মিস্ত্রি, রিকশাচালক, ঠেলাওয়ালা হওয়ার সুযোগ আছে নগরে। নির্মাণ শ্রমিকসহ নানা ক্ষেত্রে শ্রমিক হওয়ার সুযোগও আছে। গ্রামে যাদের জমি-জিরাত কম বা নেই, যারা সুবিধামতো কাজও পায় না, তারা কোনো কিছু না ভেবেই নগরমুখী হয়, বস্তিতে আশ্রয় নেয় এবং কোনো না কোনো কাজ করে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করে। গ্রামে যদি বিদ্যুৎ-গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের শিল্পের বিস্তার ঘটানো যায়, আয়-রোজগারের বিবিধ উপায় সৃষ্টি করা যায় তাহলে গ্রাম ছেড়ে মানুষ নগরে আসবে না।

আমাদের প্রায় সবকিছু নগরকেন্দ্রিক। অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যাদি নগরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। এসব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। প্রয়োজন ও আকর্ষণ মানুষকে নগরমুখী হতে বাধ্য করছে। নগরে তাদের আসা রহিত করতে চাইলে ব্যাপকভিত্তিক বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি গ্রামে কর্মসংস্থান ও নাগরিক সুবিধাদি সহজলভ্য করার বিকল্প নেই।

বিশ্বের যেসব মহানগরীর জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে ঢাকা তার একটি। প্রতিদিন ঢাকার বাসিন্দা হিসেবে যোগ হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ জন। প্রতি মাসে ঢাকার জনসংখ্যা বাড়ছে ৫১ হাজার, বছরে ৬ লাখেরও বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীতে প্রতি একরে ৭০০ থেকে ৮০০ মানুষের বসবাস। কিন্তু এ নগরীর চারটি এলাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ। এ চারটি এলাকা হচ্ছে- লালবাগ, বংশাল, গেন্ডারিয়া ও সবুজবাগ। এসব এলাকায় প্রতি একরে বাস করে প্রায় ৮০০ মানুষ। মেগাসিটির মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতি একর আয়তনে জনসংখ্যা থাকার কথা ১২০।

সব ধরনের সেবা রাজধানীকেন্দ্রিক হওয়ায় মানুষ ভিড় জমাচ্ছে ঢাকায়। সরকারি অফিস-আদালত, সেরা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংকের হেড অফিস, ভারী ও মাঝারি শিল্প-কারখানাসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় মানুষের সামনে কোনো বিকল্প পথ নেই। এ ছাড়া অনেক শিল্প-কলকারখানা রাজধানী এবং এর আশপাশে হওয়ায় বিশাল জনগোষ্ঠীর বাস রাজধানী ও সংলগ্ন এলাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হাই কোর্ট, আবহাওয়া অধিদফতর, বন ভবন, খাদ্য ভবন, পানি ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় সহজেই স্থানান্তর বা বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়। কিন্তু কোনো সরকার এতে আগ্রহ দেখায়নি। এ ছাড়া বিভাগ ও অন্য জেলাগুলোতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করলে মানুষ আপনা-আপনিই ঢাকা থেকে স্থানান্তরিত হবে। এতে এ নগরী ধীরে ধীরে বাসযোগ্যতা ফিরে পাবে।

ঢাকা মহানগরী ৬০ বছর আগেও ছিল সবুজ সমৃদ্ধ এক জনপদ। সেই নগরী ক্রমেই ইট-কংক্রিটের স্তূপে পরিণত হচ্ছে। বিশ্বের অন্যতম নোংরা নগরী হিসেবে ঢাকার পরিচিতি কিছুতেই হটানো যাচ্ছে না। একসময় ঢাকায় ‘রাতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়ে ঢাকায় আছি’ কথাটি প্রবাদবাক্য হয়ে উঠেছিল। রাজধানীতে মাছির উপদ্রব কমলেও মশার উপদ্রব সেই সাত দশক আগের মতোই প্রকট। ঢাকা বিশ্বের শীর্ষ যানজটের নগরীগুলোর একটি। ফুটপাতেও নেই হাঁটার পরিবেশ। দূষণ ও অস্বস্তিকর জীবনের কারণে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে। বসবাসের অযোগ্য নগরী, ইট-কংক্রিটের বস্তি ইত্যাদি নানা অভিধা সত্ত্বেও ঢাকার জনসংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না ঢাকামুখী জনস্রোত। বসবাসের অযোগ্য নগরী হওয়া সত্ত্বেও মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে পেটের দায়ে। কর্মসংস্থানের সিংহভাগ সুযোগ ঢাকায় হওয়ায় বাধ্য হয়ে আসছে তারা। এ প্রবণতা ঠেকাতে রাজধানীর বাইরে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে হবে দেশের প্রতিটি প্রান্তে। ছোট শহরগুলোতেও নাগরিক সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে।

আসলে পরিকল্পিত নগর বলতে বুঝায় একটি পরিকল্পিত জনবসতি, যার সবকিছু হবে পরিকল্পনা অনুযায়ী। পরিকল্পনা না থাকলে কিছু করা সম্ভব হবে না। রাজধানীতে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। বিল্ডিং নির্মাণ করতে হবে অবশ্যই রাজউকের নকশা অনুসারে। ভবনের পাশে খালি স্থান না রেখে ইচ্ছামতো ভবন নির্মাণ করা যাবে না। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু ঢাকা নয়, দেশের অন্যান্য শহরকেও পরিকল্পনামাফিক গড়ে তুলতে হবে। সুষম উন্নয়ন করতে হবে গ্রামেও। শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ কমাতে এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ

সর্বশেষ খবর