রবিবার, ৯ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা কর্মীদের কান্না

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা কর্মীদের কান্না

চলতি ২০২৪ সালের প্রথম দিনটা শুরু হয়েছিল একজন ইটভাটা শ্রমিকের করুণ মৃত্যুর খবর দিয়ে। আগের দিন (৩১ ডিসেম্বর ২০২৩) বরগুনার আমতলী উপজেলার কালিবাড়ী গ্রামে একটি ইটভাটায় শিকলে বেঁধে সরদার ও তার সঙ্গীরা নির্মম নির্যাতন চালান ৫০ বছর বয়সি শ্রমিক আনিস গাজীর ওপর। দুই মাস আগে ইটভাটার সরদার সালাম চৌকিদারের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা আগাম বা দাদন নিয়েছিলেন আনিস গাজী। কথা ছিল- শ্রমের বিনিময়ে এ টাকা শোধ করবেন তিনি। কিন্তু টানা ১৫ দিন কাজ করার পর বাড়ি গিয়ে আর ফিরে আসেননি আনিস গাজী। এরপর সরদার তাকে বাড়ি থেকে তুলে এনে শিকলে বেঁধে নির্যাতন চালান। আর এভাবেই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শোধ হয় আনিসের ঋণ।

এমন শ্রমিক নির্যাতনের নজির বেশ পুরনো। ২০১১ সালে আশুলিয়ার পাড়াগাঁও নামক গ্রামের একতা ইটভাটা থেকে উদ্ধার করা হয় শিকলবন্দি ২৭ শ্রমিককে। তবে সবচেয়ে করুণ বিষয় হলো সেখানে ছয় বছরের মেয়ে নিপা আক্তারকেও পায়ে শিকল বেঁধে রাখা হতো, যাতে তার মা-বাবা না পালান। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে রাতে পায়ে শিকল লাগিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হতো শ্রমিক সবুজ আলীকে (৩৬)। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শিকলবন্দি এমন চার ইটভাটা শ্রমিককে উদ্ধার করা হয় স্থানীয় এফবিএম ইটভাটা থেকে।

২০২১ সালে পিরোজপুর থেকে ৮ ও ৯ বছরের দুটি শিশুসহ মোট চারজন শ্রমিককে শিকলবন্দি অবস্থা থেকে উদ্ধার করা হয় ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে। ২০২২ সালে নারায়ণগঞ্জের ইটভাটা থেকেও শিকলবন্দি শ্রমিককে উদ্ধার করা হয় ৩০ হাজার টাকা অগ্রিম নেওয়ার কারণে। একই জেলার আড়াই হাজারে লোহার ঢালাই কারখানায় দুই মাস শিকলবন্দি ছিলেন শ্রমিক আনোয়ার হোসেন। অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য পরিচালিত অভিযানের সময় তাকে উদ্ধার করা হয়।

দেশের এমন কঠিন বাস্তবতায় একদল নারী-পুরুষ জীবনবাজি রেখে পাড়ি জমায় বিদেশে। সেখানেও অনেক ক্ষেত্রেই ঘটে নানা বিপত্তি। লিবিয়ায় শ্রমিকদের বন্দি করে মুক্তিপণ আদায় কিংবা ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়ে ও দুবাইয়ের ডান্স বারে এ দেশের কিশোরী, তরুণী ও যুবতীদের বিক্রি করে দেওয়ার তথ্যও সংবাদ শিরোনাম হয় কদিন পর পর।

আইনত ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত হলেও ভিন্নরূপে শ্রমিকদের ভাগ্যে আদিম ও বিকৃত ক্রীতদাস প্রথা যে আজও চেপে আছে তার আরেক প্রমাণ মালয়েশিয়া গমনে ব্যর্থ সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিকের করুণ উপাখ্যান। সম্ভাব্য আয়ের কথা না ভেবে কেবল রঙিন স্বপ্ন আর দালালের প্রলোভনে বিশ্বাস করে তারা লাখ লাখ টাকা তুলে দেন আদম ব্যাপারীর আধুনিক রূপ রিক্রুটিং এজেন্সি নামক নির্দয় ও নিষ্ঠুর একদল লোভী মানুষের হাতে। তারা সরকারি আইন, রীতিনীতি ও মানবিক বিবেচনা আমলে না নিয়ে নানা অজুহাতে টাকা আদায় করে বিদেশে শ্রম বিক্রয়ে আগ্রহী শ্রমিকদের কাছ থেকে। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজ অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন এবং মন চাইলেও দেশে আসার ইচ্ছাকে দমন করেছেন শুধু অভিবাসন খরচ তোলার প্রচেষ্টায়। বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ সুদে এ টাকা সংগ্রহ করেন গরিব ঘরের শ্রমিকরা। তাই বিদেশে যাওয়া মাত্র সব শ্রমিককে খেয়ে না খেয়ে অভিবাসন ব্যয় সমন্বয়ের জন্য শ্রম বিক্রি করতে হয়, যা প্রকারান্তরে দাসপ্রথার শামিল।

মালয়েশিয়ায় শ্রমিক প্রেরণে দুর্নীতি ও অনিয়মের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। ২০০৯, ২০১৬ ও ২০১৮ সালে দেশটির শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছিল একমাত্র দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে। এতে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো প্রকার ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। এ থেকে কোনো শিক্ষা না নিয়ে আমরা আবারও অসহায় ও দরিদ্র পরিবারের হাজার হাজার সন্তানকে ঢুকিয়ে দিলাম সিন্ডিকেট নাটক দানবের গুহায়। এ দানবগুলোই টুঁটি চেপে আদায় করেছে ইচ্ছামতো টাকা। অথচ মার্চ মাসে মালয়েশিয়া থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পর স্পষ্টতই বোঝা গিয়েছিল যে ৩১ মে এর মধ্যে এত সংখ্যক শ্রমিককে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে এবং সব এয়ারলাইনসের বিমানের প্রচলিত ফ্লাইট ব্যবহার করে পাঠানো সম্ভব নয়। আজ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও এ কথাটি বলছেন। কিন্তু তা বোঝার পরও শ্রমিকদের কাছ থেকে শেষ মুহূর্তেও কেন টাকা নেওয়া বন্ধ করা গেল না, তার উত্তর নেই।

মালয়েশিয়ায় শ্রমিক প্রেরণের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার বেশি নেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু বাস্তবে ইচ্ছামতো টাকা নেওয়া হয়েছে শ্রমিকদের কাছ থেকে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ টাকার অঙ্ক ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এ টাকা অবৈধভাবে নেওয়া হয়েছে বিধায় কোনো ধরনের প্রাপ্তি স্বীকারপত্র বা মানি রিসিট কোনো শ্রমিককে দেওয়া হয়নি। সুতরাং তাদের পক্ষে এখন আর কোনো টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। অন্যদিকে মালয়েশিয়ারও একটি সংঘবদ্ধ চক্রের চাহিদা মোতাবেক শ্রমিকদের কাছ থেকে সংগৃহীত টাকার একটি বড় অংশ অবৈধ পথে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়েছে বলে খবর এসেছে গণমাধ্যমে। সুতরাং শ্রমিকদের ঋণ করে, জমি বিক্রি করে কিংবা শেষ সম্বল হিসেবে রাখা অলংকার বা ঘরের গরু বিক্রি করে সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দেওয়া টাকা ফেরত পাওয়ার কার্যত কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে মালয়েশিয়া যখন শ্রমবাজার খুলে দেয়, তখন বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারি কর্মকর্তারা একমত হয়েছিলেন যে, একজন অভিবাসনপ্রত্যাশী ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকায় তার বিদেশযাত্রা সম্পন্ন করতে পারবেন। তবে বাস্তবে দেখা যায় উভয় দেশের সিন্ডিকেট, এজেন্ট, স্বাস্থ্য পরীক্ষাকারী, বিমানের টিকিট প্রদানকারীসহ নানা নামের উপসর্গ প্রায় ছয় গুণ বেশি টাকা আদায় করেছেন শ্রমিকদের কাছ থেকে। সবচেয়ে বড় কথা হলো- টাকা নিয়েও নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে শ্রমিক পাঠাতে পারেনি এ সিন্ডিকেট বা এজেন্সি। ফলে মালয়েশিয়া যাওয়ার শেষ দিনে ঢাকা বিমানবন্দরের আকাশ ভারী হয়ে উঠেছিল স্বপ্নের বিদেশযাত্রায় ব্যর্থ শ্রমিক ও তাদের নিঃস্ব পরিবারের সদস্যদের কান্নায়। বাড়ি ফেরার পথে বাবার চোখের সামনে চলন্ত ট্রেন থেকে নদীতে ঝাঁপ দেয় হতাশ এক শ্রমিক। এমন করুণ ঘটনাও ভবিষ্যতে প্রতারণা কমাবে বলে আশা করা যায় না। আজ কর্তাব্যক্তিরা কতজন যেতে পারেনি বা ঢাকার বিমানবন্দরে সর্বোচ্চ কতজন দাঁড়াতে পারে, তা নিয়ে বাহাসে নেমেছেন। তিন মাসে পাঠানো সম্ভব নয় জেনেও সরকারের কে বা কারা এ সিন্ডিকেটে বা এজেন্টদের শ্রমিকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার সুযোগ করে দিল সে কথা বলছেন না কেউ।

শ্রমিকদের এ বুকফাটা কান্নার নেপথ্যে থাকা মানুষ নামের নিষ্ঠুর দানব সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ মো. হাসিম। তার মতে, ‘আমাদের এখানে সিন্ডিকেট থাকতে পারে, যা বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া উভয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।’ অন্যদিকে দায়ীদের স্বরূপ সন্ধানে নেমে দেশের বিভিন্ন মিডিয়া যে সিন্ডিকেটগুলোর সন্ধান পায়, তার শীর্ষ চারটির মালিক বর্তমান মহান সংসদের চারজন সম্মানিত সদস্য ও তাদের একান্ত নিকটজনেরা। তাই দুঃখ নিয়ে বলতে হয়- জনপ্রতিনিধিদের কারণে আমজনতার চোখে কান্না বড় বেমানান।

চার বছর বন্ধ থাকার পর খুলে যাওয়া মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে ৫ লাখ কর্মী পাঠানোর সুযোগ এসেছিল ২০২২ সালেও। তবে তা কাজে লাগাতে পারেনি এ খাতের সংশ্লিষ্টরা। তখন চার মাসে মালয়েশিয়া ১ লাখ শ্রমিকের চাহিদা দিলেও বাংলাদেশ পাঠাতে পেরেছে ৩ হাজার ৮২২ জন। একই সময়ে অর্ধেক খরচে প্রায় ৮০ হাজার শ্রমিক পাঠিয়েছে নেপাল। এ ব্যর্থতার দায়ে কারও কিছুই হয়নি। সরকারিভাবে (জি টু জি) শ্রমিক প্রেরণের প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। মাঝে সেনা কল্যাণ সংস্থার মাধ্যমে শ্রমিক প্রেরণের কথা থাকলেও তা মুখ থুবড়ে পড়ে। সাম্প্রতিক অঘটনের পেছনে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি নিয়েও বিস্তর প্রশ্ন উঠেছে।

পয়লা মে ছিল মহান মে দিবস বা শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকারের দিন। এ মাসের শেষ দিনের এ চিত্র কেবল ক্রীতদাসের কান্না আর আদম ব্যাপারীর অট্টহাসির কথাই মনে করিয়ে দেয়। দেশের অর্থনীতি যখন বৈদেশিক মুদ্রার দিকে চাতকের মতো তাকিয়ে আছে, তখন বিদেশে শ্রমিক প্রেরণ তথা রেমিট্যান্স প্রভাব বৃদ্ধির এ সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার নেপথ্য কুশীলবরা অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন বলেই গণ্য করা আবশ্যক। প্রথামাফিক তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। তবে অতীতের ইতিহাস তদন্ত কমিটির কার্যবিবরণী প্রকাশ বা কমিটির সুপারিশের বাস্তবায়ন দেখেনি। সময় এসেছে দেশের অর্থনীতির এক কঠিন সময়ে এমন লোভী আদম ব্যাপারী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের, যেন এমন সর্বনাশা মে মাস আর কখনো অসহায় শ্রমিকের জীবনে ফিরে না আসে।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

Email: [email protected]

সর্বশেষ খবর