সোমবার, ১০ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

একদিকে হযবরল, অন্যদিকে নজিরবিহীন রাজনীতি

জীবেন রায়

একদিকে হযবরল, অন্যদিকে নজিরবিহীন রাজনীতি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ বছরের নভেম্বরের ৫ তারিখে হবে জাতীয় ইলেকশন। কিন্তু ক্যাম্পেইন অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে। তবে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান- দুই দলেরই হযবরল অবস্থা।

প্রথমত, দুই প্রার্থীই ৭৭-৮১ বছর বয়সি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুই প্রার্থীরই অভিজ্ঞতা আছে, তবু বয়স তো একটা ফ্যাক্টর। মানসিক সুস্থতা রাষ্ট্রীয় প্রধানের জন্য অত্যন্ত জরুরি। দ্বিতীয়ত, দুই প্রার্থীই কিছু না কিছু বিচারিক সমস্যায় জর্জরিত। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতোমধ্যে ক্রিমিনাল কেসে কনভিক্টেড। জেলে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে।  তবে ইলেকশন করতে পারবেন।  তা ছাড়া ট্রাম্পের কথাবার্তা যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের জন্য ভীতিকর।

অন্যদিকে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেন একটা সিরিয়াস কেসে কোর্টে সওয়াল জবাব চলছে। তাতে বাইডেনের ভোটে প্রভাব ফেলতে পারে। সেই সঙ্গে রয়েছে বাইডেনের ইসরায়েলের প্রতি অবাধ সাপোর্ট। বর্তমানে ইসরায়েল সরকারের ওপর বাইডেনের প্রভাব নেই বললেই চলে। সেই সঙ্গে বাইডেন মানুষ মারার অস্ত্র এবং বোমা সরবরাহ করছেন ইসরায়েলে। আর সেগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে নিরীহ লোকজন, এমনকি শিশুদের মারার জন্য। এমন অবস্থা হয়েছে, নেতানিয়াহু বাইডেনের কোনো কথাই এখন শুনছেন না।

শুরুটা হয়েছিল ইসরায়েলে হামাসের অতর্কিত আক্রমণ থেকে। সেটা অবশ্যই অন্যায় ছিল। সেই হামাসকে নির্মূল করতে গিয়ে প্রায় ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন আর আহত হয়েছেন দ্বিগুণ। যুদ্ধটা তো সমানে সমানে নয়। একটা অসম যুদ্ধ চলছে মধ্যপ্রাচ্যে। এ যেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। নিরীহ বাংলাদেশি মরছে আর পালাচ্ছে। ফিলিস্তিনিরাও এখন তাই করছে। পার্থক্য, বাংলাদেশিদের পালানোর জন্য কোনো সুযোগ বা সময় দেওয়া হয়নি।

এ যুদ্ধটা সেই ৬০ বছর আগে ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র আকাশ থেকে বোমা ফেলছে আর ভিয়েতনামিরা বাড়িঘরে, মাঠে-ঘাটে মারা যাচ্ছে। যুদ্ধ কখনো কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে না। শুধু শুধুই জীবনহানি। তবে দেশ হিসেবে ভারত বিশ্বের কাছে নজির হয়ে থাকল। সম্প্রতি বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ, ভারতে ইলেকশন হয়ে গেল। পাঁচ সপ্তাহব্যাপী পর্যায়ক্রমে ভোটাভুটি হলো। ফলাফলও হলো। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গরিব-ধনী, মহিলা-পুরুষ, নানা জাতের, রঙের প্রায় ৯৬.৯ কোটি উপযুক্ত ভোটার নিয়ে ভারতে বেশ নির্বিঘ্নেই ইলেকশন শেষ হলো। উত্তেজনা ছিল কিন্তু কোথাও কারচুপি হয়নি, খুনোখুনি হয়নি।

আমাদের কলকাতার বন্ধু, অয়নাংশুকে ইমেইল করে তার মতামত জানতে চাইলাম। ওর কাছ থেকে দারুণ একটা বিশ্লেষণ এসেছে। মূলত পাঠকদের অয়নের বিশ্লেষণটা জানানোর জন্য আমার এই লেখাটা। অয়ন লিখেছে-

এটি একটি খুব মজার নির্বাচন :

১) বিজেপি উদযাপন করছে, কারণ তারা সরকার গঠন করছে।

২) কংগ্রেস উদযাপন করছে, কারণ তারা প্রায় ১০০ আসনে পৌঁছেছে।

৩) সমাজবাদী পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা পার্টি উদযাপন করছে কারণ তারা তাদের সমর্থন ফিরে পেয়েছে।

৪) ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি এবং শিবসেনা খুশি কারণ তারা দেখাতে পেরেছে যে তারা বস।

৫) তৃণমূল কংগ্রেস খুশি, কারণ তারা তাদের দলকে ব্যর্থ হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে।

৬) নাগরিকরা খুশি যে তারা যে দলকেই অনুসরণ করছে তারাও খুশি।

৭) এর আগে কখনো কংগ্রেস এবং বিজেপি উভয়কেই তাদের হেডকোয়ার্টারে এসে একই দিনে জয় উদযাপন করতে দেখা যায়নি।

৮) এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- নির্বাচন কমিশন উদযাপন করছে- যে কেউ এখন ইভিএম অথবা অন্য কোনো কারচুপির অভিযোগ দিচ্ছে না।

একেই তো বলা হয় সবার সহযোগিতা- সবার উন্নয়ন। তবে আমার কথা, একজন হাসতে পারেননি বরং তিনি কেঁদেছেন। তিনি হলেন বুথফেরত সমীক্ষার সিইও।

ভারতের এই ইলেকশন থেকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক কিছু শেখার আছে। ভারতের সঙ্গে শুধু শুধু বৈরিতা না করে মেলামেশা করুন। জানুন, শিখুন। ভারতীয় পণ্য না ব্যবহারের জিকির তোলেন কেন? বরং মহিলাদের রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করুন। কংগ্রেস পার্টি এর আগে দুটো ইলেকশন করেছে। কিন্তু তারা ভালো ফল করতে পারেনি। তাই বলে দমে যায়নি। আর এবার একটা দারুণ ফল করেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে বিএনপি একের পর এক ইলেকশন বর্জনই করে যাচ্ছে। এ দলটি ক্রমান্বয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক দেশে এখন কোনো বাইরের শক্তি এসে ক্ষমতায় বসিয়ে দিতে পারবে না। আর হরতাল বা প্রশাসনের মাধ্যমেও ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না।

রাজনীতিও এক জায়গায় বসে নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করতে করতে যে কোনো দলই সেই চর্চাটাই ভুলে যায়। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতেও ভুলে যায়। বিএনপির এখন নাম পাল্টে নতুন নাম নেওয়ার সময় এসে গেছে। যেমন মুসলিম লীগ, জাসদ- এসব দল কি আর ফিরে আসবে?

তাছাড়া বয়সের একটা ব্যাপার আছে না? সত্তর দশকে আমাদের কবি হেলাল হাফিজ বলেছিলেন,

“এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।”

সেই যোদ্ধারা এখনো বেঁচে থাকলে বয়সের ভারে নতজানু হয়ে গেছে হয়তো। তাছাড়া রাজনীতিবিদরা বেশি দিন ক্ষমতার বাইরে বা কাজকর্মহীন থাকলে, এমনিতেই জবুথবু হয়ে পড়ে। ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল দিতেই হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৫-১৬ সালে হঠাৎ একটা ভুল সিদ্ধান্তে একজন বেশ্যাকে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করেছিলেন।

সেই কর্মফলে তিনি সম্প্রতি কনভিক্টেড হন। ১১ জুলাই তার সাজা জানা যাবে।  অবাক হলেও সত্য, যেদিন এই রায় হয় সেদিন তার সাপোর্টারদের দেওয়া ফান্ডিং অনেক বেড়ে যায়। কোর্টে মামলা চলাকালে বিচারক গ্যাগ অর্ডার দেন (অর্থাৎ মামলা নিয়ে কোনো কমেন্ট বা উল্টাপাল্টা কথা বলা নিষেধ) বেশ কবার, কারণ তিনি বিচারক, প্রসিকিউটরসহ অনেককে ভয়ভীতির কথা বলতেন। তারপরও নভেম্বরে জনগণের ভোটে তিনি নির্বাচিত হতেও পারেন। রাজনীতি বিচিত্র, আরও বিচিত্র রাজনীতিবিদগণ।

 

লেখক : অধ্যাপক, বিজ্ঞান ও গণিত বিভাগ, মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যান, কলম্বাস, যুক্তরাষ্ট্র

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর