সোমবার, ১০ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

নেহরুর রেকর্ড ছুঁলেন মোদি, তবে...

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

নেহরুর রেকর্ড ছুঁলেন মোদি, তবে...

ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির শীর্ষ নেতা নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি শপথ নিয়েছেন। মোদির এনডিএ জোট ২৯৩ আসন পেয়েছে লোকসভা নির্বাচনে। অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট পেয়েছে ২৩২টি আসন।  এনডিএ জোটের বিপরীতে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জন খাড়গের নেতৃত্বে ২৭টি দলের ইন্ডিয়া জোট গড়ে উঠেছিল নির্বাচন সামনে রেখে। এই জোটের প্রধান শরিক কংগ্রেস একাই ১০০টি আসন দখল করতে পেরেছে। নির্বাচনি প্রচারে মোদি দাবি করেছিলেন, এবার তারা ৪০০ আসন পাচ্ছেন। কিন্তু তিনি ৩০০-এর কাছাকাছি পৌঁছতে পারেননি।

ফল প্রকাশের আগে ধারণা করা হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের হ্যাটট্রিক উদ্যাপনে সক্ষম হবেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি বরাবর ছুঁতে আগ্রহী ছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর রেকর্ড। নেহরু ১৯৫২, ১৯৫৭ ও ১৯৬২ সালের নির্বাচনে জিতে তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেসের প্রতিটি জয়ই ছিল নিরঙ্কুশ। কারও সহায়তা ছাড়াই তিনি সরকার গড়েছিলেন। হ্যাটট্রিক করলেও তাকে জোট শরিকদের সাহায্য নিতে হয়েছে সরকার গঠনের জন্য। মোদি চেয়েছিলেন ১৯৮৪ সালের ভোটে রাজীব গান্ধীর জেতা ৪১৩ আসন টপকে নতুন রেকর্ড গড়তে। ৪০০ পার সেøাগানের অন্য লক্ষ্যও ছিল তা। দুই ইচ্ছার কোনোটিই পূরণ না হওয়া এবং এই জয় ‘অসম্মানের ও পরাজয়তুল্য’ বলে প্রচারিত হওয়ায় বিব্রত অবস্থায় ফেলেছে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে।

মালদহের এ আসনটি ১৯৬২ সাল থেকেই কংগ্রেসের দখলে। সেই ১৯৬২ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার এ আসনে জয়ী হয়েছিলেন বরকত গনি খান চৌধুরী। তার মৃত্যুর পর তার ভাই আবু হাসেম (ডালু) তিনবার সংসদ সদস্য হন। অসুস্থ থাকার কারণে তিনি এবার নির্বাচনে না দাঁড়িয়ে তার পুত্র ঈসা খান চৌধুরীকে দাঁড় করান। তৃণমূল বিজেপিকে হারিয়ে ঈসা খান চৌধুরী ১ লাখ ১৫ হাজার ভোটে জয়ী হয়েছেন। এটাই হলো মালদহের কোতোয়ালির খান চৌধুরী পরিবারের পরম্পরা।

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি, পাঁচবারের সংসদ সদস্য অধীর রঞ্জন চৌধুরী তৃণমূলের প্রার্থী তথা প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার ইরফান পাঠানের কাছে হেরে যান। আমার মনে আছে, কয়েক বছর আগে ঢাকার আওয়ামী লীগের নেতা আমির হোসেন আমু জিজ্ঞেস করেছিলেন, মালদহের গনির রহস্যটা কী? প্রত্যেকবার কী করে তিনি জিতে যান? আমি বলেছিলাম, তিনি সারা বছর জনগণের জন্য কাজ করেন। তাই মানুষ তাকে বিশ্বাস করে। তাই বারবার তাকেই ভোট দেয়। এবার নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট জোট করেছিল। সিপিএম এবারও খালি হাতে ফিরে এসেছে। কংগ্রেসের মানরক্ষা করেছেন মালদহের ঈসা। রাজনৈতিক দিক থেকে শুধু নয়, মমতা ব্যানার্জি একটা জিনিস পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তা হলো জনগণের জন্য কাজ করলে বিজেপির মতো পার্টিকে হারানো সম্ভব।

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গে ১৮ বার এসেছেন। দফায় দফায় এসেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও। সঙ্গে এসেছেন তাবড় তাবড় বিজেপি নেতা। তাদের টার্গেট ছিল ৩৫টি আসন। কিন্তু ফলাফলে দেখা গেল বিজেপি এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। এটা মমতার জন্যই সম্ভব হয়েছে। যারা তাকে এতদিন বঙ্গেশ্বরী বলে ঠাট্টা করতেন। এখন তারাও তাকে অগ্নিকন্যা বলতে শুরু করেছেন। ফল প্রকাশের পর মমতা সাংবাদিক বৈঠকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, দলে তার উত্তরসূরি হবেন তার ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জিই। ভাইপোকে তিনি সেভাবেই তৈরি করেছেন। সুতরাং মমতার এই ফল তাকে আরও শক্তিশালী করেছে।

একসময় ওয়াশিংটনের কর্তারা বলতেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দরকার নেই। কমিউনিস্টদের হটানোর দায়িত্ব তারা মমতার হাতেই তুলে দিয়েছিল। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনেও পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিপিএম এবং কংগ্রেসকে নিশ্চিহ্ন করেছিল। তাদের জায়গা নিয়েছিল বিজেপি। 

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভোটের মেরুকরণ করা মমতার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। রাজ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোটার যারা এতদিন ধরে সিপিএম কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় ছিলেন এবং সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেতেন তারা মনে করেন, বিজেপি নির্বাচনি প্রচারে যা বলেছেন, তা সবই সংখ্যালঘু বিরোধী। তাদের নিরাপত্তা দিতে পারেন মমতাই।

মমতা সরকারের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রচারের মূল হাতিয়ারই ছিল দুর্নীতির অভিযোগ। স্বয়ং মোদি কলকাতায় এসে বলেছিলেন, ১৭ রকমের দুর্নীতি করে মমতা ব্যানার্জির সরকার ১৭ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে।  তবে সেই অভিযোগ জনগণ যে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি তা ফলাফলেই স্পষ্ট। বেশ কয়েকজন  তৃণমূলের নেতা, মন্ত্রী এবং শীর্ষ আধিকারিক জেলে থাকা সত্ত্বেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে সক্ষম হয়েছে তৃণমূল।

 

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর