বুধবার, ১২ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

বাজেটে ধাক্কা সামলানোর ব্যবস্থা নেই

হাসানুল হক ইনু

বাজেটে ধাক্কা সামলানোর ব্যবস্থা নেই

আমরা গত কয়েক বছর ধরে একটা অস্বাভাবিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সময় পার করছি এবং এই অস্বাভাবিক সময়ে অর্থনীতিতে কিছু ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে। তার জন্য অর্থনীতি একটা ধাক্কার সম্মুখীন হয়েছে। আমাদের ধারণা স্বাভাবিক সময়ের রাজনীতি ও অর্থনীতির স্বাভাবিক যে ধারা, তা অনুসরণ করে অস্বাভাবিক সময় মোকাবিলা করা যাবে না। অস্বাভাবিক সময়ে স্বাভাবিক গতানুগতিকতার ভিতরে যদি আটকে থাকি তাহলে আমরা সংকট থেকে বেরোতে পারব না।  সেই হিসাবে বাজেট নিয়ে আমার প্রথম মন্তব্য, অস্বাভাবিক সময়ে গতানুগতিক একটা বাজেট আমরা পেয়েছি। গতানুগতিক এই অর্থে, একটা কাঠামোর মধ্যে কিছু জিনিসের শুল্ক কমানো, কিছু জিনিসের কর কমানো, কিছু জিনিসের দাম কমবে, কিছু জিনিসের দাম বাড়বে, এই খাতে ২ টাকা বাড়ালাম, ওই খাতে ৫ টাকা কমালাম, এটা একটা গতানুগতিক ছক, এটা ছিল, থাকবে। প্রতি বছর যেমন মানুষের বয়স বাড়ে, তেমনি বাজেটের আকারও বাড়ে। আজকে বাজেট যদি এক শত টাকা হয়, কালকে এক শত দশ টাকা হবে। সুতরাং এখানে কোনো নতুনত্ব নেই, গতানুগতিক। অর্থনীতিতে যে ধাক্কা আসছে, সেই ধাক্কা সামলানোর জন্য বাজেটে বিশেষ ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল। চলমান যে অর্থনৈতিক সংকটের ধাক্কায় আমরা বিপর্যস্ত এবং বাজারে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য, ডলার সংকট, সুদের হারের গন্ডগোল, ব্যাংকের বিশৃঙ্খলা, রাজস্ব আহরণে ধীরগতি এবং সমগ্র অর্থনীতিতে একটা অনাস্থা ভাব এবং অর্থনীতিতে সুশাসনের অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। একটা অর্থনৈতিক সংকটের ভিতরে আমরা সময় পার করছি। সে জন্য আমরা ধাক্কা সামলানো বাজেট আশা করেছিলাম।

অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, অস্বাভাবিক সময় পার করছি। উনি বলেছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। উনি বলেছেন, ডলার সংকট আছে। উনি বলেছেন, সুদহারে সমস্যা আছে, সব সমস্যা চিহ্নিত করেছেন উনি। কিন্তু সমস্যা সমাধানের বিষয়ে, পাতার পর পাতা দেখেও গতানুগতিক কিছু বরাদ্দের হেরফের এর বাইরে কিছু মেলেনি। ২০০৯ সাল থেকে অর্থনীতির কিছু জায়গায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকারের নেতৃত্বেই। যার জন্য অর্থনীতি বিদেশ নির্ভরতা থেকে অনেকটা স্বাবলম্বী ধারায় ফেরত এসেছে। কৃষি উৎপাদন চমৎকার উদাহরণ তৈরি করেছে। নিজ অর্থায়নে আমরা চমকপ্রদ অনেক কাজ করেছি। বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে, আইএমএফের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিদেশিদের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে অর্থনীতি পরিচালনা করার সক্ষমতা-যোগ্যতার পাটাতন কিছুটা তৈরি হয়েছে ২০০৯-২০১৮ এর মধ্যেই। গ্রামের কৃষি অর্থনীতির বহুমুখীকরণ, মাছ চাষ, মুরগি পালন, সবজি চাষ, ফল চাষ ইত্যাদিতে সাফল্য এসেছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত যাচ্ছি না। শুধু এ কথাটা বলতে চাচ্ছি যে, সবই ভালো হচ্ছিল। চরম আগুন সন্ত্রাসের মধ্যে, চরম জঙ্গিতা-বের ভিতরে, বৈশ্বিক মন্দার ভিতরে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল ১০ বছর আমরা উচ্চপ্রবৃদ্ধির হার অর্জন করেছি। আমরা মূল্যস্ফীতি প্রায় ৬ এর নিচে রাখতে সক্ষম হয়েছি। আমরা বিনিয়োগ বাড়াতে সক্ষম হয়েছি। এত রাজনৈতিক বিরূপ অবস্থায়, আন্তর্জাতিক বিরূপ অবস্থার মধ্যে আমরা উচ্চ প্রবৃদ্ধি রাখতে পেরেছি, প্রবৃদ্ধি ৮% এর ওপর চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে ২০১৮ থেকে ২০২৪ এই পাঁচ বছরে কী এমন ঘটল? হ্যাঁ কভিড-১৯ আছে, কভিডের ধাক্কা আছে, বিশ্বমন্দা আছে, সর্বশেষ ইউক্রেন যুদ্ধ এসেছে। এ জন্য মূল্যস্ফীতির যে ধাক্কা সেটাকে আমি আমদানি করা মূল্যস্ফীতি বলি। আমদানি করা মূল্যস্ফীতির ধাক্কা কত? ধরে নিলাম, এক শত টাকায় পাঁচ টাকা বাড়ল কিন্তু আমি দেখছি এক শত টাকার জিনিস এক শত বিশ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। আমরা আমদানি করা মূল্যস্ফীতি সহজে সামাল দিতে পারব না। কিন্তু দেশের ভিতরে যে অব্যবস্থাপনা, লুটেরা ও বখরাবাজদের দৌরাত্ম্যের কারণে যদি মূল্যস্ফীতি নাগালের বাইরে চলে যাওয়াটা দুঃখজনক।

এ মুহূর্তে অর্থনীতিতে একটা অনাস্থার ভাব, সুশাসনের অভাব বিরাজ করছে। গত কয়েক বছরে দারিদ্র্যবিমোচনে চমৎকার কিছু কাজ হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য বেড়েছে। এ জন্য আমরা বলছি, কিছু কাঠামোগত সমাধান করা দরকার। বৈষম্য কমানোর জন্য আমরা বারবার বলেছি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য এবং সামাজিক সুরক্ষা এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের অধিকার- এই পাঁচটি অধিকারকে সর্বজনীন অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তি করে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হোক। যাতে রাষ্ট্র বাধ্য থাকে স্বাস্থ্য খাতে, শিল্প খাতে, শিক্ষা খাতে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে, ইন্টারনেট খাতে একটা সর্বজনীন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। এই সর্বজনীন ব্যবস্থা গড়তে চার থেকে পাঁচ বছর লাগবে। বাজেটে আমরা আশা করেছিলাম, এসব খাতে সর্বজনীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য এই বছরে বাজেটে একটা বরাদ্দ দেওয়া হবে। দেশে অনেক কমিউনিটি ক্লিনিক আছে কিন্তু এটা সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা না। ঢাকা মহানগরের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কোনো ক্লিনিক নাই, স্বাস্থ্য কেন্দ্র নাই। শ্রমিক অঞ্চলে কোনো স্বাস্থ্যসেবা বা হাসপাতাল নেই। সবাইকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছুটতে হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে প্রেসক্রিপশন দিচ্ছি কিন্তু পরীক্ষা টাকা দিয়ে বাইরে থেকে করতে হচ্ছে। ওষুধ কিনতে হচ্ছে। প্রেসক্রিপশনের সঙ্গে ওষুধ, ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার খরচ যদি সরকার দেয় তাহলে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা খরচ কমে যাবে। স্বাস্থ্যসহ এসব খাতকে সর্বজনীন ব্যবস্থা মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করে একটা কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হলে বৈষম্য কমানোর পক্ষে একটা পদক্ষেপ হবে।

প্রয়োজন ছিল ধাক্কা সামলানোর বাজেট। প্রয়োজন ছিল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট বাজেট। এবার প্রবৃদ্ধি বাড়ানো নয়, দরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানোর বাজেট। আপনারা সবাই জানেন বাজেটে বেশি টাকা খরচ করলে, বাজারে সেই টাকা যাবে, এতে জিনিসের দাম বাড়বে। বাজেটে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকের থেকে ধার করা কমিয়ে, ঘাটতি শতকরা ৪.৫% থেকে ৩.৫% নামানো। এতে ঘাটতি আশি হাজার কোটি টাকা কমবে। প্রবৃদ্ধি ছয় এর ওপরে দরকার নেই, চার-পাঁচের মধ্যে রাখেন। উন্নয়নের লাগাম একটু টানুন। প্রায় দেড় হাজারের মতো প্রকল্প আছে। সেই প্রকল্পের কাটছাঁট করুন। যে প্রকল্প কাটছাঁট করলে কোনো অসুবিধা হবে না, সেটা কেটে স্বাস্থ্য খাতে, শিক্ষা খাতে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে   বাড়িয়ে মানুষকে একটা স্বস্তির জায়গা দেন।

আমরা যেটা বলতে চাচ্ছি, লোক দেখানো উচ্চ প্রবৃদ্ধি দরকার নেই। প্রবৃদ্ধি ৪%-৫% এর মধ্যেই রাখুন, কোনো সমস্যা হবে না। ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া কমিয়ে ফেলুন। যত কম ঋণ নেব, ততই ভালো। দেশীয় বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা খুব ভালো। দেশীয় বিনিয়োগের হার হচ্ছে জিডিপির ২৩%। এটা বাড়িয়ে ২৭% এর ওপরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। ২৭% এর ওপরে নিতে গেলে ৩ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। সে টাকা কোথা থেকে আসবে?

যারা কর দিচ্ছেন, তাদের ক্ষেত্রে কর আদায় ১৯/২০ করছেন। কর জাল বাড়াচ্ছেন না কেন? বিভিন্ন মহানগরে এক দেড় কোটি পরিবার আছে, যারা দেশের সম্পদের ৪৫% -এর মালিক, সেই অতি ধনী পরিবারগুলোকে করজালে আনেন। ইচ্ছাকৃত কর ফাঁকিবাজদের গলায় পা দিয়ে কর দিতে বাধ্য করেন। দাগি ঋণখেলাপিদের বিশেষ ট্র্যাইব্যুনালে নিয়ে গিয়ে দ্রুত একটা ব্যবস্থা করেন।

ইউনিয়ন পর্যায়ে তহশিল অফিস আছে। কিন্তু ভূমি থেকে রাজস্ব কত টাকা আসে? এত বছরেও উপজেলায় রাজস্ব অফিস নাই কেন? ইউনিয়নে রাজস্ব অফিস নাই কেন? প্রতিটি ইউনিয়নে কমপক্ষে ৫টি গ্রোথ সেন্টার আছে, যেখানে স্থায়ী দোকান নিয়ে অনেকে ব্যবসা করে, তাদের কর জালের মধ্যে আনেন। এতেও কয়েক লাখ কোটি টাকা আপনি রাজস্ব বাড়াতে পারবেন। ইলেকট্রনিক্স ফাইন্যান্সিয়াল ডিভাইস চালু করুন, না হলে কর চুরি বন্ধ করতে পারবেন না। সাত বছর আগে এসব কথা বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত সেই মেশিন অর্থমন্ত্রী দিচ্ছেন না। কর ফাঁকি বন্ধ করার জন্য কিছু করছেন না। অর্থমন্ত্রী ইন্টিলিজেন্স ফোর্সকে কাজে লাগাচ্ছেন না। রপ্তানি এক শত টাকা হলে, দেশে ফিরে পঁচাত্তর টাকা, বাকি পঁচিশ টাকা কোথায় যায়? তাহলে আয় বাড়াব কীভাবে? ডলার সংকট মিটাব কীভাবে?

রেমিট্যান্স আসছে হুন্ডিতে। ডলার-টাকার মান আর্টিফিশিয়ালি এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে হুন্ডি উৎসাহিত হয়। হুন্ডি ব্যবস্থা বন্ধের জন্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। ডলার-টাকার মান এমনভাবে ভারসাম্য করতে হবে যাতে হুন্ডিতে টাকা না আসে।

আমরা মনে করছি, ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের জন্য কিছু ড্রাস্টিক স্টেপ লাগে। একই সঙ্গে বলব, অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতির একটা সম্পর্ক আছে। সরকার বলছে, আধুনিক অর্থনীতি চাই, আরেক পক্ষ বলছে তালেবানি শাসন চাই। আমি বলছি, আধুনিক অর্থনীতি চাই, আর সরকার বিজ্ঞান শিক্ষার বিরুদ্ধে মিছিল অ্যালাউ করেন। হোয়াট ইজ দিজ? এভাবেই কি চলবে বাংলাদেশ? আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে দেবেন না, আধুনিক অর্থনীতি কীভাবে হবে, তালেবানি শাসন দিয়ে? অর্থমন্ত্রী সংস্কৃতিতে কাক্সিক্ষত বরাদ্দ দেননি। দেশে বাউলদের চুল কেটে দেওয়া হচ্ছে। তাদের আখড়া ভেঙে দেওয়া হচ্ছে, প্রশ্ন ওঠে, দেশে কার শাসন চলছে? বাংলাদেশে জঙ্গিবাদি, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর উত্থান হচ্ছে, এরা আধুনিক অর্থনীতির শত্রু। এখানে বিদেশিরা চক্রান্ত করছে, বিদেশিরা চক্রান্ত করলে অর্থনীতির কোথায় কোথায় চিমটি কাটতে পারে, সেটা আগাম চিন্তা করে, চিমটি কাটলে পাল্টা চিমটি কাটা, ধাক্কা দিলে, ধাক্কা পাল্টা ধাক্কা দেওয়ার ব্যবস্থা প্রস্তাবিত বাজেটে দেখিনি।

অর্থমন্ত্রী সামাজিক সুরক্ষায় দশ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়েছেন, চমৎকার। দশ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ছয় হাজার কোটি টাকা পেনশন এবং অন্যান্য খাতে যাচ্ছে। যেখানে ক্রাইসিস আছে, সংকট আছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি আছে, সেখানে গরিবদের বাঁচাতে সামাজিক সুরক্ষায় আরও বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। আমরা মনে করি, দেশে একটা বখরাতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে। লুটেরা চক্রের উত্থান হয়েছে। যারা বেপরোয়া, কোনো কিছু মানে না। অর্থনীতিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, সরকার, শাসন-প্রশাসনে এই ভাবটা ফিরিয়ে আনলে অর্থনীতি অনাস্থার জায়গা থেকে বেরিয়ে আসবে।

লেখক : সভাপতি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ

সর্বশেষ খবর