বুধবার, ১২ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

শাহবাগে আড্ডার সেই দিনগুলো

হোসেন আবদুল মান্নান

শাহবাগে আড্ডার সেই দিনগুলো

১৯৯৪-৯৫ সালে আমাকে একটা বাজে নেশায় পেয়ে বসেছিল। সন্ধ্যা হলেই বিনা কাজে শাহবাগে চলে আসতাম। তখন টিকাটুলির হোটেল ইলিশিয়ামে বাস করি। প্রথম তিন বছর উত্তরবঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরির পর অনেকটা আকস্মিকভাবে আমাকে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব পদে পদায়ন করা হয়। সরকারের পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে ইলিশিয়াম কর্মচারীদের আবাসিক হোটেল। ছোট ছোট দুই রুমের আবাসন ছিল। ছোট পরিবার বা ব্যাচেলরদের জন্য বেশ চলনসই। আমার স্ত্রী জেবু এবং আমাদের পিঠাপিঠি দুই সন্তান নিয়ে সেখানে থাকি। মাসিক ভাড়া কাটা হতো ৬০০ টাকা। তখনো বাসার কাজের জন্য কোনো সাহায্যকারী ছিল না।  স্ত্রী জেবুর ওপর সবকিছুর দায় চাপিয়ে দিয়ে স্রেফ অবিবেচকের মতো আমি নিত্য বেরিয়ে আসি।

২. হোটেল ইলিশিয়ামের নিচে নেমে বাঁ-দিকে অল্প হেঁটে ইত্তেফাকের মোড় থেকে পাবলিক বাসে চড়ে মতিঝিল-প্রেস ক্লাব হয়ে শাহবাগে আসি। এটা নিয়মিত চলে। বৃষ্টি বাদল, ঝড়ঝঞ্ঝা কিছুই মানে না। আসলে অযথা এক ঘোরে পড়ে সেখানে আমার আসা-যাওয়া হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা বলে এমনিতেই অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যেত। এটাও এক ধরনের আকর্ষণের হেতু ছিল। আমাদের বসার নির্ধারিত স্থানটি ছিল বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিচতলার ওষুধের দোকানগুলোর একদম মধ্যস্থলের ফাস্টফুড শপ সেনোরিটা সংলগ্ন সিঁড়ির স্পেসটায়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী বন্ধু মনির এটার স্বত্বাধিকারী ছিল। প্রায় ১০-১২ জনের উপস্থিতিতে জম্পেশ আড্ডা বলতে যা হয়। সন্ধ্যা ৭টা থেকে কখনো রাত ৯-৩০টা পর্যন্ত চলত গল্প, আলোচনা, তুমুল তর্ক-বিতর্ক। কোনো দৈব কারণে এর মধ্যে রাজনীতি ঢুকে গেলেই পরিবেশ ঝগড়ার পর্যায়ে চলে যেত। তবে দল ও মতের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শনে কেউ কখনো হুমকির কারণ হতো না। মতপ্রকাশের সুযোগ নিয়ে কাউকে শঙ্কিত বোধ করতেও দেখিনি।

৩. প্রসঙ্গত, প্রথাবিরোধী লেখক ও কবি হুমায়ুন আজাদকে কেউ প্রতিবাদ করল, সে ক্ষেত্রে তিনি খানিকটা অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের ভাষায় এড়িয়ে যেতেন। হঠাৎ ধামরাইয়ের বদিভাই রেগে গিয়ে কাউকে দালাল বা দুর্নীতিবাজ বলে চিৎকার করে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে এককাপ লাল চা হাতে নিয়ে তাঁর সামনে ধরলেই তিনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রশমিত। ড. গোলাম হোসেন মাঝেমধ্যে এসে তাত্ত্বিক কথা বললেও মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়ে বলা তাঁর কথায় কে কান দিত? রশীদ বলতেন, ওর কথা শুনে লাভ নেই, আস্ত একটা পাগল। এমিরেটস এয়ারলাইনসের মেধাবী জুনাইদ ভাই, নিরেট অমায়িক ভদ্রলোক। যে কোনো ঝামেলা সযতেœ এড়িয়ে যেতেন, কিন্তু আপ্যায়নে ছিল তাঁর উদার মন। ড. জাকির তাঁর ৩-৪ জন ব্যাচমেট নিয়ে গোল হয়ে বসে আছেন। বুঝতে অসুবিধা হতো না যে, তিনি এদের দলপতি। দেখলেই, এই বসো, চা খাও। কিছুটা অসহিষ্ণু মনোভাবের হলেও খোলা মনের মানুষ তিনি। সভয়ে কাছাকাছি বসতাম। অবশ্য তখন সুবোধ শ্রোতা হয়ে থাকলেই নিরাপদ। আজিজ মার্কেট থেকে কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে পদব্রজে হঠাৎ সরদার ফজলুল করিম স্যার। চেয়ার ছেড়ে সবাই দাঁড়িয়ে। তিনি পার্শ্ববর্তী ট্রিভলী ফার্মাতে যাবেন। স্যারকে জোর করে চা-নাশতার অফার করা। উপযাচক হয়ে পরিচয় দিয়ে বলি, স্যার আমি আপনার সরাসরি ছাত্র। অনার্স প্রথম বর্ষে ‘রাষ্ট্রচিন্তা পরিচিতি’ আপনি আমাদের পড়িয়েছেন। তখনই তিনি জানতে চেয়েছেন, আমার ছাত্র সিভিল সার্ভেন্ট এম এ কুদ্দুস এখন কোথায় আছে? প্রশাসনের ’৭৯ ব্যাচের এ কর্মকর্তাকে তখনো আমি চিনি না। পরে পরিচিত হয়ে একবার সরদার স্যারের স্মরণের কথা বলেছিলাম। তিনি ভীষণ খুশি হয়েছিলেন।

৪. একবার ছুটির দিনের বিকালে টিকাটুলি থেকে টিএসসির দিকে চলে আসি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাঁটার পর ড. আহমদ শরীফ, ড. আবদুল্লাহ ফারুক ও প্রফেসর মমতাজুর রহমান তরফদারসহ তাদের নিয়মিত শ্রোতাগণ যে যার মতো ফিরে গেলেন। আমি তরুণ অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের পিছু ধরে কবি নজরুল ইসলামের সমাধির পাশ দিয়ে শাহবাগে আড্ডার সেই স্পটে হেঁটে আসছিলাম। দুজনের গন্তব্য ছিল একই। আসতে আসতেই তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা হলো, তখন লেখালেখি নিয়ে কোনো কথা হয়নি। এ বিষয়ে আমার বিশেষ জ্ঞান-গরিমাও ছিল না। বরং কথা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতির রং নিয়ে। কারণ একটু আগে আমরা দুজনই উদ্যানের ঘাসে বসে ড. আহমদ শরীফের মুগ্ধ শ্রোতা হয়েছিলাম। বলাবাহুল্য, অধ্যাপক আহমদ শরীফের উদ্যানের সেই আড্ডায় আমি ১৯৮৭-৮৮ সালেই যোগ দিয়েছি।

৫. একদিন সন্ধ্যায় বাসা থেকে চুপি চুপি বের হয়ে শাহবাগ আসছিলাম। পেছনে আমার তিন বছরের মেয়েটা বাবা-বাবা বলে বেরিয়ে আসে। নিচের রাস্তায় নেমে সে কাঁদছে আর আমাকে অনুসরণ করে দৌড়াতে থাকে। দ্রুতগামী আমি যা কস্মিনকালেও বুঝতে পারিনি যে, মেয়েটা পেছনে আসবে বা এমনটা হতে পারে। সূর্যাস্তের পরে অভিসার সিনেমা হলের বিপরীতে শত শত পথচারীর নজরে পড়লেও এই নগরের লৌহ কাষ্ঠের জীবনে কে কার! তখনো আমার ক্রন্দনরত কন্যাটি শুধু বাবা পর্যন্ত বলতে পারে। তার অধিত ভাষাজ্ঞানে কেউ তাকে এর চেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারছিল না। একটু পরে কন্যার মামনি যখন বুঝতে পারে বাবাভক্ত কন্যাটি নিশ্চয়ই তার বাবার পিছু নিয়েছে। সেও উ™£ান্তের মতো দৌড়াচ্ছে মেয়ের দিকে। তখন দুয়েকজন সুজন পথিক তাকে ঈশারা করে জানায়, দেখুন, সিনেমা হলের বিপরীতের ফুটপাতে একটি মেয়েশিশু বাবা বাবা বলে কাঁদছে। সেদিন মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে জেবুর কান্নায় নাকি মুহূর্তেই চারপাশে মানুষ জমে উঠেছিল।

রাত ১০টা পেরিয়ে বাসায় পৌঁছে দেখি জেবুর নিষ্প্রভ মুখের ওপর এক আকাশ বিষাদভরা বিষণ্ণতার কালো ছায়া জমে আছে। আঁচ করতে পেরে আমি একেবারে চুপচাপ হয়ে যাই। মৌনতাই আমার অপরাধের স্বীকারোক্তি। খানিক পরে অন্ধকার সরে গেলে তার মুখ থেকে আমার বিরুদ্ধে নানাবিধ অন্যায় আর অবিচারের ফিরিস্তি শুনেও সে দিন আত্মপক্ষ সমর্থন বা প্রতিবাদ করার বিন্দু পরিমাণ নৈতিক অবস্থান আমার ছিল না। বরং একতরফা বক্তব্যের পরে জেবুরই বিজয় হয়েছিল।

৬. শাহবাগ থেকে রাতে ফেরার পথে মাঝেমধ্যে গুলিস্তান সিনেমা হলের কাছে নেমে গিয়ে পায়ে হেঁটে নবাবপুর রোডের বাঁয়ে ঠাটারীবাজারের ভিতর দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে কাপ্তানবাজার পর্যন্ত পৌঁছে যেতাম। আমি যেন নিভৃতচারী অচেনা আগন্তুক এক। জনান্তিকে আমি বিরাজমান। হাঁটতে গিয়ে ভাবী, সুবিশাল এই ঢাকা শহরে কে কাকে চিনে রাখে? হাতে করে কিছু মাছ, তরি-তরকারি নিয়ে আলো-আঁধারি পথের পথিক হয়ে, জয়কালী মন্দিরের গা-ঘেঁষে ইলিশিয়াম হোটেলের নিজ কক্ষে প্রবেশ করতাম। দিনভর দুই বাচ্ছার শত ঝক্কি-ঝামেলা সয়ে বয়ে সীমাহীন অবসন্নতা নিয়ে তখন জেবু হয়তো সবেমাত্র টেলিভিশনের পর্দায় তার ক্লান্তিভরা চোখ দুটো মেলে ধরেছে। আমার হাতে বাজার দেখে সে সময় তাকে আনন্দিত হওয়ার চেয়ে বেদনার্ত হতেই বেশি দেখেছি। কেননা মধ্যরাতে হাতে কাঁচাবাজার নিয়ে ঘরে ফেরাও যে স্ত্রীর ওপর এক ধরনের উৎপীড়ন বৈ অন্য কিছু নয়।

৭. আজ থেকে তিন দশক আগে আমার আড্ডার সেই কুশীলবদের দু-একজন বাদে প্রায় সবাই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন। যাঁরা আছেন তারাও রোগে-শোকে কাতর হয়ে গৃহের চার দেয়ালের বাসিন্দা। কালেভদ্রে দেখা হলে বলেন, ‘বের হই না।  আর এখন কি কেউ কাউকে সম্মান দেয়?

আড্ডা দিয়ে একটু অলস সময় কাটানোর দিনগুলো যেন ফুরিয়ে গেছে’। সেদিন দেখলাম, সেনোরিটা ফার্মেসি হয়ে গেছে, আর সামনের সেই স্পেসটার গায়ে লেখা রয়েছে ‘এটা নামাজের স্থান’।

পাদটীকা : আজ জেবু বেঁচে নেই। তবু আজকের নষ্ট-ভ্রষ্ঠ প্রায় পচে যাওয়া সময়কে দেখে ভাবী, বড় চাকরির দীর্ঘ পরিবেষ্টনের মধ্যে থেকেও আমাদের এমন নির্মোহ, টানাপোড়েন আর বেদনাবিদীর্ণ অবর্ণিল জীবনের দরকার কী ছিল? এই সমাজের কেউ কি কখনো এর সামান্যও মূল্য দেয় বা দেবে?

লেখক : গল্পকার ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর