বুধবার, ১২ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

আত্মসমর্পণের কোরবানি

আবদুল্লাহ আল মামুন আশরাফী

আত্মসমর্পণের কোরবানি

সময়ের ঘূর্ণিপাকে আবারও ঈদুল আজহা আমাদের দোরগোড়ায়। স্বাতন্ত্র্যের সৌন্দর্যে ভাস্বর ইসলামের অনুসারীরা পরম উৎসাহ ও আনন্দে ঈদুল আজহা উদযাপন করে থাকেন। মুসলমানদের যাপিত জীবনে আনন্দের উপলক্ষ বয়ে আনা দুটো উৎসব মুখর দিনের অন্যতম এই ঈদুল আজহা। আজহা মানে কোরবানি। তাই এটি কোরবানির ঈদ নামেও সমধিক পরিচিত। পৃথিবীর শুরু থেকে কোরবানির প্রচলন থাকলেও নির্ধারিত পশু জবাইয়ের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ যে কোরবানি করে থাকে, এর নেপথ্যে কাজ করে আত্মসমর্পণের বিমল পাঠ। ইবরাহিমি ত্যাগ ও ইসমাইলি ধৈর্যের অনন্য স্মারক এই কোরবানি আল্লাহর রাহে নিজেকে কোরবানি করতে প্রতিটি মুমিনের চেতনাজুড়ে অনুপ্রেরণার সৌরভ বিলিয়ে যায়।

কোরবানি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান এবং ইবাদতের একটি বিশেষ প্রকার। কোরবানি দীনের এক নিদর্শন। কোরবানি শব্দটি ফার্সি, উর্দু ও বাংলা ভাষায় আরবি ‘কুরবান’ শব্দস্থলে ব্যবহৃত হয়। কোরবান শব্দটি কাফ রা বা মূল ধাতু থেকে নির্গত, যার শাব্দিক অর্থ-নৈকট্য। আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে “আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের লক্ষ্যে শরিয়তসম্মত পন্থায় বান্দা যে আমল করে” তাকেই কোরবানি বলা যেতে পারে। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় কোরবানি হচ্ছে- আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের মহান লক্ষ্যে শরিয়ত নির্দেশিত পন্থায় কোনো জন্তু যা শরিয়ত নির্ধারিত, আল্লাহর দরবারে পেশ করা এবং শরিয়ত নির্ধারিত পন্থায় তা ব্যবহার করা।

১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন নর-নারী প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে ৫২ তোলা রুপার সমমূল্যের সম্পদের মালিক হবে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রুপার অলংকার, ব্যবসায়িক পণ্য, অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র এসব কিছুর মূল্য কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য (সহিহ মুসলিম ১/৩১৫, বাদায়েউস সানায়ে-৪/১৯৬)।

সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমানের ওপর কোরবানি ওয়াজিব। এর কোনো বিকল্প নেই। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে- “সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন। (সুরাতুল কাউসার-২)। আল্লাহর আদেশ পালনার্থে নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিয়মিত কোরবানি করেছেন। তিনি কখনো কোরবানি বাদ দেননি। (আল ইসতিযকার-১৫/১৬৩-১৬৪)

জনৈক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, আমাকে ইয়াওমুল আজহা তথা কোরবানির আদেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ এই দিনকে (ঈদুল আজহার দিন) এই উম্মতের উৎসবের দিন হিসেবে নির্ধারিত করে দিয়েছেন (সুনানে আবু দাউদ-২৭৮৯)। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা কোরবানি করে না নবীজি (সা.) তাদের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। “আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কোরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে-কাছেও না আসে” (মুসনাদে আহমাদ-৮১৭৩)। কোরবানির দিনগুলোতে (১০, ১১ ও ১২ জিলহজ) কোরবানিই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল হিসেবে বিবেচিত। কিয়ামতের দিন কোরবানির পশু শিং ক্ষুরসমেত হবে। এতে কোরবানিদাতার আমলনামা সমৃদ্ধ হবে। আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত,  রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোরবানির দিন মানুষ যে কাজ করে তার মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচাইতে পছন্দনীয় হচ্ছে রক্ত প্রবাহিত করা (কোরবানি করা)। কিয়ামতের দিন তা নিজের শিং, পশম ও ক্ষুরসহ হাজির হবে। তার (কোরবানির পশুর) রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর নিকটে এক বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা আনন্দিত মনে কোরবানি কর (জামে তিরমিজি-১৪৯৩)।

কোরবানির পশুর রক্তের প্রথম ফোঁটা মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ কোরবানিদাতার গুনাহ মাফ করে দেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) ফাতেমা (রা.)-কে লক্ষ্য করে বলেন, হে ফাতিমা! তুমি তোমার কোরবানির পশু জবাইকালে সেখানে উপস্থিত থাকবে। জেনে রেখো, কোরবানির পশুর রক্তের প্রথম ফোঁটা মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তোমার পেছনের সমস্যা (সগিরা) গোনাহ মাফ করে দেবেন। ফাতেমা (রা.) বলেন, এই পুরস্কার কি শুধু আমাদের আহলে বাইতের (নবী পরিবারের) জন্য নির্ধারিত নাকি সবার জন্য? নবীজি (সা.) বলেন, সবার জন্য এই পুরস্কার প্রযোজ্য (মুস্তাদরাকে হাকেম- ৭৬৩৩)। ইবরাহিম খলিল (আ.)-এর পুরো জীবনটাই ছিল আল্লাহর প্রেমে নিবেদিত। আল্লাহর হুকুমের সামনে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের স্নিগ্ধ সৌরভ ছড়ানো তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে। কোরবানিও সেই নিবেদনের একটি ঝলক। আল্লাহর প্রেমে মাতোয়ারা ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.) এর চেতনাদীপ্ত সে গল্পটি কোরআন মাজিদে বিধৃত হয়েছে সুনিপুণভাবে। “অতঃপর সে পুত্র যখন ইবরাহিমের সঙ্গে চলাফেরা করার উপযুক্ত হলো, তখন সে বলল, বাছা! আমি স্বপ্নে দেখছি যে, তোমাকে জবেহ করছি। এবার চিন্তা করে বল, তোমার অভিমত কী। পুত্র বলল, আব্বাজি! আপনাকে যার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে আপনি সেটাই করুন। ইনশা আল্লাহ আপনি আমাকে সবরকারীদের একজন পাবেন।

লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ টঙ্গী, গাজীপুর

সর্বশেষ খবর