বুধবার, ১২ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

সত্য অস্বীকারের পরিণতি

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

সত্য অস্বীকারের পরিণতি

পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যারা সত্যকে অস্বীকার করেছে, হে নবী! তাদের তুমি যতই সতর্ক কর না কেন, তারা কখনো ইমান আনবে না। আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন, কানকে করেছেন বধির আর চোখ ঢেকে দিয়েছেন পর্দায়। ওদের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন শাস্তি।’ (সুরা বাকারাহ, আয়াত ৬-৭।)

এ আয়াতখানা নাজিল হয়েছে মক্কার কাফের ও ইহুদি নেতাদের উদ্দেশ্য করে। রসুল (সা.) বারবার তাদের ইমানের দাওয়াত দিচ্ছিলেন আর তারা অহংকারের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করছিল। এ আয়াত যখন নাজিল হয় তখন কেউ কেউ মারাও গিয়েছিল। বিশেষ করে আবুজাহেলের নাম বলতে হয়। বদরযুদ্ধে সে ও কয়েকজন কাফের নেতা মারা যান। এ আয়াতে তাদের কথা বলা হয়েছে। আসলে আল্লাহ যার অন্তরে মোহর এঁটে দেন তার কপালে আর হেদায়েত জোটে না। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন আল্লাহ মোহর এঁটে দিয়েছেন তাই হেদায়াত জোটে না, এতে ওই ব্যক্তির কী দোষ? আসলে এ প্রশ্নটি অবান্তর। আয়াতটি গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়লে দেখা যাবে, সত্য অস্বীকার করার অপরাধে তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেওয়া হয়েছে। মোহর মেরে দেওয়ার কারণে তারা সত্য অস্বীকার করেছে ব্যাপারটি মোটেও এরকম নয়। আয়াতে আল্লাহ একটি চিরায়ত সত্য প্রকাশ করেছেন, যা আধুনিক মনোবিজ্ঞান ও নিউরোসায়েন্সের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সত্য অনুসন্ধানে সহজাত বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ না করে কুসংস্কার, ভ্রান্ত বিশ্বাস ও অবিদ্যায় ক্রমাগত প্রভাবিত হতে থাকলে মানুষের মস্তিষ্কের ওয়ার্কিং স্ট্রাকচার বা কর্মকাঠামো বদলে যায়। ফলে তার সত্যবাণী শোনার আগ্রহ ও সামর্থ্য দুই-ই হ্রাস পায়। ক্রমান্বয়ে অন্তর বিভ্রান্তির আস্তরে স্থায়ীভাবে আচ্ছাদিত হয়। এ মোহর লাগা ও কঠিন শাস্তি কোনো অলঙ্ঘনীয় নিয়তি নয়, বরং প্রাকৃতিক আইন অনুসারে ব্যক্তির স্বাধীন পছন্দ ও কর্মের পরিণতি। একইভাবে বিশ্বাস স্থাপন ও সৎ কর্মের পুরস্কারও হচ্ছে ব্যক্তির সহজাত বিচার বুদ্ধির স্বাধীন ও সঠিক প্রয়োগের সুফল।

আরবি ‘খতম’ শব্দের অর্থ কোনো কিছুর ওপর ছাপ মেরে দেওয়া। দ্বিতীয় আরেকটি অর্থ হলো- কোনো ঘরের দরজা এমনভাবে বন্ধ করে দেওয়া যার ফলে ওই ঘরে বাইরের কোনো আলো-বাতাস কিছুই প্রবেশ করার সুযাগ থাকে না। খতম শব্দের আরেকটি অর্থ আমাদের সমাজে বেশি পরিচিত- কোনো কিছু একেবারে শেষ করে দেওয়াকে খতম বলে। যেমন আমরা বলি কোরআন শরিফ খতম করা কিংবা কোনো কাজ শেষ করাকে বলি খতম করে দিয়েছি। তাৎপর্যের দিক থেকে সবগুলো অর্থ একই। কাউকে যখন বারবার সত্যের দাওয়াত দেওয়া হয়, কিন্তু সে কোনো ভ্রুক্ষেপই করে না, হৃদয়ের বন্ধ দরজা সে খোলার চিন্তা করে না কিংবা সে সিদ্ধান্ত নেয় আমাকে যতই বুঝানো হোক না কেন, আমি হৃদয়ে আলো প্রবেশ করাব না, তখন আল্লাহতায়ালা তার হৃদয়ের দরজায় সিলমোহর মেরে দিয়ে তা চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেন। সুরা নিসার একটি আয়াতে আল্লাহ এমনটাই বলেছেন, ‘বাল তাবাআল্লাহু আলাইহা বিকুফরিহিম। আসল ব্যাপার এই যে, অনবরত সত্য অস্বীকার ও কুফরি মনোভাবের কারণে আল্লাহ তাদের অন্তরে সত্যের আলো ঢোকার পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিয়েছেন।’

অনবরত কুফরি কাজ করার কারণে ব্যক্তি নিজের ওপর জুলুম করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী! সত্য অস্বীকারকারীরা শুধু প্রতীক্ষা করতে চায় ফেরেশতার দৃশ্যমান আগমনের অথবা তোমার প্রতিপালকের নির্ধারিত শাস্তির। ওদের পূর্ববর্তী পাপীরাও তা-ই করত। তাদের যখন ধ্বংস করে দেওয়া হলো, তখন আল্লাহ তাদের ওপর কোনো অন্যায় করেননি, তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছিল। তাদের জুলুমের বোঝাই তাদের ওপর নিপতিত হলো। যে আজাব নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত, সে আজাবই তাদের গ্রাস করল। শরিককারীরা এখন বলে, আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে আমরা অবশ্যই তাঁকে ছাড়া অন্য কারও উপাসনা করতাম না, আমাদের বাপ-দাদারাও করত না। তাঁর হুকুম ছাড়া কোনো জিনিসকে হারাম বলেও গণ্য করতাম না। তাদের পূর্ববর্তী পাপী বাপ-দাদারাও এ ধরনের কথাই বলত। আসলে রসুলদের কর্তব্য তো শুধু সত্যবাণী সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া।’ (সুরা নাহল, আয়াত ৩৩-৩৫)।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি পীর সাহেব আউলিয়ানগর

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর