শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

পাপ-পুণ্যের প্রি-অডিট ও পোস্ট-অডিট

মোশাররফ হোসেন মুসা

পাপ-পুণ্যের প্রি-অডিট ও পোস্ট-অডিট

ধর্মের হাত ধরে সভ্যতা এসেছে। মধ্যযুগ পর্যন্ত ধর্মের প্রভাব ছিল সর্বব্যাপী। গির্জার অধীনে থেকে রাজা রাজ্য পরিচালনা করতেন। যাজকদের দ্বারা কবি-সাহিত্যিক-চিত্রশিল্পী-জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নির্যাতিত হওয়া শুরু হলে ১৫ শতকে ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ইউরোপজুড়ে রেনেসাঁস ঘটে। রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক করা হয়। তখন থেকে পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যাত্রা শুরু হয় জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্রের। অপরদিকে যে সমস্ত দেশে রেনেসাঁস ঘটেনি সে সব দেশ মিথভিত্তিক থেকে যায়। আমেরিকা-ইউরোপ নিজেদের দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি না করলেও অনুন্নত দেশে শাসন-শোষণ চালানোর জন্য ধর্মকে ব্যবহার করছে। তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ মধ্যপ্রাচ্য দেশগুলো। আমাদের দেশে সারা দিনের সব কথায় ধর্মের প্রসঙ্গ আসবেই। প্রায় ৯০ ভাগ লোকের বিশ্বাস নামাজ-রোজা-হজ পালন করলে সব গুনাহের মাফ পাওয়া যায়। বাকি ১০ ভাগ এর বাইরে বলছেন, দুর্নীতিবাজরা কখনো ক্ষমা পাবে না। কিন্তু এসব ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর কথা কে শুনছে! সে জন্য বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য অডিটের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

সরকারি কাজকর্মে দুই প্রকারের অডিট অনুসৃত হয়ে থাকে, তাহলো প্রি-অডিট ও পোস্ট-অডিট। যদি কোনো কাজের বিল পরিশোধের আগে কাজের মান ও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা হয়, তাহলে তাকে প্রি-অডিট বলে। আর যদি বিল পরিশোধের একাধিক বছর পর দাখিলকৃত বিলের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই ও সমন্বয় করা হয়, তাহলে তাকে পোস্ট-অডিট বলে। প্রি-অডিট নিয়মভুক্ত কাজে তাৎক্ষণিক হিসাব-নিকাশের নিয়ম থাকায় গোঁজামিল দেওয়া কিংবা দুর্নীতি করার সুযোগ থাকে কম। কিন্তু পোস্ট-অডিটভুক্ত কাজে শিডিউল মোতাবেক কাজ করা ও বিল-ভাউচার সমন্বয় করার জন্য যথেষ্ট সময় থাকায় দুর্নীতি করার সুযোগ থাকে বেশি। এ নিয়মে কাজ পাওয়া কোনো কোনো ঠিকাদার প্রকাশ্যেই বলে থাকেন, ‘আগে অগ্রিম বিল উঠাই, তারপর কাজ করব কি না পরে দেখা যাবে।’ এসব কারণে পোস্ট-অডিটভুক্ত কাজে অডিট আপত্তি হয় বেশি। কিন্তু অডিট আপত্তির কারণে বিলের টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে কিংবা শিডিউল মোতাবেক কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে এমন ঘটনা বিরল। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল; তা হলো টাঙ্গাইলের জনৈক রাজনৈতিক নেতা বিলের অগ্রিম টাকা উত্তোলন করে ৮টি ব্রিজের কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে যান। একই কারণে বর্তমান বিশ্বে দুর্নীতি ও অপচয় রোধে প্রি-পেইড পদ্ধতি অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

একইভাবে সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক বান্দার পাপ-পুণ্যের হিসাবেও প্রি-অডিট ও পোস্ট-অডিটের মতো নিয়ম রয়েছে। নিরীশ্বরবাদী, সংশয়বাদী ও পুনর্জন্মবাদী লোকদের পাপ-পুণ্যের হিসাবকে অনেকটা প্রি-অডিট বলা যায়। নিরীশ্বরবাদীরা মনে করেন, মানুষের সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিক নিয়মে এবং তাদের নিজেদের কর্মফল নিজেদেরই ভোগ করতে হবে। তাদের ধারণায় পৃথিবীর ভালো-মন্দ করার জন্য আলাদাভাবে কোনো ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। পৃথিবীর মঙ্গল অথবা অমঙ্গল করার উভয় ক্ষমতাই মানুষের রয়েছে। তারা আলাদাভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার না করলেও বিবেকের ঈশ্বরকে মান্য করে চলেন। এ কাতারের জনৈক ব্যক্তি বলেছেন, তিনি মন্দ কাজ করলে অনুতাপে ভোগেন আর ভালো কাজ করলে আনন্দিত থাকেন।

সংশয়বাদীরা পরকাল সম্পর্কে সন্দিহান থাকলেও ইহজগৎ সম্পর্কে সচেতন থাকেন বেশি। তারা মনে করেন, পৃথিবীটা পাপে-পূর্ণ ও দুঃখময়। আরও পাপ করলে পৃথিবী আরও দুঃখময় হয়ে উঠবে। সে জন্য সবাইকে পুণ্যের কাজ করতে হবে। অপরদিকে পুনর্জন্মবাদীদের বক্তব্য পাপ-পুণ্যের বিষয়ে ঈশ্বর সরাসরি অবলোকন করছেন এবং সে অনুযায়ী কর্মফল দিতে সচেষ্ট রয়েছেন। তারা আরও মনে করেন, ভালো কাজ করলে উৎকৃষ্ট প্রাণীরূপে ও মন্দকাজ করলে নিকৃষ্ট প্রাণীরূপে পরজন্মে পৃথিবীতে আগমন ঘটবে। তাদের কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ উভয়ই ইহলোক কেন্দ্রিক (এখানে জীবনানন্দ দাশ ও ক্ষুদিরাম বসুর ইহলোকে ফিরে আসার আকুতি উদাহরণ হতে পারে)।

কিন্তু পুনরুত্থানবাদীদের দৃষ্টিতে ইহলোক ক্ষণকাল আর পরলোক অনন্তকাল। তারা আরও মনে করেন, পাপ-পুণ্যের কর্মফল বিলম্বে পাওয়া যাবে। যেমন- নেক কাজ করলে বেহেস্ত এবং পাপ কাজ করলে গোর আজাব ও শেষ বিচারে দোজখে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তার আগে পাপীদের পাপ মোচনের বিভিন্ন সুযোগ রয়েছে। যেমন, গির্জায় গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করা, পাদ্রির দেওয়া শাস্তি ভোগ করে শুদ্ধ হওয়া, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা, তওবা করা, হজ পালন করা, জাকাত দেওয়া ইত্যাদি। সে জন্য এ কাতারের কেউ কেউ দুর্নীতির সমর্থনে প্রকাশ্যেই বলে থাকেন-‘যুবক বয়স হলো অর্থোপার্জনের বয়স। আর বৃদ্ধ বয়স হলো মার্জনা চাওয়ার বয়স।’ (সম্প্রতি পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ও আনোয়ারুল আজিম এমপি প্রমুখ ব্যক্তির কর্মকাণ্ড উদাহরণ হতে পারে)। উপরিউক্ত বিষয়ে স্বাভাবিকভাবে যে কথা এসে যায় তা হলো- যারা পৃথিবীতে পুনরায় ফিরে আসার বাসনা পোষণ করেন পৃথিবীর প্রতি তাদের মমত্ববোধ আর যারা পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে চলে যেতে চান, পৃথিবীর প্রতি তাদের মমত্ববোধ এক হওয়ার কথা নয়। সে কারণে প্রশ্ন করা যায়, ইহলোককে কর্মময় ও শান্তিময় করার জন্য প্রি-অডিট না পোস্ট-অডিট, কোনটি বেশি কার্যকর?

লেখক : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক

সর্বশেষ খবর