শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

কোরবানির পশু যৌতুক এক ভয়ংকর জুলুম

যুবায়ের আহমাদ

কোরবানির পশু যৌতুক এক ভয়ংকর জুলুম

পৃথিবীর শুরু থেকেই আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের এক মহান মাধ্যম হিসেবে অভিহিত হয়ে এসেছে কোরবানি। কোরবানি অর্থ নৈকট্য বা সান্নিধ্য। আল্লাহর নৈকট্য বা সান্নিধ্য লাভের জন্য কোনো কিছু ত্যাগ করাই কোরবানি। পরিভাষায় জিলহজ মাসের ১০-১২ তারিখ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শরয়ি নিয়ম অনুযায়ী প্রাণী জবাই করা-ই কোরবানি। কোরবানির পর আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গোশত পাঠানো সওয়াবের কাজ। একজন কোরবানিদাতা তার প্রতিবেশী, দরিদ্র ও আত্মীয়স্বজনের বাড়ি গোশত পাঠিয়ে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেন। এমনকি অমুসলিমকেও দেওয়া যায় কোরবানির গোশত। কিন্তু তা হতে হবে স্বেচ্ছায়। জোরপূর্বক বা সামাজিক চাপের মাধ্যমে কোরবানিদাতার কাছ থেকে কোরবানির গোশত আদায়ের সুযোগ ইসলামে নেই। অত্যন্ত দুঃখজনক হলো, যেখানে কোরবানির গোশতও জোর করে নেওয়া অনুমোদিত নয় ইসলামে, সেখানে আমাদের দেশের কোনো কোনো এলাকায় কৌশলে শ্বশুরবাড়ি থেকে কোরবানির প্রাণী আদায়ের কুপ্রথা গড়ে উঠেছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে সময়মতো কোরবানির প্রাণী পাঠানো না হলে স্বামীর বাড়িতে মেয়েকে শিকার হতে হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের। ‘সন্তোষজনক’ কোরবানির প্রাণী না পাঠালে মানসিক নির্যাতন এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, এর কারণে আত্মহত্যা ও ডিভোর্সের মতো ঘটনাও ঘটে যায়। ভয়ংকর এ কোরবানি যৌতুকের কারণে মধ্যবিত্ত ও গরিব পরিবারগুলোতে ঈদুল আজহা এক বাড়তি আতঙ্কে পরিণত হয়। বরপক্ষ ‘বড় কোরবানি’ পাওয়ার আশায় থাকে আর কনেপক্ষের জন্য ঈদ আসে আনন্দের পরিবর্তে বিষাদ হয়ে। অনেক সময় দরিদ্র পিতা-মাতা মেয়ের সুখের জন্য শতকষ্ট বুকে চেপে হাসি মুখে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি কোরবানির প্রাণী পাঠান। সামাজিকতার এই নিয়মের চাহিদা মেটাতে নিজে কোরবানি না করে গরু-ছাগল বিক্রি করেন, সুদে টাকা নেন, কেউ নিজের ওষুধ না কিনে চিকিৎসার টাকা জমিয়ে কনের বাড়িতে কোরবানির পশু পাঠান। কনের পিতার বাড়ি থেকে কনের স্বামীর বাড়িতে কোরবানির প্রাণী বা ফ্রিজসহ কোরবানির প্রাণী পাঠানোর যে সামাজিক নিয়ম চালু হয়েছে তা কিছুতেই ইসলাম সমর্থিত নয়। কোরবানির মতো মহৎ ইবাদতকে এভাবে যৌতুক বা জুলুমের মাধ্যম বানানো মুসলিম সমাজের জন্য খুবই লজ্জাজনক। এভাবে সামাজিক নিয়ম তৈরি করে শ্বশুরবাড়ি থেকে কৌশলে কোরবানির প্রাণী আদায় কিছুতেই ইবাদত হবে না বরং হবে জুলুম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।’ সুরা নিসা : ২৯। এভাবে যারা অন্যের সম্পদ দখল করবে, তাদের জন্য আল্লাহতায়ালা ঠিক পরের আয়াতেই লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তির ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি সীমা লঙ্ঘন ও জুলুম করে, অচিরেই তাকে আগুনে দগ্ধ করব। এটা আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজ।’ সুরা নিসা : ৩০। ঈদুল আজহার শিক্ষা হলো অন্যের ঘরে কোরবানির গোশত পাঠিয়ে তাকেও ঈদের আনন্দে শামিল করা। অন্যকে আনন্দিত করার চর্চা করা। কিন্তু দুঃখজনক, কোরবানির প্রাণী চেয়ে কনের পরিবারের ঈদের আনন্দ বিষাদে পরিণত করে নির্মমতার চর্চা করা হয়। এর চেয়েও দুঃখজনক হলো, এ নির্মমতার কাজটি করা হয় বছরের এমন একসময়ে যখন বিদায় হজের ভাষণে অন্যের সম্পদ গ্রাস করাকে হারাম করে আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছিলেন, ‘জেনে রেখো, নিশ্চয়ই তোমাদের মাল-সম্পদ ও তোমাদের রক্ত তোমাদের পরস্পরের ওপরে হারাম, যেমন আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহর তোমাদের জন্য হারাম...।’ বুখারি ও মুসলিম। লৌকিকতা, সামাজিকতা বা আভিজাত্যের প্রতিযোগিতা বা প্রদর্শন নয়, বরং কোরবানি হতে হবে কেবলই আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির জন্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের জন্য নামাজ এবং কোরবানি আদায় করুন।’ সুরা কাউসার : ২। নিজের সামর্থ্য না থাকলেও শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুকের প্রাণী এনে কেন কোরবানি করতে হবে? কোরবানি তো আবশ্যক হয় কেবলই ব্যক্তির নিজের সামর্থ্যরে ওপর। শ্বশুরবাড়ি বিত্তশালী হলেই কোনো ব্যক্তির ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয় না। নিজের সামর্থ্য না থাকলেও চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই বা এভাবে শ্বশুরবাড়ি থেকে কৌশলে চাপ প্রয়োগ করে কোরবানির প্রাণী আদায় করে তা কোরবানি করা কোরবানির মহান বিধানকে উপহাস করা ছাড়া কিছুই নয়। সামাজিকতার চাপে এভাবে কাউকে কোরবানির প্রাণী প্রদানে বাধ্য করলে তা অন্যায়ভাবে সম্পদ গ্রাস করা হবে। এভাবে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎকারীর যদি কোনো নেক আমল থাকে তাহলে আল্লাহতায়ালা সেই নেক আমল মজলুমকে প্রদান করে ন্যায়বিচার করবেন। আত্মসাৎকৃত সম্পদের বিপরীতে পর্যাপ্ত নেক আমল না থাকলে মজলুমের গুনাহের বোঝা মাথায় নিয়ে জাহান্নামে যেতে হবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমার উম¥তের মধ্যে প্রকৃত দরিদ্র হলো সেই ব্যক্তি, যে কেয়ামতের দিন প্রচুর নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত নিয়ে আসবে, কিন্তু সে কাউকে গালি দিয়ে আসবে, প্রহার করে আসবে অথবা কারও সম্পদ আত্মসাৎ করে আসবে। এরপর এসব (মজলুম) ব্যক্তির মধ্যে তার পুণ্যকর্ম দিয়ে দেওয়া হবে। যখন পুণ্যকর্ম ফুরিয়ে যাবে মজলুমদের পাপ কাজ তার ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’

লেখক : খতিব, বাইতুশ শফিক মসজিদ, গাজীপুর

সর্বশেষ খবর