‘আজ আল্লার নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!’
(কাজী নজরুল ইসলাম, কোরবানি, অগ্নিবীণা)ঈদ উৎসবে উৎসর্গের সব আয়োজন আপ্যায়নের মর্মবাণীই হলো সামাজিক সমতা-সখ্য বৃদ্ধি এবং সম্পদ, সুযোগ ও সৌভাগ্যকে বণ্টন ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা। ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে যা নেয়ামক ভূমিকা পালন করে। আত্মশুদ্ধির জন্য উৎসর্গ বা সংহার প্রকৃত প্রস্তাবে খোদাভীতি ও তাঁর সন্তষ্টি অর্জনের উপায় হিসেবে জীবে প্রেম বা দয়া ও সেবার প্রেরণা প্রদায়ক হিসেবে প্রতিভাত হয়। ঈদুল আজহার উৎসব, হজ পালন ও পশু কোরবানি সূত্রে সমাজ ও অর্থনীতিতে বিশেষ তাৎপর্যবাহী প্রভাব ও কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
হজ পালন ঈদুল আজহা উৎসবের একটি বিশেষ অংশ। পবিত্র হজ অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে বিশ্বের সব দেশের মুসলমানগণ সমবেত হন এক মহাসম্মিলনে। ভাষা ও বর্ণগত, দেশ ও আর্থিক অবস্থানগত সব ভেদাভেদ ভুলে সবার অভিন্ন মিলনক্ষেত্র কাবা শরিফে একই পোশাকে, একই ভাষায় একই রীতি রেওয়াজের মাধ্যমে যে ঐকতান ধ্বনিত হয় তার চেয়ে বড় ধরনের কোনো সাম্য মৈত্রীর সম্মেলন বিশ্বের কোথাও অনুষ্ঠিত হয় না। হজ পালনের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন রং ও গোত্রের মানুষের মধ্যে এক অনির্বচনীয় সখ্য সংস্থাপিত হয়। বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণের যা অনুপম আদর্শ বলে বিবেচিত হয়।
ঈদুল আজহা উদযাপনে অর্থনীতিতে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ, শিল্প উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানান অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের প্রসার ঘটে। এ উৎসবে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ব্যাপক আর্থিক লেনদেনসহ বহুমুখী অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়, যা গোটা অর্থনীতি তথা দেশজ উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় শনাক্তযোগ্য প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। হজ পালন উপলক্ষে বৈদেশিক মুদ্রাসহ বিপুলসংখ্যক অর্থ লেনদেন হয়ে থাকে। এবারও বাংলাদেশ থেকে ৮৫ হাজারের বেশি হাজি হজে গেছেন। প্রতিজনে গড়ে ১০ লাখ টাকা ব্যয় নির্বাহ করলে এ খাতে মোট অর্থব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি, বৈদেশিক মুদ্রায় ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। হাজিদের যাতায়াতসহ সেখানকার ব্যয় বৈদেশিক মুদ্রাতেই নির্বাহ হয়। এর সঙ্গে এ হজের ব্যবস্থাপনা ব্যয়েও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাংলাদেশি টাকা ও বিদেশি মুদ্রা ব্যয়ের সংশ্লেষ রয়েছে। ব্যাংকিং সেক্টরে এ উপলক্ষে লেনদেন ও সেবা সূত্রে ব্যয় বেড়েছে। গোটা সৌদি আরবের অর্থনীতি সেই প্রাচীনকাল থেকেই হজ মৌসুমের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বা ব্যবসা-বাণিজ্যকে ঘিরে বা অবলম্বন করে আবর্তিত হয়।
কোরবানি উপলক্ষে জাতীয় অর্থনীতিতে এক ব্যাপক আর্থিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয় ঈদুল আজহায়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবমতে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ গরু ও ৭০-৭৫ লাখ খাসি কোরবানি হয়। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) মতে, ২০২৩ সালে ৮০-৮৫ লাখ গরু ও ৭০ লাখ খাসি কোরবানি হয়। গরুপ্রতি গড় মূল্য ৬০ হাজার টাকা দাম ধরলে এ ৮৫ লাখ গরু বাবদ লেনদেন হয়েছিল ৩৪ হাজার কোটি টাকা এবং ৭০ লাখ খাসি (গড়ে ৮ হাজার টাকা দরে) ৮ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ পশু কোরবানিতে প্রায় ৪০-৪২ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছিল। কোরবানি উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয় এ খাতে। কোরবানিকৃত পশুর সরবরাহ, কেনাবেচার শুমার ও পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- চাঁদা, টোল, বখশিশ, চোরাকারবার, ফড়িয়া, দালাল, হাসিল, পশুর হাট ইজারা, চাদিয়া, বাঁশ খুঁটির ব্যবসা, পশুর খাবার, পশু কোরবানি ও বানানো এমনকি পশুর সাজগোজ বাবদও এক বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতবদল হয়ে থাকে, অর্থাৎ অর্থনীতিতে ফর্মাল ইনফর্মাল ওয়েতে আর্থিক লেনদেন বা মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়।
কোরবানিকৃত পশুর চামড়া আমাদের অর্থনীতিতে রপ্তানি বাণিজ্যে, পাদুকা শিল্পে পোশাক, হস্তশিল্পে এক অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিক্রয় ও ব্যবহার উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের ও প্রতিষ্ঠানের কর্মযোজনা সৃষ্টি হয়। এ চামড়া সংগ্রহ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে ১৬ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা জড়িত। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বিশেষ ঋণ দিয়ে থাকে, বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৮০-১০০ কোটি টাকা। চামড়া নিম্ন দামে পাচার হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি মোকাবিলার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেটের কবল থেকে চামড়া ব্যবসাকে উদ্ধারের কোনো বিকল্প নেই। দেশে নিজেদের চামড়া প্রক্রিয়াকরণ এবং উপযুক্ত মূল্যে তা রপ্তানির প্রণোদনা সৃষ্টি করেই এ পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি লাভ ঘটতে পারে। লবণ চামড়া সংরক্ষণের একটি অন্যতম উপাদান। ২০২৩ সালে সরকারকে ২০-২৫ হাজার টন লবণ শুল্কমুক্ত আমদানির উদ্যোগ নিতে হয়েছিল যাতে সিন্ডিকেট করে লবণের কৃত্রিম সংকট তৈরি না হয়।
কোরবানি পশুর মাংস আমিষ জাতীয় খাদ্যের উপাদান এবং এ মাংসের বিলি-বণ্টন প্রক্রিয়ায় রয়েছে আর্থসামাজিক তাৎপর্য-ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে বছরের একটা সময়ে সবাই আমিষপ্রধান এ খাদ্যের সন্ধান/সরবরাহ লাভ করে থাকে। মাংস রান্নার কাজে ব্যবহৃত মসলা বাবদ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে এ সময়ে। এ সময়ে অবধারিতভাবে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পায়। ঈদ উপলক্ষে পরিবহন ব্যবস্থায় বা ব্যবসায় ব্যাপক কর্মতৎপরতা বেড়ে যায়। শহরের মানুষ আপনজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের জন্য গ্রামে ছুটে। এক মাস আগে থেকে ট্রেন, বাস, লঞ্চের টিকিট বিক্রির তোড়জোড় দেখে বোঝা যায় এর প্রসার ও প্রকৃতি। নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ দামে ফর্মাল টিকিট আর ইনফর্মাল টাউট দালাল ও বিবিধ উপায়ে টিকিট বিক্রির সার্বিক ব্যবস্থা বোঝা যায়- এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় পরিবহন খাতে সাকুল্যে ২ হাজার কোটি টাকার বাড়তি ব্যবসা বা লেনদেন হয়েছিল। এটিও অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
এটা ঠিক অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ, মুদ্রা লেনদেন, আর্থিক কর্মকান্ডের প্রসারই অর্থনীতির জন্য আয়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মুদ্রা সরবরাহে গতিশীলতা আনয়ন। ঘূর্ণায়মান অর্থনীতির গতিপ্রবাহে যে কোনো ব্যয় অর্থনীতির জন্য আয়। দেশজ উৎপাদনে এর থাকে অনিবার্য অবদান। যে কোনো উৎসব অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতিশীলতা আনয়ন করে, মানুষ জেগে ওঠে নানান কর্মকান্ডে, সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থায় একটা স্বতঃপ্রণোদিত আবহ সৃষ্টি হয়। এ আবহকে স্বতঃস্বাভাবিক গতিতে চলতে দেওয়ায় কঠোরভাবে দেখভাল করতে পারলে অর্থাৎ সামষ্টিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও পারঙ্গমতা দেখাতে পারলে এ কর্মকান্ড, এ মুদ্রা সরবরাহ, ব্যাংকের এ তারল্য তারতম্য, পরিবহন খাতের এ ব্যয় প্রবাহ একে স্বাভাবিক গতিতে ধরে রাখতে পারলে অর্থনীতির জন্য তা পুষ্টিকর প্রতিভাত হওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে।
♦ লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান