রবিবার, ১৬ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

আমার বাবার স্মৃতি আমি যখন বাবা

অধ্যাপক জীবেন রায়

আমার বাবার স্মৃতি আমি যখন বাবা

আমি তিন কন্যার বাবা। তিনজনকে আমি আমার নিজস্ব নামে ডাকি। তেমনি মেয়েরাও আমাকে তিন ধরনের নামে ডেকে থাকে। যেমন বাপি, ড্যাডি, পাপা। মেয়েরা এখন এক একজন মহিলা। প্রায়ই আমি ভাবি, আমারও কি এক দিন বাবা ছিল? আর তখনই বাবার চেহারাটা মনের আয়নাতে ভেসে ওঠে। একজন সুপুরুষ, ফরসা, সৌম্যকান্তি ভদ্রলোক। সাত ভাইবোনের মধ্যে কনিষ্ঠ সন্তান হওয়ায় আমি বাবার যৌবনটা এমনকি মধ্যবয়সটাও দেখিনি। অনেক বয়স অবধি আমি মার সঙ্গেই ঘুমাতাম। পরবর্তীতে বাবার সঙ্গে। আমার আফসোস রয়ে গেল, আমার বিদেশে আসা, আমার উপার্জন কিছুই দেখে যেতে পারেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বছর পড়াকালেই বাবা আমার চোখের সামনেই শেষ নিঃশ্বাসটা ফেলেন।

অনেক ছোট্টবেলায় বাবার সঙ্গে হাত ধরে আমাদের গ্রামের বাড়ি, আগরপুর (কুলিয়ারচর) থেকে পাঁচ মাইল হেঁটে বাবার কাজের জায়গা, জাফরাবাদ গিয়েছি কয়েকবার। অফিসটাকে কাচারিঘর বলত। বড় বড় খাতা নিয়ে দোয়াত-কলম দিয়ে বাবাকে হিসাব-নিকাশ করতে দেখেছি। বাবার কাছে গ্রামের অনেক লোক আসত। সবাই বাবাকে ‘বাবু’ বলে ডাকত। কেউ আবার ‘বড় বাবু’ বলে ডাকত। বেশির ভাগ লোক দেখা হলেই আদাব জানাত। নাহ, আমার বাবা কোনো উচ্চশিক্ষিত চাকুরে বা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, শিক্ষক বা ব্যবসায়ী কোনো কিছুই ছিলেন না। জমিদারও ছিলেন না। তবে নয়-দশ বছর বয়সি আমি বুঝতে পেরেছিলাম, জমিদারি এস্টেটে কাজ করতেন। কিন্তু আমি ভালোভাবে বোঝার আগেই, বাবা অবসরে গেছেন। তারপর থেকে বাবা যদ্দিন বেঁচেছিলেন, ১২টা বছর অবশ্যই, আমি দোষত্রুটি কিছুই দেখিনি। কাউকে গালিগালাজ করতে শুনিনি। আশপাশের অনেক লোকজনই বেশ সমীহ করত।

অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালে বাবা আমাকে কুলিয়ারচর নিয়ে গিয়েছিলেন বৃত্তি পরীক্ষা দেব বলে। পথিমধ্যে কাপাসাটিয়া গ্রামে বিপ্লবী ত্রৈলক্ষ চক্রবর্তী মহারাজের বাড়ির রাস্তা। দেখা হয়ে গেল মহারাজের সঙ্গে। বাবা আমাকে প্রণাম করতে বলেন। ‘বাহ বেশ’-মহারাজ বললেন। আমার বাবা উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না কিন্তু শিক্ষিত ছিলেন, তাই পড়াশোনার ব্যাপারে দারুণ তৎপর থাকতে দেখেছি। বাবার কাজের জায়গায় কেউ কেউ বলত, “বাবুর ছোট্ট পোলাডা খুব সুন্দর হয়েছে। একদম বাপের মতন।’’ গ্রামের লোকজন গাছ থেকে পাকা কাঁঠাল এনে খেতে দিত। গাছ পাকা আম পেড়ে দিত। টস টসা লিচু এনে দিত। একসময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আমরা পিতা-পুত্র মাটির রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে রওনা হতাম। মাছে ভাতে, কচিৎ মাংস ভাত, তবে জীবনযাপনে কোনো অভাব টের পাইনি। অল্প কিছু ফসলি জমি ছিল। বাবা-মা এবং তিন ভাই নিয়ে সংসার। বাকি দুই ভাই, দুই বোন ভারতে ছিল। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের ফলে আমাদের বৃহত্তর পরিবার এমনিতেই দুই ভাগ হয়ে গেল। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আমি বড় ভাই বোনদের কখনো দেখেছি বলে তেমন মনে পড়ে না। আমি দেখেছি বাবা পয়সা গুনে গুনে, খাতায় লিখে লিখে খরচ করতেন। আমি প্রতিবার বাড়ি যাওয়ার সময় স্কলারশিপের টাকা দিয়ে বাবার জন্য টিনভর্তি বিস্কুট নিয়ে যেতাম এবং পছন্দ অনুযায়ী অন্য কিছু। তবে আমেরিকা এক দিন আসব সে কথা বাবাকে বলেছিলাম। আমাকে ঘিরে বাবা আনন্দেই কাটিয়ে চলে গেছেন পরলোকে। হয়তো কোনো এক দিন সেই পরলোকে দেখা হতে পারে।

হলেখক : বিজ্ঞান ও অঙ্ক বিভাগ, মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যান, কলম্বাস, যুক্তরাষ্ট্র

Email: [email protected]

 

সর্বশেষ খবর