রবিবার, ১৬ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

কবি নজরুলের ভাষায় কোরবানি

সোহেল সানি

কবি নজরুলের ভাষায় কোরবানি

ঈদ উৎসবের ন্যায় কোরবানিকেও সংগীত-ছন্দে সুরারোপিত করেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

১৯৩৭ সালে অনবদ্য এক রচনা তাঁর, “ও মোর রমজানের এই রোজা শেষে এলো খুশির ঈদ”...

তারপর কোরবানি নিয়ে তাঁর রচনা,

“তোরা ভোগের পাত্র ফেলরে ছুঁড়ে ত্যাগের তরে হৃদয় বাঁধ।”

ঈদুল ফিতরের সংগীতটিতে ছিল, কবির স্ব-কণ্ঠেরই সুর। কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীনের অনুরোধেই লিখেছিলেন, অপূর্ব ওই সংগীতটি।

এ ছাড়াও ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের ‘কোরবানি’ কবিতায় জাতীয় কবি নজরুল বলেছেন, ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!/এই দিনই ‘মীনা’-ময়দানে/পুত্র-স্নেহের গর্দানে/ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে/রেখেছে আব্বা ইব্রাহিম্ সে আপনা রুদ্র পণ!/ছি ছি! কেঁপো না ক্ষুদ্র মন!...

আজ আল্লার নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন!/ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!

কবি নজরুল যখন ইসলামী সংগীত লেখা শুরু করেন, তখন বাংলার রাজধানী কলকাতায় হিন্দু শিল্পীদের জয়জয়কার। তাই মুসলিম নাম ধারণ করে হিন্দুরাই তাঁর গান গাইতেন।

কবির ঈদুল ফিতরের সংগীতটিই ছিল ইসলামী সংগীত রচনার ক্ষেত্রে ‘মাইলফলক’। বিশেষ করে তখনকার ভারতীয় মুসলিম সমাজ, হিন্দু শ্যামাসংগীত রচনার জন্য যে নজরুলকে ‘কাফের’ বলত, সেই সমাজই ক্রমে তাঁকে সানন্দে গ্রহণ করল। বছর ঘুরে মুসলমানদের জন্য ঈদ-কোরবানি এলে নজরুলের এ সংগীত ও রচনা ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হয়ে আকাশে-বাতাসে অনুরণনের সৃষ্টি করে চলতে থাকে, সে কেবল বাংলাদেশে নয়, পশ্চিম বাংলাসহ সারা দুনিয়ার বাংলা-ভাষাভাষী প্রবাসী বাঙালিদের হৃদয়ে। সত্যিই কবি ঈদুল ফিতরের ন্যায় ঈদুল আজহার তাৎপর্যকেও মহিমান্বিত করেছেন, কাব্যিক ছন্দে, সুরের ফল্গুধারায়।

“কোরবানি কী এবং কেন?”

পবিত্র কোরআনে ‘কোরবান’ শব্দ ব্যবহৃত হলেও ফারসি ও হিন্দি-উর্দুতে শব্দটিকে “কোরবানি” রূপ দেওয়া হয়েছে। অর্থ, ‘নৈকট্য’। অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধির ও পবিত্রতার প্রধান মাধ্যম হলো কোরবান বা কোরবানি। কোরবানি বা কোরবান শব্দটি ‘কোরবুন’ মূলধাতু থেকে উ™ূ¢ত। যার বঙ্গানুবাদ সান্নিধ্য লাভ বা নৈকট্য অর্জন করা। অর্থাৎ বান্দা হিসেবে তার প্রিয়বস্তুকে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা। ঈদুল ফিতর একটি সামাজিক উৎসব, সমষ্টিগতভাবে আনন্দের অধিকারগত উৎসব। অন্যদিকে ঈদুল আজহা উৎসবের একটি অঙ্গ হচ্ছে কোরবানি। কোরবানি হলো চিত্তশুদ্ধির এবং পবিত্রতার মাধ্যম। এটি সামাজিক রীতি হলেও আল্লাহর জন্যই এ রীতি প্রবর্তিত হয়েছে। কাফির-মুশরিকরা তাদের দেব-দেবীর সম্মানে পশু বলি দেয়। মুসলমানরা কোরবানি দেয় আল্লাহর উদ্দেশ্যে। নানা ইতিহাস গ্রন্থ ও ঐতিহাসিক সূত্র থেকে বাংলাদেশে ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আজহা পালনের তথ্য পাওয়া যায় যে, ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে এলেও এ দেশে নামাজ, রোজা ও ঈদ অনুষ্ঠানের প্রচলন হয়েছে তার বেশকিছু আগে থেকে। কারণ বঙ্গদেশ যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে মুসলিম অধিকারে আসার বহু আগে থেকেই মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলিম সুফি, দরবেশ, সাধকরা ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলায় আস্তানা গড়েন। অন্যদিকে আরবীয় ও অন্যান্য মুসলিম দেশ থেকে বণিকরা চট্টগ্রামের বন্দর হয়ে বাংলার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরি করেন এবং ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য প্রচার করেন। সেই থেকে পূর্ব বাংলার ওপর একটি মুসলিম সংস্কৃতি তথা ধর্মীয় প্রভাব পড়ে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাঙালির ‘ঈদ’ উৎসবের সূচনাও ঠিক এভাবেই হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ঈদুল আজহা বা কোরবানি ঈদে বিভিন্ন দেশে মুসলমানরা সাধারণত উট, দুম্বা, ভেড়া, বকরি বা ছাগল, মহিষ, গরু ইত্যাদি কোরবানি দিয়ে থাকেন। তবে আদিকালে আমাদের দেশে কোরবানির জন্য ছাগল বেশি জনপ্রিয় ছিল, কেননা তখন গরু কোরবানি করা খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিল না। এর কারণ হিসেবে একটি তথ্যে দেখা যায়, ১০০-১৫০ বছর আগে বাংলাদেশে গরু কোরবানি দেওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। কোরবানি যদি কেউ দিতে চাইত তাহলে খাসি বা ছাগলই দিত। তৎকালীন বিখ্যাত সাহিত্যিক-রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ তাঁর আত্মজীবনীতে সে সময় ঈদুল আজহা সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন, ‘বকরা ঈদে কেউ গরু কোরবানি করত না। সে আমলে পরাক্রমশালী জমিদারদের তরফ থেকে গরু কোরবানি কড়াকড়িভাবে সর্বত্রই নিষিদ্ধ ছিল। শুধু বকরি কোরবানি করা চলত। মুঘল যুগে বাংলাদেশে ঈদুল আজহা কীভাবে উদযাপন করা হতো তা জানা যায়নি। এমনকি উনিশ শতকের শুরুতে ঈদুল আজহার তেমন কোনো বিবরণ পাওয়া যায়নি।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য হলো, ১০০-১৫০ বছর আগে ঈদ মুসলমানদের প্রধান উৎসব হিসেবে তেমনভাবে উদযাপিত না হওয়ার মূল কারণ ছিল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়া। এ ছাড়াও বিত্তহীনদের দরিদ্রতার কারণে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আশা-আকাক্সক্ষার স্ফুরণ না ঘটা। যদিও এ অবস্থার পরিবর্তন এনেছিল ফরায়েজী আন্দোলন (১৮১৫ খ্রি.)। উনিশ শতকের গোড়ায় যখন রাজনৈতিকভাবে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন থেকেই গুরুত্ব পেয়েছে ঈদ। তবে খানিকটা জাঁকজমকের সঙ্গে দুটি ঈদ উদযাপনের মধ্যে আছে বিত্তের সম্পর্ক।

স্বাভাবিকভাবেই শহর, মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে যারা ধনী, বিত্তবান তাদের ঈদ আর সাধারণ মানুষের ঈদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। অতীতে মুসলমানদের ঈদুল ফিতর যেমন বাংলাদেশে বড় কোনো ধর্মীয় উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয়নি, তেমনি উদযাপিত হয়নি ঈদুল আজহাও। আজকে আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনন্দ ও ধুমধামের সঙ্গে ঈদুল আজহা উদযাপন করি তা মাত্র ৬০-৭০ বছরের ঐতিহ্য।

♦ লেখক : সহকারী সম্পাদক বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

 

 

 

সর্বশেষ খবর