শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২০ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

মৃত্যুর মূল্য ও জীবনের পাঁচ অনুশোচনা

আসিফ হাসান নবী

মৃত্যুর মূল্য ও জীবনের পাঁচ অনুশোচনা

আমাদের যাপিত জীবনে ‘মৃত্যু’ শব্দটি কোনো আলোচনায় নেই। উচ্চারণ করতেই ভয় পাই। এটা একধরনের প্যারাডক্স। কেউ মৃত্যুর কথা বলামাত্রই বলি, ‘এমন কুকথা বলতে নেই, এটা বোলো না।’ কিন্তু কেন? জন্ম যখন আনন্দের, তখন মৃত্যু কেন আনন্দের হয় না? এটা সম্ভব নয় এ কারণে যে আমরা কেউই পৃথিবী ছেড়ে যেতে চাই না। অথচ অমোঘ সত্য এই যে মৃত্যু ঘটবেই। একটা সময় আমাদের এখান থেকে চলে যেতেই হবে। এই ভয়াবহ সত্যটি আমরা কিছুতেই মেনে নিতে চাই না। মৃত্যুকে কেন যেন আমরা অস্বীকার করতে চাই। ইংরেজিতে যাকে বলে ডিনাইয়াল। কেউ হাজার বছর বাঁচেননি এবং কেউ বাঁচবেনও না।

আমাদের ধর্মীয় অনুসঙ্গ বা বিধি-বিধানও মৃত্যু নিয়ে ভাবনায় বড় ধরনের বাধার সৃষ্টি করে রেখেছে। প্রতিটি ধর্মেই মৃত্যু নিয়ে একধরনের ভীতির কথা আছে। আমাদের অবচেতনে এসব এমনভাবে গেঁথে আছে যে বিষয়টি নিয়ে আমরা কোনো আলোচনাই করতে চাই না। অথচ দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ মানুষের কাছে মৃত্যু একটি অনিবার্য এবং অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনামাত্র। শোক-দুঃখ আর ব্যথার প্রতীক। চেতনার কোনো স্তরে এর স্থান দিতে আমাদের সবারই আপত্তি। তেমন কোনো গুরুত্ব দিয়ে মৃত্যু সম্পর্কে আলোচনাকে সবাই এড়িয়ে চলতে চান। সর্বোপরি দেখা যায় অলিখিত আইনে জীবন ও মৃত্যুর ব্যাখ্যা দেওয়ার একচেটিয়া অধিকার যেন ধর্মের। সাধারণ মানুষ নির্বিচারে এটাই মেনে নিয়ে প্রাত্যহিক জীবন নির্বাহ করেন।

অপরিণত প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুকে যেমন মেনে নেওয়া যায় না, তেমনি অনিরাময়যোগ্য মৃত্যু অবধারিত জেনেও ব্যর্থ নিরাময় চিকিৎসার পেছনে ছুটে চলা অযৌক্তিক। কিন্তু ঠিক এ কাজটি করেই গত ১০০ বছর ধরে মৃত্যুকে ভয়াবহ অমর্যাদা করে নিরাময় কেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয়েছে পৃথিবীজুড়ে মানুষ। নিরাময় অযোগ্যতাকে গ্রহণ করতে শিখছি না। প্যালিয়েটিভ কেয়ারের ওপর ল্যানসেট কমিশন রিপোর্ট এবং একই জার্নালে প্রকাশিত ‘ভ্যালু অব ডেথ’ নিবন্ধে এই কথাটিই বারবার বলা হয়েছে। মৃত্যু এবং জীবন একসঙ্গে আবদ্ধ : মৃত্যু ছাড়া জীবন হবে না। কমিশন স্বাস্থ্য ও সামাজিক পরিচর্যা পরিষেবার পাশাপাশি বৃহত্তর সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা এবং শোকাহত সহায়তা বৃদ্ধির সঙ্গে মৃত্যু এবং মৃত্যুর জন্য একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার প্রস্তাব করে।

ব্রণি ওয়্যার একজন অস্ট্রেলিয়ান নার্স। পেশাগত জীবনের তিনি প্রায় পুরোটা সময় ব্যয় করেছেন প্যালিয়েটিভ রোগীর পরিচর্যা করে। তাঁর হাতে তিনি অনেক মুত্যুকে প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি দেখেছেন মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত একজন মানুষ অন্তিম সময়ে কীভাবে নিজেকে মেলে ধরতে চান। ওই সময়ে তাঁর মধ্যে জীবনে পাওয়া বা না পাওয়ার এক জটিল মানসিকতার সৃষ্টি হয়। এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে Bronnie Ware লিখেছেন বিখ্যাত বই Top Five Regrets of the Dying: A Life Transformed by the Dearly Departing. পৃথিবীর প্রায় ৩২টি ভাষায় এই বইটি অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এই বইতে তিনি বলেছেন প্রায় সব মৃত্যুপথযাত্রীকেই তিনি দেখেছেন ৫টি অনুশোচনায় মানসিক কষ্ট পেতে। এই ৫টি অনুশোচনা হলো :

‘আহা! জীবনটা যদি আমি আমার মতো করে কাটাতে পারতাম। আমার স্বপ্নগুলোকে যদি ধারণ করতে পারতাম। আমি নিজের কাছে সত্য জীবনযাপন করার সাহস পেতাম, অন্যরা আমার কাছে যে জীবন প্রত্যাশা করে তা নয়।’ ব্রণি ওয়্যার এর ব্যাখ্যায় বলছেন, যখন মানুষ বুঝতে পারে যে তাদের জীবন প্রায় শেষ হয়ে গেছে, তখন উপলব্ধি করে তার কত স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে গেছে। বেশির ভাগ মানুষ তাদের স্বপ্নের অর্ধেকও সম্মান করেনি।

আহা! আমি যদি এত কঠোর পরিশ্রম না করতাম। অন্যের চাপানো জীবনটাকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমি কেন এত কঠোর পরিশ্রম করলাম। এর ব্যাখ্যায় লেখক বলছেন, অধিক পরিশ্রমের কারণে তারা তাদের বাচ্চাদের যৌবন এবং তাদের সঙ্গীর সঙ্গ মিস করেছে।

আহা! আমি যদি আমার অনুভূতি প্রকাশ করার সাহস পেতাম। অন্যের কথা না ভেবে আমি যদি আমার মনের অনুভূতিগুলো বর্ণনা করতে পারতাম। লেখকের ভাষায় একজন মানুষ অন্যদের সঙ্গে শান্তি বজায় রাখার জন্য তাদের অনুভূতিগুলোকে দমন করে রাখে। আক্ষেপ আরেকটু যদি সময় পেতাম?

আহা! আমি যদি আমার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম। আমার প্রকৃত বন্ধুদের সঙ্গে যদি আরও একটু সময় দিতে পারতাম। লেখক বলছেন, বন্ধুত্বকে তাদের প্রাপ্য সময় এবং প্রচেষ্টা না দেওয়ার জন্য অনেক গভীর অনুশোচনা ছিল তাদের যখন তারা মারা যায়।

আহা! জীবন আমাকে যা কিছু দিয়েছিল তাতেই আমি যদি সুখী হতে পারতাম। আরেকটু বেশি কিছু পাওয়ার আশায় একটু বেশি করবার নেশায় কেন আমি দৌড়ে বেড়ালাম। কেন সুখটা আমার সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও সেটা আমি উপভোগ করতে পারলাম না। ব্রুণি ওয়্যারের ভাষায় এটি একটি খুবই মর্মান্তিক এবং বাস্তববোধের উপলব্ধি। প্রতিটি মানুষের কাছেই সুখের উপাদান আছে। কিন্তু সে আরও সুখের নেশায় ছুটে বেড়ায়। শেষ পর্যন্ত হয়তো সেই সুখ পায় অথবা পায় না। শুধু শুধু ছুটে সারাটি জীবন কষ্টই পেয়ে গেছে। তার আক্ষেপ জন্মে, আরেকটু সময় কি পাওয়া যায় না?

এখন পর্যন্ত আমাদের সবচেয়ে বড় অনুশোচনা কী? মারা যাওয়ার আগে কী অর্জন করব বা পরিবর্তন করব? আমরা যদি এই ৫টি অনুশোচনা থেকে মুক্তি পেতে চাই তাহলে আমাদের চিন্তা এবং কাজগুলোকে আজকেই ঠিক করে নিতে হবে।

লেখক : গবেষক

সর্বশেষ খবর