শুক্রবার, ২১ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে বাগ্‌যুদ্ধ

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে বাগ্‌যুদ্ধ

আজ থেকে ঠিক ১৪৮ বছর আগের কথা। বর্তমানে আমেরিকার মানতানা রাজ্যে বয়ে চলা লিটল বিগ হর্ন নদীর তীরে স্বাধীনভাবেই বাস করত বেশ কিছু উপজাতীয় গোষ্ঠী। সাদা চামড়ার স্বর্ণের খনি অনুসন্ধানকারী তথা স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা আমেরিকার মূল ভূখণ্ড থেকে এসে আস্তানা গাড়তে শুরু করে এই নদীর তীরে, যা ক্রমেই সংঘাতের রূপ লাভ করে। সাদা চামড়ার স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের পক্ষ নেয় আমেরিকার তৎকালীন সরকার। উপজাতীয়দের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দমন করতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জর্জ আর্মস্ট্রং কাস্টারের নেতৃত্বে সপ্তম ক্যাভ্যালরি রেজিমেন্টের ৭০০ অশ্বারোহী বাহিনী মোতায়েন করা হলো। ১৮৭৬ সালের ২৫ ও ২৬ জুন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হলো আমেরিকার সৈন্য ও উপজাতীয়দের মধ্যে। ২৬৮ আমেরিকান সৈন্য মৃত্যুবরণ করে এই যুদ্ধে। আহত হয় আরও ৫৫ জন। উপজাতীয়দের মধ্যে কতজন প্রাণ হারায়, তা নিশ্চিত বলতে পারেনি কেউ। জানা মতে, সর্বনিম্ন ৩১ জন এবং সর্বোচ্চ ৩০০ উপজাতির জীবনহানির খবর তখন চাউর হয়েছিল। আর আহত হয় ১৬৮ জন। একদিকের সৈন্যরা ছিল সাদা চামড়ার ও অভিজাত শ্রেণির। অন্যদিকের উপজাতীয়রা ছিল কালো, বাদামি ও শ্যামলা বর্ণের। তবে উভয় পক্ষের সেনাদের রক্তের রং ছিল লাল। তাই ২৫ ও ২৬ জুন লিটল বিগ হর্ন নদী জাতি, গোত্র বা বর্ণ ভেদে কেবল মানুষের লাল রক্তে রঞ্জিত হওয়ার দিন। এই দুই দিনের যুদ্ধে আমেরিকানরা পরাজয় বরণ করেছিল উপজাতীয়দের কাছে।

অতিসম্প্রতি ১৪৮ বছর আগের সেই ভয়াল ও রক্তাক্ত ইতিহাস মনে পড়ল নাফ নদের তীরবর্তী সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শঙ্কা ও পরবর্তী সময়ের বাগ্যুদ্ধ, উসকানি, পাল্টা জবাব এবং নানামুখী বিশ্লেষণ দেখে।

সরকারি তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার ৬ নম্বর ইউনিয়নের নাম সেন্টমার্টিন। এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ ও সবচেয়ে দক্ষিণের ইউনিয়ন। ১৯৭৭ একর বা ৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা এই দ্বীপে ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে ১০ হাজার বাংলাদেশি বসবাস করে। এ ছাড়া প্রায় সারা বছরই পর্যটনে মুখরিত থাকে এ প্রবাল দ্বীপ। একদিকে নাফ নদের জলরাশি এবং বাকি তিনদিকে বঙ্গোপসাগরের নোনাজলে পরিবেষ্টিত মিষ্টি ডাবসমৃদ্ধ দ্বীপটি নিয়ে বর্তমানে চলছে তেতো কথাবার্তা।

পৃথিবীতে অসংখ্য দ্বীপ আছে, যেখানে কোনো মানুষ বসবাস করে না। মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া কিংবা ফিলিপাইনসের মতো বহু দেশ গড়েই উঠেছে অসংখ্য দ্বীপ নিয়ে। কিন্তু সেখানকার সব দ্বীপের তেমন কদর না থাকার বিপরীতে সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে এত আলোচনা, আগ্রহ, তর্ক-বিতর্কের নেপথ্যে মোটা দাগে দুটি কারণ আছে বলে ধরা যায়। এক. সেন্টমার্টিনের ভূপ্রকৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান ও সামরিক ঘাঁটি করার উপযুক্ততা। দুই. ভূরাজনীতিতে সেন্টমার্টিনের গুরুত্ব।

প্রথম কারণের স্বপক্ষে বলা যায়, সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড তথা টেকনাফ থেকে কিংবা মিয়ানমার ভূখণ্ড থেকে খুব দূরে নয়। তাই মূল ভূখণ্ড থেকে এই দ্বীপে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে বৈদ্যুতিক সংযোগ, ইন্টারনেট ক্যাবল, জ্বালানি তেল এবং মিষ্টি পানি সঞ্চালনের পাইপলাইন সংযোগ দেওয়া কষ্ট ও ব্যয়সাপেক্ষ হলেও সম্ভব একটি কাজ। এই দ্বীপের চারদিকে খোলা সমুদ্র। তাই স্থলভাগ ছেড়ে দূরবর্তী গভীর সমুদ্রে দীর্ঘদিন অবস্থান করা নৌবহর থেকে জঙ্গি হেলিকপ্টার, ছোট ছোট যুদ্ধবিমান বা পানিতে নামতে সক্ষম বিমান বা বিমান অ্যাম্বুলেন্স সহজে নামতে পারবে এই দ্বীপ ও দ্বীপের নিকটবর্তী জলভাগে। সমুদ্রের পানির গভীরতার কারণে বিভিন্ন আকারের যুদ্ধজাহাজ নোঙর ফেলতে পারে সেন্টমার্টিনের চারপাশে। দ্বীপটির জনসংখ্যা কম থাকায় জনবসতির অপেক্ষাকৃত কম ক্ষয়ক্ষতি করেই এখানে সামরিক ঘাঁটি করা সম্ভব। দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বালুকাময় সাগরতীর দীর্ঘদিন সাবমেরিনে থাকা নৌ- সেনাদের ও নৌবহরে থাকা নৌবাহিনী সদস্যদের মাটির স্বাদ গ্রহণ, মানসিক অবসাদ দূর ও রৌদ্র উপভোগের অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করে। তাই ভৌগোলিকভাবে যে কোনো প্রতিরক্ষা বা সম্মিলিত বাহিনীর কাক্সিক্ষত একটি গন্তব্য বা চাওয়া হতে পারে এই সেন্টমার্টিন দ্বীপ।

দ্বিতীয়ত, সামরিক বিবেচনায় এই দ্বীপের যৌক্তিক বা জুতসই দূরত্বে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও চীন। দ্বীপটিকে দখলে রেখে সেখানে দূরপাল্লার কামান, রকেট, ড্রোন বা মিসাইলের মজুত গড়ে তোলা হলে তা ওপরের সবকটি দেশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং তা মোকাবিলায় এসব দেশ সামরিক খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হবে। বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বজায় রাখতে চীন ও ভারত প্রায় পাল্লা দিয়ে সেন্টমার্টিনের মোটামুটি কাছেই অবস্থিত মিয়ানমারের রাখাইনসহ বঙ্গোপসাগর তীর বরাবর অর্থনৈতিক অঞ্চল, বন্দর এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অব কাঠামো নির্মাণ করে নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের সেখানে কাজের সুযোগ করে দিয়েছে। এসব নাগরিক ও নিজ দেশের বিনিয়োগের নিরাপত্তা রক্ষার অজুহাতে চীন ও ভারত মূলত এই অঞ্চলে সেনা মোতায়েনের উপলক্ষ তৈরি করেছে। বিশ্ব মোড়ল আমেরিকার পক্ষে চীন ও ভারতের প্রভাবকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সীমিত রাখতে হলে সেন্টমার্টিন বা পার্শ্ববর্তী এলাকায় সামরিক ঘাঁটি গড়তে কিংবা সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরের নৌবহর রাখার বহু যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ মিয়ানমারের সীমান্তসংলগ্ন এলাকা ও সেন্টমার্টিনের পূর্বদিকে থাকা মিয়ানমারের জলসীমা ও উপকূলবর্তী অঞ্চলে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলছে বছরের পর বছর ধরে। সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি আধুনিক সমরাস্ত্র ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জামে সুসজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সরকারি বাহিনীর ওপর। প্রায় সব ক্ষেত্রেই সফল হয়ে তারা কোণঠাসা করছে সরকারি বাহিনীকে। প্রশ্ন উঠেছে, আরাকান আর্মির নেপথ্যে কে আছে? চীন, আমেরিকা, ভারত না অন্য কেউ?

মিয়ানমারের সামরিক জান্তারা মূলত চীনের ইশারা ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বিশ্ববাসীকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখায় বলেই বিশ্বাস করা হয়। সম্প্রতি চীনই আরাকান আর্মিকে সমর্থন দিয়ে মিয়ানমার সরকার তথা সামরিক জান্তাদের চীনের প্রতি আরও নতজানু হওয়ার তথা ভারতবিমুখ করার পরিকল্পনা চরিতার্থ করছে বলে একদল বিশ্লেষকের ধারণা। আবার এটাও ধারণা করা হচ্ছে, আরাকান আর্মি যেন আমেরিকার সাহায্য না চায় বা না পায়, তারই কৌশল হিসেবে চীন আরাকান আর্মির পাশে দাঁড়িয়েছে।

অতিসম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্ত থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের দিকে গুলি ছোড়া হয়েছিল। এ ছাড়া মিয়ানমার নৌবাহিনীর ৩টি যুদ্ধজাহাজ মিয়ানমার জলসীমার সামুদ্রিক জলসীমায় অবস্থান নেয়, যা সেন্টমার্টিন থেকে দেখা যেত। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনগামী যে ট্রলার ডুবোচর বা পানির গভীরতা কম থাকায় নাফ নদের মিয়ানমার জলসীমা অংশ ক্ষণিকের জন্য ব্যবহার করে চলাচল করেছে, সেসব ট্রলারের কোনো কোনোটি লক্ষ্য করে মিয়ানমার সীমান্ত থেকে গুলি ছোড়ার কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, মূলত শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা বা আতঙ্ক থেকেই আরাকান আর্মি এমন গুলি ছুড়তে পারে। আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ না করার অভিমান থেকেও এমন গোলাগুলি হতে পারে বলে ধারণা করছেন কেউ কেউ। অন্যদিকে মিয়ানমার নৌবাহিনী অন্তত তাদের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতিতে সেন্টমার্টিন দখল করতে চাইতে পারে না। আরাকান আর্মির জন্য ও সেন্টমার্টিন দখলের চেয়ে রাখাইন রাজ্য ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় তাদের দখলকৃত ভূমি সুরক্ষা করা, সেখানকার প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড নিজেদের আয়ত্তে আনা, সর্বোপরি আরাকান আর্মিবিরোধী অন্য কোনো উপদলে রোহিঙ্গাদের যোগদান ঠেকানো বেশি জরুরি। সুতরাং এ নিয়ে আতঙ্ক নেই বলেই ভাবছেন অনেকে। সর্বশেষ নির্বাচনে ভারতে মোদি সরকার আগের নির্বাচনের তুলনায় অনেক খারাপ ফলাফল করেছে। পুনরায় সরকার গঠন করলেও লোকসভায় বিজেপির আগের মতো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। এমতাবস্থায় মোদি সরকার এখন নিজেদের গোছাতেই মনোযোগ দেবে, সেন্টমার্টিন নিয়ে নয়।

এই শতকে আমেরিকা অন্য দেশে সরাসরি যুদ্ধের বদলে প্রক্সি ফোর্স বা পঞ্চম বাহিনীর সৃষ্টি করে প্রক্সি যুদ্ধ বাধিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে চলেছে। একজনও আমেরিকান সৈন্য না পাঠিয়ে ফিলিস্তিনকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার কিংবা ইউক্রেনকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার সব কৌশলই আমেরিকার জানা। আমেরিকার পক্ষে সেন্টমার্টিন দখলের চেষ্টা হবে সরাসরি চীন ও ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সামনে রেখে আমেরিকার পক্ষে এমনটি অন্তত এই মুহূর্তে করার সম্ভাবনা দেখছেন না সামরিক বিশ্লেষকরা। তাই বলে বাংলাদেশকে নিশ্চিন্তে বসে থাকলে চলবে না। আরাকান আর্মির সঙ্গে নীরবে বা গোপনে যোগাযোগ এখন সময়ের দাবি। রোহিঙ্গারা যেন আরাকান আর্মির বিপক্ষে কোনো দলে সম্পৃক্ত না হতে পারে তাও নিশ্চিত করতে হবে। আর রোহিঙ্গারা যদি কোনো পক্ষ অবলম্বন করতে চায়, তবে অবশ্যই তা হতে হবে তাদের নিজ ভূখণ্ডে প্রত্যাবর্তন ও পূর্ণ নাগরিকত্ব পাওয়ার বিনিময়ে। এ বিষয়টি গোয়েন্দাদের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে। কূটনৈতিক ও গোয়েন্দাগিরির দক্ষতা প্রমাণের এখনই সময়। আর মনে রাখতে হবে যুদ্ধ প্রস্তুতি যুদ্ধের সম্ভাব্যতা এড়ানোর অন্যতম উপায়।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

Email: [email protected]

সর্বশেষ খবর