শুক্রবার, ২১ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

বাড়ছে নারী ও শিশু নিপীড়ন

খায়রুল কবির খোকন

বাড়ছে নারী ও শিশু নিপীড়ন

এটা সত্য যে, আঠারো কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে একটানা মাছ, মাংস, শাক-সবজি, ফলমূল ও খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়াচ্ছে কৃষক, এ সাফল্য তার নিজের গরজেই। বিশেষভাবে গত দুই-তিন দশকে কৃষিবিজ্ঞানীদের একটা অংশের কর্মতৎপরতায় কৃষকসমাজ প্রচণ্ড পরিশ্রমে নিজের ও পরিবার-পরিজনের খাওয়া-পরাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে কৃষিপণ্য উৎপাদন বাড়িয়ে চলেছে। তৈরি পোশাক রপ্তানি কর্মকাণ্ডের উন্নয়নে হাজার চারেক শিল্পকারখানা উদ্যোক্তা প্রায় পঁয়তাল্লিশ লাখ শ্রমিকের (বেশির ভাগই নারী-শ্রমিক) প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান করেছেন, পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে আরও প্রায় কুড়ি লাখ মানুষের; তাছাড়া বিভিন্ন সম্পদশালী রাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি কুড়ি লাখ মানুষ (যাদের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত হয়েও নিজের যোগ্যতা অনুসারে কাজ না পেয়ে অগত্যা কামলার কাজ করে) কামলা খেটে পয়সা উপার্জন করে প্রায় প্রতিদিন দেশে পাঠাচ্ছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। ফলে দেশের নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা-সংকটের মাঝেও অর্থনৈতিক অগ্রগতি দ্রুততার সঙ্গে চলমান। যদিও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সংকটে মূল্যস্ফীতি এবং রাজনৈতিক নেতাদের ও আমলাতন্ত্রের ক্ষমতাকেন্দ্রিক অপরিসীম দুর্নীতি অনেক সাফল্য ম্লান করে দিচ্ছে। প্রেসিডেন্ট জিয়া সত্তর দশকের শেষভাগে এবং আশি দশকের শুরুতে ছয় বছরে এ উন্নয়নের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেছেন। দেশে উন্নয়নের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে মারাত্মকভাবে। নারী ও শিশু নিপীড়ন পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। রাষ্ট্র ও সমাজ পড়েছে স্বেচ্ছাচারী ও মতলববাজ দুর্নীতিবাজদের কবলে। দেশের আঠারো কোটি জনসংখ্যার মধ্যে পঁচাশি শতাংশেরও বেশি, মানে প্রায় সাড়ে পনেরো কোটি রয়েছে অসহায়দের দলে। রাজনৈতিক সরকার তার ‘ইজ্জত-বাঁচানোর জন্য’ যেটুকু উন্নয়ন প্রচেষ্টা চালায় তার সর্বশেষ এবং সর্বোচ্চ ক্ষতিটা করছে নিরেট মগজ, দেশপ্রেমবর্জিত ও দুর্নীতিবাজ এবং অদক্ষ-আমলাতন্ত্র। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আমলারাও এর অন্তর্ভুক্ত।

বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো তাদের মানবাধিকার রক্ষা কার্যক্রম ও দরিদ্র সেবা তৎপরতায় সক্রিয়। দেশি-বিদেশি অর্থায়ন, সাহায্য-সহযোগিতা আসছে ব্যাপকভাবে এবং এর ফলে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী তৎপরতা বিরোধী এনজিও কর্মকাণ্ড বেড়েছে ব্যাপকভাবে। আবার একই সঙ্গে অবিশ্বাস্য গতিতে বেড়েছে নারী ও শিশু নিপীড়ন। এনজিওগুলো সভা-সেমিনার, রাস্তায় মানববন্ধন ইত্যাদি করে লোকদেখানো তৎপরতায় মিডিয়ায় পাবলিসিটি পাচ্ছে ব্যাপকভাবে। ফলে তাদের তহবিল প্রাপ্তিও বেড়েছে দ্রুততার সঙ্গে।

আসল বাস্তবতা হচ্ছে এনজিও কর্মীদের মূল কর্মকাণ্ড অকার্যকর, অর্থাৎ তাদের কাজের লক্ষ্য কখনোই সুনির্দিষ্ট সাফল্য অর্জনের জন্য নয়, তাই সেসব লক্ষ্যে পৌঁছার প্রচেষ্টার মধ্যেও বিস্তর ফাঁক ও ফাঁকি বিদ্যমান। ফলে ওইসব উদ্দেশ্য কেবলই বিদেশি দাতাদের ফান্ড হালাল করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত। কখনোই তা এ দেশের মানবসমাজের প্রকৃত উপকারে লাগে না। আর নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় আমাদের সমাজে অপরাধপ্রবণ লোকজনের সংখ্যা বাড়াচ্ছে অপরিসীম সংখ্যায়। যখন প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্ব ছাড়াই সরকার চালানো সম্ভব হয় তখন নৈরাজ্য ছড়ায় রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি স্তরে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সুশাসন ভেঙে পড়ে। জবাবদিহিতা কী বস্তু তা এ দেশে দৃশ্যমান নয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে স্বাভাবিক নিয়মে।

ক্ষমতাধরদের আসকারা পেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো দায়িত্বজ্ঞানহীন, অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজে পরিণত হতে বাধ্য হচ্ছে। এ সুযোগে জমিদারতান্ত্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর মধ্যে নারী ও শিশু নিপীড়ন বাড়ছে অপ্রতিরোধ্যভাবে। এর ফলে সারা দেশে যখন-তখন নারী ও শিশু হত্যা, অপহরণ, গুম, খুন বেড়ে যায়। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললে, টেলিভিশন চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর দর্শক-শ্রোতা হলে এসব নৈরাজ্য দেখে সাধারণ নাগরিকরা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। হতাশার গ্লানিতে নিদারুণ বিষণ্নতায় ডুবে যান।

নারীর ওপর বিকৃত রুচি বা যৌন বিকারগ্রস্ত বা ‘পারভার্ট’ ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা, রাস্তাঘাটে ‘ইভ টিজিং’, ঘরে-বাইরে সর্বত্র নিজের স্বজন ও বাইরের মানুষ কর্তৃক নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু। বিশেষভাবে কন্যাশিশু নিপীড়ন এখন চরমে। যখন উচ্চশিক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার মানুষের বা রাজনীতিকের ও আমলার বাড়িতেও কিশোরী গৃহকর্মী নিরাপদ থাকে না, তখন কোথায় খুঁজবেন নারী কিংবা কন্যাশিশু বা ছেলেশিশুর নিরাপত্তা? শিশু শ্রম রাষ্ট্রীয় আইনে নিষিদ্ধ, অথচ উচ্চশিক্ষিত, এমনকি উঁচুমাপের সংস্কৃতিমান পরিবারে গৃহকর্মী নেওয়া হয়- কন্যাশিশু বা ছেলেশিশুকে। হতদরিদ্র ও গরিব-পরিবারের শিশুরা সম্পদশালী ক্ষমতাধরদের পরিবারে ‘গৃহকাজের’ নামে নির্যাতিত হয়, এমনকি হত্যাকাণ্ডেরও শিকার হয় অথবা আত্মহত্যার প্ররোচনায় পড়ে। কতটা নিষ্ঠুর তারা তা বিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্ট্রের মানুষ কল্পনাও করতে পারে না।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এসব বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, নারীপক্ষ এবং আরও অনেক নারী সংগঠনসহ বিভিন্ন নারী ও শিশুর অধিকার রক্ষার আন্দোলনকারী প্রতিষ্ঠান, সংগঠন নারী ও শিশু হত্যা এবং নারী-শিশু নিপীড়নের মাসিক ও বার্ষিক পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে প্রকাশ করে থাকে, সব পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশন মিডিয়ায় তা ভালোভাবেই প্রকাশ করা হয়। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও লাখ লাখ নারী-পুরুষ সেসব নিয়ে আলোচনার ঝড় তোলেন। কিন্তু রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব গুরুতর অপরাধ দমনে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না। সেজন্য দায়ী তাদের দুর্নীতি ও অদক্ষতা। রাজনৈতিক সরকারের জবাবদিহিতা ‘শূন্য পর্যায়ে নেমে আসছে’- এ অভিযোগ দেশবাসীর।

লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক ডাকসু সাধারণ সম্পাদক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর