শনিবার, ২২ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

প্রাণী চামড়ার দাম নেই কেন?

শাইখ সিরাজ

প্রাণী চামড়ার দাম নেই কেন?

শৈশব থেকে দেখে এসেছি কোরবানির পর প্রাণীর চামড়াটিকে আলাদা করে রাখা হতো। কয়েকজন আসত কোরবানির প্রাণীর চামড়া কিনতে। তারা মূলত কোরবানির পর বাড়ি বাড়ি ঘুরে চামড়া সংগ্রহ করত। যে বেশি দাম বলত তার হাতেই চামড়াটা তুলে দেওয়া হতো। চামড়া বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যেত তা বিলিয়ে দেওয়া হতো গরিব-দুঃখীদের মাঝে। এরপর এক সময় বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানার ছাত্ররা এসে সংগ্রহ করত কোরবানির প্রাণীর চামড়া। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই কোরবানির চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। কেউ চামড়া নিতে আসছে না। যদিও এক-দুজন আসছে, তারা লাখ টাকার গরুর চামড়ার দাম বলে এক-দেড়শ টাকা। ছাগল-খাসির চামড়া নিতেই চায় না।

আমি এবার ঈদের পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা আমার কয়েকজন পরিচিত জনের সঙ্গে চামড়ার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছি। জানতে চেয়েছি তাদের অভিজ্ঞতার কথা।

একজন বলেছেন, কোরবানির পর কেউ চামড়া নিতে আসেনি। পরে বাধ্য হয়ে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেছে। আরেক জন জানালেন, তারা গরু ও খাসি কোরবানি দিয়েছে। লাখ টাকার উপর কেনা গরুর চামড়াটি বিক্রি করেছে ১০০ টাকায়। খাসির চামড়া নিতে রাজি হয়নি। পরে খাসির চারটি পায়া দেওয়ার শর্তে চামড়াটি নিতে রাজি হয়। বেশির ভাগের ভাষ্য হচ্ছে, চামড়া নিতে ক্রেতাদের অনীহা। সরকার লবণ দেওয়া চামড়ার সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করে দিলেও তার প্রভাব চামড়া ক্রেতাদের ওপর লক্ষ্য করা যায়নি।

এ বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চামড়া খাতে বাণিজ্য সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে কোরবানির প্রাণীর চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয়। ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫-৬০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে নির্ধারণ করা হয় ৫০-৫৫ টাকা। খাসির চামড়া বর্গফুট প্রতি ২০-২৫ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৮-২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত মাঝারি আকারের গরুর চামড়ার আয়তন হয় ২০-৩০ বর্গফুট। সে হিসাবে একটি লবণ দেওয়া চামড়ার দাম হওয়ার কথা দেড় হাজার টাকার মতো। পরিবহন, লবণ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ এবং খুচরা ক্রেতার লাভ বাদ দিলেও একেকটি কাঁচা চামড়ার সর্বনিম্ন দাম হওয়া উচিত এক হাজার টাকা। কিন্তু এই দামে কি কেউ চামড়া বিক্রি করতে পেরেছেন?

অথচ স্বাধীনতার পর থেকে শুনে আসছি ‘চামড়া শিল্প’ আমাদের দেশের সম্ভাবনাময় একটি খাত। জেনে অবাক হবেন আমাদের মতোই একটি দেশ ভিয়েতনাম চামড়া রপ্তানি করে বছরে আয় করে ২০ বিলিয়ন ডলার। আর আমরা চামড়া রপ্তানি করে বছরে আয় করি মাত্র এক বিলিয়ন ডলার। আমাদের রপ্তানি চামড়ার ৮০ শতাংশ যায় চীনে। চীন আমাদের ক্রাস্ট বা অর্ধ ফিনিশ চামড়া নিয়ে গিয়ে ফিনিশ করে বাণিজ্য করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের। আর আমরা এই সম্ভাবনাময় বাণিজ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি শুধু সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের অভাবে।

একটা মাঝারি আকারের গরুর চামড়ায় ১০ জোড়া জুতা তৈরি করা যায়। প্রতি জোড়া জুতার দাম কম করে ২ হাজার টাকা ধরে হলেও চামড়ার মূল্য সংযোজন সম্ভব ২০ হাজার টাকার। সেখানে কাঁচা চামড়ার দাম কী করে ২০০-৩০০ টাকা হয়।

 প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া হিসাবে এ বছর ১ কোটি ৪ লাখ প্রাণী কোরবানি দেওয়া হয়েছে। এর মাঝে গরু প্রায় অর্ধলাখের মতো। এছাড়াও সারা বছর বিপুল পরিমাণ গবাদি প্রাণী জবাই করা হয়। চামড়া শিল্পের কাঁচামালের চমৎকার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়ে আছে। এখান থেকে আমরা সফল একটি খাত তৈরি করতে না পারার কারণ অনুসন্ধান করা জরুরি।

গত পাঁচ বছরে কোরবানি গরুর দাম বেড়েছে দ্বিগুণ অথচ কোরবানি গরুর কাঁচা চামড়ার দাম কমে এসেছে পাঁচ গুণেরও বেশি। বলা হচ্ছে, আমাদের দেশে ট্যানারিগুলোর জন্য ক্র্যাকর কোনো সেন্ট্রাল এফ্লুয়েনন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (সিইপিটি) নেই। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) বলছে সাভারে একটি সিইপিটি বসানো হয়েছে কিন্তু সেটি ত্রুটিপূর্ণ। দীর্ঘদিন ধরেই ওভাবে পড়ে আছে।

বিদেশে চামড়া রপ্তানির ক্ষেত্রে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ নিতে হয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের এলডব্লিউজি অনুমোদিত ট্যানারি আছে ২৫০টি, এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই আছে ৪২টি। আমরা এ বিষয়ে গ্যাপ সার্টিফিকেশনের মতোই পিছিয়ে আছি।

প্রতি বছর লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে প্রশিক্ষিত জনশক্তি বের হচ্ছে তাদেরও আমরা কাজে লাগাতে পারছি না।

আমাদের জনশক্তির বড় একটি অংশ বেকার। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সুপরিকল্পিত নীতিমালার মধ্যে এনে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। উদ্যোগটি সরকার কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে বেসরকারিভাবেও নেওয়া যেতে পারে।

আমাদের পাদুকাশিল্প ছাড়াও চামড়াজাত পণ্যের বড় একটি বাজার আছে। মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে ল্যাপটপ বা ট্যাবের কাভারের যে পরিমাণ চাহিদা আছে তা নির্মাণ করা গেলেও চামড়ার ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে। আড়ং যেমন দেশীয় নকশিকাঁথার মতো ঐতিহ্যমণ্ডিত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে। সেভাবে চামড়ার শৈল্পিক ব্যবহারের মাধ্যমে সারা বিশ্বে আমাদের ঐতিহ্য হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে।

কোরবানির সময় কমমূল্যে কাঁচামাল সংগ্রহ করে স্থানীয়ভাবেও জুতা ও ব্যাগ তৈরির কারখানা স্থাপন করা যেতে পারে। আগ্রহী তরুণরা এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারেন।

এ বিষয়ে প্রথমেই দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। মানসম্মত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। আমাদের দেশে সাধারণত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা প্রথমে কোনো কিছু নিয়ে এগিয়ে গিয়ে পথ আবিষ্কারের পর সেখানে বড় শিল্পোদ্যোক্তরা বিনিয়োগ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের হটিয়ে দেয়। পোলট্রি খাত এর বড় একটি উদাহরণ। তাই এ বিষয়ে সরকারের সুষ্ঠু নীতিপরিকল্পনা থাকতে হবে।

ঈদের আগে দেশের বিভিন্ন খামারির সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাদের প্রত্যেকেই বলেছেন প্রাণিখাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তারা যদি মাংসের পাশাপাশি চামড়ার দামটাও পেত তা হলে তা মাংসের দামের সঙ্গে সমন্বয় করা সম্ভব হতো।

ঈদুল আজহায় কোরবানির প্রাণীর চামড়ার দাম না পাওয়ায় যে পরিমাণ চামড়া পুঁতে ফেলা হয়েছে বা নষ্ট হয়েছে তা বিশাল একটি অপচয়। এই অপচয়ের ফলে শুধু যে রাষ্ট্রই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, নষ্ট করা হচ্ছে দরিদ্রের হক। এ বিষয়ে আমাদের সবার সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত।

ঈদের আগেই প্রত্যেক গ্রাম থেকে শুরু করে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে একটি সুপ্রশিক্ষিত টিমকে লভ্যাংশের সঙ্গে যুক্ত করে মাঠে নামানো যেতে পারে। তারা চামড়া সংগ্রহ করে তা ঠিক-ঠাক মতো সংরক্ষণ করবে। আমরা প্রসেসিং করতে না পারলেও সংগৃহীত চামড়াগুলো বিক্রি করা সম্ভব। পাশাপাশি চামড়ার কুটিরশিল্পও গড়ে তোলা যেতে পারে।

চামড়াকে ঘিরে তৈরি হতে পারে রপ্তানিমুখী অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনা। সম্ভাবনাময় এমন একটি খাতকে আমরা কেন ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দিচ্ছি, আমি সেটি বুঝতে পারি না। সম্প্রতি এ বিষয়ে সরকার একটি আইন প্রণয়ন করেছে। আশা করি শিগগিরই সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে। সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়েও এ খাতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। চামড়া খাত সচল ও লাভজনক হলে এর সুপ্রভাব পড়বে প্রাণী উৎপাদনের খামারগুলোতেও।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর