রবিবার, ২৩ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

ইতিহাসের পাতায় আওয়ামী লীগের সাফল্য-ব্যর্থতা

নঈম নিজাম

ইতিহাসের পাতায় আওয়ামী লীগের সাফল্য-ব্যর্থতা

ইতিহাসের অমর অধ্যায়ে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। প্রবীণ এ রাজনৈতিক দলটি ৭৫ বছর উদ্যাপন করছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দলটির দীর্ঘ পথচলায় সাফল্য যেমন রয়েছে, তেমন ব্যর্থতাও কম নয়। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় সাফল্য ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর রাজপথে অবস্থান নিতে না পারা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকার বিচ্ছিন্ন কয়েকটি সড়ক ছাড়া কোথাও কোনো বাধা ছিল না। তার পরও আওয়ামী লীগ পারেনি। সারাটি দিন ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর লাশ পড়ে থাকল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। সারা দেশের নবনিযুক্ত গভর্নররা ঢাকায় ছিলেন প্রশিক্ষণের জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ তৈরি ছিল জাতির পিতাকে বরণ করতে। প্রতিবাদী মিছিল নিয়ে কেউ সামনে আসেনি। নেতারা ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের রক্ষায়। কর্মীরা হতভম্ব! এমন আরও অনেক ব্যর্থতা আছে। তার পরও আওয়ামী লীগ ইতিহাস-ঐতিহ্য, বাঙালি সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে এগিয়ে চলেছে।

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির নাম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা। দলটি সবচেয়ে বেশি সময় নেতৃত্ব দেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন তিনি। ১৯৮১ সালে দায়িত্ব নিয়েছেন। নানা পথপরিক্রমায় ষড়যন্ত্র, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা আজকের বর্ণাঢ্য অবস্থান তৈরি করেছেন। একটি সময় আওয়ামী লীগ ছিল সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দল। অবহেলিত মানুষই আওয়ামী লীগ করতেন। ত্যাগীরা নিজের অর্থবিত্ত নষ্ট করতেন দলের জন্য। কারাগার হতো অনেকের ঘরবাড়ি। এখন সময়ের সঙ্গে সবকিছু বদল হয়েছে। এখন বিত্তশালীরা দলে সম্পৃক্ত হয়েছেন। অনেক সুবিধাবাদী আওয়ামী লীগ করে অর্থবিত্ত গড়েছেন। ত্যাগীদের আক্ষেপ আছে, কষ্ট আছে। হাইব্রিডদের আকাশছোঁয়া বিকাশ আছে। সব সিদ্ধান্ত সব সময় ভালো হচ্ছে বলা যাবে না। তার পরও মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে দলটির বিকল্পও এখনো গড়ে ওঠেনি।

ইতিহাসের কঠিন বাঁকে বর্ণাঢ্য ঐতিহ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশরা বিদায়ের আগে পাকিস্তান ও ভারত নামে ধর্মের ভিত্তিতে দুটি আলাদা রাষ্ট্র তৈরি করে দিয়ে যায়। ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের মিল না থাকলেও পূর্ব ও পশ্চিম আলাদা জাতিসত্তা নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে। অধিকার দেওয়ার প্রশ্নে তৈরি করে বৈষম্য। পাকিস্তানিদের এ আচরণের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে সুবিধাভোগীদের নেতৃত্ব দেন মাওলানা আকরম খাঁ, খাজা নাজিমউদ্দিনসহ অনেক প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতা। শুরু হয় বিভক্তির রাজনীতি। কঠিন বাস্তবতায় পাল্টা অবস্থান নেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমসহ প্রগতিশীল চিন্তার নেতারা। শেখ মুজিবুর রহমান প্রগতিশীল ধারার সঙ্গে যুক্ত হন। সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমের সঙ্গে শেখ মুজিব দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করে প্রগতিশীল ধারার নেতাদের নিয়ে নতুন কিছু করার চিন্তা করেন। শুরু হয় নতুন প্ল্যাটফরমের প্রক্রিয়া। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আসাম থেকে এসে যুক্ত হন এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে। সবাই বুঝতে পারেন মুসলিম লীগ ভুল পথে চলছে। পাল্টা অবস্থান নিতে হবে জরুরিভাবে।

পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বপ্ন প্রথমেই শেষ হয়ে যায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা নিয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতিবাচক অবস্থানে। তাঁর সামনে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি ও প্রতিবাদী অবস্থান এবং পাকিস্তানিদের বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে প্রথম যাঁরা আটক হন তাঁদের একজন শেখ মুজিবুর রহমান। কারাগারে গিয়েও তিনি থামেননি। একদিকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জনমত গঠন শুরু করেন, অন্যদিকে একটি রাজনৈতিক দল গঠনে কাজ করেন। দল গঠনের লক্ষ্যে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, ইয়ার মোহাম্মদ খানকে সাধারণ সম্পাদক করে একটি সভা আহ্বান করা হয়। মুজিব তখন কারাগারে। সম্মেলন সফলের প্রস্তুতি নেন প্রগতিশীল চিন্তার রাজনীতিবিদরা।

নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে রোজ গার্ডেনকে বেছে নেওয়া হয়েছিল সম্মেলনের স্থান হিসেবে। কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেন এখনো ইতিহাসের অমরত্বের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। সম্মেলন আয়োজনে পুরান ঢাকার শওকত আলীর একটা ভূমিকা ছিল। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে এ শওকত আলীর কথা বারবার উঠে এসেছে। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরে নাম পরিবর্তন করা হয়। মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে করা হয় আওয়ামী লীগ। রোজ গার্ডেনের মালিক ছিলেন কাজী হুমায়ূন রশীদ। তিনি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে। সাধারণ সম্পাদক হন টাঙ্গাইলের শামসুল হক। অবিভক্ত পাকিস্তানের আলাদা কমিটি হয়। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ঢাকার সম্মেলনে নেতৃত্বে আরও ছিলেন আতাউর রহমান খান, আলী আমজাদ খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আবদুস সালাম। তাঁদের পদবি সহসভাপতি। কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন ইয়ার মোহাম্মদ খান। বঙ্গবন্ধু তখন কারান্তরিন ছিলেন। কমিটি গঠন নিয়ে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগ ছিল। কারাগারে ছিলেন বলেই সাধারণ সম্পাদক হননি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্মসম্পাদকের দায়িত্ব পান। ৪০ সদস্যের কমিটিতে নিয়ে আসা হয় সারা দেশের অনেক নেতাকে। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক তখন রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি সম্মেলনে কিছুক্ষণের জন্য গিয়েছিলেন। রাষ্ট্রের পদে থাকার কারণে দলে থাকতে অপারগতা ব্যক্ত করেন। শেরেবাংলার মতো ঢাকার অনেক নেতা শেষ পর্যন্ত থাকেননি কমিটিতে বিভিন্ন অজুহাতে।

সম্মেলনে মুসলিম লীগের পান্ডাদের হামলার পরিকল্পনা ছিল। পুরান ঢাকায় শওকত আলীর শক্ত অবস্থান ও রোজ গার্ডেনে সম্মেলন অনুষ্ঠানের কারণে কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই সম্মেলন শেষ হয়। শওকত আলী মুসলিম লীগ করতেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে তিনি আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক সহায়তা করেন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতি ত্যাগ করেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের কমিটি গঠনের পরদিন ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে জনসভার আয়োজন করা হয়। মুসলিম লীগের পান্ডারা এ সমাবেশে বাধা দেয়। হামলা করে। পুরান ঢাকার আরেকটি গ্রুপ আওয়ামী লীগের পক্ষে পাল্টা অবস্থান নেয়। শুরুতে অনেক প্রতিকূলতা থাকলেও আওয়ামী মুসলিম লীগের কর্মযাত্রা থামেনি। শেখ মুজিবুর রহমান কারামুক্ত হওয়ার পর নতুনভাবে দল সাহসী অনেক সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে। রাজপথের সিদ্ধান্তগুলো ইতিবাচকভাবে আসতে থাকে। নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগে পরিবর্তনের ধারা তৈরি হয়। ১৯৫২ সালে শামসুল হক অসুস্থ হওয়ার কারণে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন শেখ মুজিবুর রহমান। দায়িত্ব নিয়েই তিনি সারা দেশে কাজ শুরু করেন। নতুন নেতৃত্ব ও তারুণ্যকে জাগিয়ে তোলেন। পরের বছর পুরান ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সারা দেশ থেকে আগত কাউন্সিলর ডেলিগেটদের মতামতের ভিত্তিতে মুজিব দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মূলত তখন থেকেই বদলে যেতে থাকে পাকিস্তানের নতুন দলটি। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে থাকে। ইতিহাসের ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতরে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। একদিকে সাংগঠনিক কাজ, অন্যদিকে পাকিস্তানিদের চক্ষুশূল হয়ে এ সময়ে তিনি বারবার কারাগারে যান। মূলত বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠায় কারাগার হয়ে ওঠে তাঁর ঠিকানা।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি সামনে রেখে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সঙ্গে কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল, পাকিস্তান খেলাফত পার্টির একটা ঐক্য হয়। সারা দেশে তৈরি হয় জাগরণ। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে তারুণ্য-উদ্দীপ্ত অবস্থানে সমন্বয় রেখে কাজ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁদের সঙ্গে সারা দেশ চষে বেড়ান মুজিব। ভোটারদের কাছে তুলে ধরেন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আসল চরিত্র। নির্বাচনে বিজয় আসে। যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠন হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নামের সঙ্গে লেপ্টে থাকা মুসলিম শব্দটি পরিবর্তন করা হয়। নতুন নামকরণ ইতিবাচক অবস্থান তৈরি করে পূর্ব পাকিস্তানে। ছাত্র-জনতার কাছে আওয়ামী লীগ গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। মুজিব হয়ে ওঠেন তারুণ্যের নেতা। মুজিবকে ঘিরে ধরে সারা দেশের বিশাল নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তার আগেই আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে আওয়ামী লীগের ভিতরে বিরোধ তৈরি হয়।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ দলটি কয়েক দফা ভাঙনের শিকার হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রথম ভাঙন ১৯৫৭ সালে। কাগমারী সম্মেলনে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল নিয়ে মওলানা ভাসানীর প্রস্তাব ভোটে পাস হয়নি। বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি মওলানা ভাসানী। তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেন। মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। অন্যদিকে মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশকে সভাপতি, শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কমিটি গঠন হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে এ কমিটি আবারও পুনর্নির্বাচিত হয়। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উপস্থাপনের পর দলের সভাপতির দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান তাজউদ্দীন আহমদ। এ নেতৃত্ব দেশকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নেয়। ছয় দফা হয়ে ওঠে বাঙালির মুক্তিসনদ। ছাত্রলীগ ছয় দফার প্রচারে নামে সারা দেশে। মুজিবের নির্দেশে ছাত্রলীগ বাঙালির জাগরণ সৃষ্টিতে অপরিসীম ভূমিকা রাখে। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকলে ছাত্রলীগ নেতারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যোগাযোগ রাখতেন বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সঙ্গে। কারাগার থেকে আসা নির্দেশগুলো তিনি ছাত্রলীগকে জানাতেন। ছাত্রলীগ সেসব নির্দেশ বাস্তবায়ন করত।

আওয়ামী লীগের ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা আরেকটি অধ্যায়। মূলত এ মামলাটি পাকিস্তানিরা করেছিল বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝোলাতে। মামলার অভিযোগ, শেখ মুজিব বাংলাদেশ স্বাধীন করতে চান। এ নিয়ে বৈঠক করেছেন আগরতলায়। এ মামলার বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ রুখে দাঁড়ায়। ছাত্র-জনতার তীব্র প্রতিরোধে গণ অভ্যুত্থানের মুখে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাসকরা। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুজিব কারামুক্ত হন। ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তখনকার রেসকোর্সে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়। তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির একক নেতা। সারা দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা স্থাপন করে। ’৭০ সালের নির্বাচন ছিল আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ম্যান্ডেট। তিনি বাঙালির এ আস্থাকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। ভোটে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বঙ্গবন্ধুর অবস্থান চলে আসে নতুন উচ্চতায়। অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ে বলিষ্ঠতা দেখিয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নেতা। ক্ষমতা নয়, তিনি হন জনতার নেতা। পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনকালে আওয়ামী মুসলিম লীগ পূর্ববঙ্গ প্রদেশে দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ছিল ১৩ মাসের কোয়ালিশন সরকারে। বাকি সময়টা আওয়ামী লীগ লড়াই করেই কাটিয়ে দেয়।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস ছিল পূর্ব বাংলা উত্তাল। ছাত্র-জনতা নেমে আসে রাজপথে। সারা দেশে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। জনগণের সঙ্গে বাঙালি সরকারি কর্মকর্তা, সেনা, ইপিআর, পুলিশের প্রায় সবাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা স্থাপন ও একাত্মতা প্রকাশ করে। যুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলে দেশ। এ পরিস্থিতিতে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন। তিনি যার কাছে যা আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। তাঁর হুকুমের অপেক্ষা না করার জন্যও বলেন। তিনি পাকিস্তানিদের খাজনা, ট্যাক্সসহ সব ধরনের সহায়তা বন্ধের আহ্বান রাখেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের পর পূর্ব পাকিস্তানের বেতার-টেলিভিশনসহ সব সরকারি অফিস-আদালত বাঙালির নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। পরিস্থিতি সামলাতে পাকিস্তানি সেনারা জড়ো হতে থাকে। ২৫ মার্চের কালরাতে তারা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকে আটক করে প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে, পরে নিয়ে যায় পাকিস্তানে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আওয়ামী লীগ প্রবাসী সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এ সরকারের অধীনে জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে প্রধান করে মুক্তিযুদ্ধকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। প্রতি সেক্টরে কমান্ডার নিয়োগ দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের নেত্বত্বে সফলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি দেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব নেন। একটি জাতিকে মুক্ত করে তিনি অর্জন করেন জাতির পিতার স্থান।

স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নতুন যাত্রা শুরু হয়। নেতৃত্বে থাকেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৪ সালের সম্মেলনে কামারুজ্জামান ও জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে দলের নতুন কমিটি গঠিত হয়। জিল্লুর রহমান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও কয়েক বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার পর আওয়ামী লীগের রাজনীতি ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়ে। আবদুল মালেক উকিল, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদসহ প্রবীণ-নবীনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংগঠিত হতে থাকে। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন আবদুল মালেক উকিল ও আবদুর রাজ্জাক। মিজানুর রহমান চৌধুরী দলের সভাপতির পদ না পেয়ে ভিন্নমত পোষণ করে আরেকটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৯ সালে ভোটে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসন লাভ করে। পরিস্থিতি বদলে যায় ১৭ মে, ১৯৮১ সালে দলের সম্মেলনে। দুঃসময় কাটাতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন সারা দেশ থেকে আসা কাউন্সিলর, ডেলিগেটরা। সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে সভাপতি আবদুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক ও তোফায়েল আহমেদকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। ১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগ ছেড়ে বাকশাল গঠন করেন। দলের যুগ্মসম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, জিল্লুর রহমান, আবদুল জলিল, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও ওবায়দুল কাদের। ওবায়দুল কাদের টানা তিনবারের সাধারণ সম্পাদক।

দীর্ঘ ইতিহাসে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ মাত্র সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় ছিল। নানামুখী ষড়যন্ত্রে ১৫ আগস্ট বাঙালির সব স্বপ্ন বিলীন হয়। দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৯৮৬ সালের ভোটে ৭৬টি আসন নিয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে প্রথম বিরোধী দলের নেতা হন। ১৯৯১ সালে ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে ক্ষমতায় না এলেও বিরোধী দলের নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা সারা দেশ চষে বেড়িয়ে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করেন। ১৯৯৬ সালের নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালের ষড়যন্ত্রের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। শেখ হাসিনা আবার লড়াই শুরু করেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। এরপর টানা আরও তিনটি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ এখনো ক্ষমতায়। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দলকে বিশ্বে নতুন মর্যাদা দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ইতিহাসে দলটিকে অনেকবার ভাঙন ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়েছে। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাকশাল গঠন করেন। তখনই চক্রান্তের ডালপালা বৃদ্ধি পায় বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে। অবশ্য ষড়যন্ত্রের আরেক অংশে ছিল স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ থেকে ছাত্রলীগের একটি বড় অংশ বেরিয়ে গিয়ে জাসদ গঠন। এরপর ১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাক, মহিউদ্দিন আহমদের বাকশাল গঠন ছিল আড়ালে লুকিয়ে থাকা চক্রের আরেক চক্রান্ত। বঙ্গবন্ধুর পর শেখ হাসিনাকে হত্যার অনেক চক্রান্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যার ওপর ২১ বার হামলা চালানো হয়। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা হয়েছিল সরাসরি তখনকার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। জড়িত ছিলেন রাষ্ট্রের দুটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতনরা। দেশবিদেশের নানামুখী চক্রান্ত মোকাবিলা করেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী টিকে আছেন। দলকে এগিয়ে নিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের ৭৫ বছর উদ্যাপন করছেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের বাংলাদেশ দিয়েছেন। তাঁর মেয়ে আওয়ামী লীগের সফল নেতৃত্ব ধরে রেখে বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ করছেন। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বাংলাদেশ আজ তাঁর নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে। আশা করছি আরও এগিয়ে যাবে অনেক দূর।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর