রবিবার, ২৩ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

পশ্চিমবঙ্গ : বাঙালরা ঘটিদের চেয়ে এগিয়ে

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

পশ্চিমবঙ্গ : বাঙালরা ঘটিদের চেয়ে এগিয়ে

দেশভাগের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি, প্রশাসন, খেলাধুলা- প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাঙালদের আধিপত্যই বেশি ছিল। ভারতের স্বাধীনতার এত বছর পরও প্রবণতাটা এখনো একই রকম। ম্যান অব দ্য সয়েলের এ ক্রমে পিছিয়ে পড়ার পেছনে ছিল শিক্ষার প্রতি তাদের অসীম অনীহা এবং প্রবাদপ্রতিম কুঁড়েমি, আলস্য। তার জ্বালা ঘটিরা মেটাত বাঙালদের অকথ্য গালিগালাজ করে। রাজনীতির মতো স্পর্শকাতর ক্ষেত্রেও দুজন ঘটি মুখ্যমন্ত্রী বারবার রাজ্যকে বিড়ম্বনায় ফেলেছেন।

তার সবচেয়ে কদর্য রূপ ফুটে উঠেছে মমতা ব্যানার্জির আমলে। পশ্চিম বাংলার সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। প্রায় ৮০ শতাংশ খবরই মমতা ব্যানার্জি ও তাঁর বৃহত্তর পরিবারের সীমাহীন দুর্নীতি নিয়ে। দোষে-গুণেই মানুষ। ঘটি ও বাঙালদের মধ্যে ভালো মানুষও আছেন। এখন স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরও ঘটিদের মধ্যে এমন একটা মনোভাব আছে-তারা কোনো না কোনো কারণে বাঙালদের চোখের বিষ মনে করে। বাঙালরা যে স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে এটা ঘটিরা মেনে নিতে পারে না। কেন পারে না বা কোনো দিনও পারবে কি না তা নিয়ে চলে নানান জল্পনা। এ ঘৃণ্য মনোভাবের আদৌ শেষ হবে কি না সে ব্যাপারে নানা মহলে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

এবার একটু ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তরবঙ্গের দিকে তাকানো যাক। উত্তরবঙ্গে যে দুটি জেলা আছে তারা রাঢ় বাংলা বলে পরিচিত। বাঙালরা সেখানেও গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। রাঢ় বাংলায় মালদা থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত বহুবার ঘুরেছি। মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। দলিত, আদিবাসী, মতুয়া বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সখ্য আছে। উত্তরবঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমে ক্রমেই বিস্তার লাভ করছে। এজন্য রাইটার্স বিল্ডিং বা নবান্নের দরকার হয়নি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে রাজশাহী যেমন ব্রিটিশ আমল থেকেই শিক্ষা উন্নততর অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে। তা শেখ হাসিনা সরকার দ্রুতবেগে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পাবনা, বগুড়ায়ও খুব পিছিয়ে নেই। গোটা বাংলাদেশের এখন সমস্যা হয়েছে উত্তর বিহার থেকে যে হাজার হাজার সংখ্যালঘু বাংলাদেশে গিয়েছে। তারাই একটা না একটা ঝামেলা পাকিয়ে যাচ্ছে। তারা এখনো মনে করে জিন্নাহ সাহেবই তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্ব চালু করে নানা রকম বিভেদ ও বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে গেছেন। বাংলাদেশ জন্মানোর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা ভেঙে চুরমার করে দিয়ে গেছেন। তাই ওরা এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গের সম্প্রদায় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন-বিচ্ছেদ সবই চলে টাকার জোরে। সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে মমতা জমানায় দুর্নীতি এবং শিক্ষার অধঃপতন হাত ধরে টেনে আনা হয়েছে। ঘটিদের চাকরির কোনো অভাব হতো না। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়লেই অনায়াসে রেল, স্টিমার এবং ব্রিটিশদের তৈরি পাটকল থেকে কয়লাখনিতে চাকরি হয়ে যেত। কলকাতা শহরে তো এখনো অফিসে/কর্মস্থলে হামেশাই ঘটি ও বাঙালের বিভেদ প্রকাশ্যে এসে যায়। এসব ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে চলেছে ১১ বছর ধরে। এ ১১ বছরই হলো মমতার শাসনকাল। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দেখতে পাচ্ছে শুধু শিক্ষা নয়, শিল্প উঠে গিয়ে জেলায় জেলায় অস্ত্রকারখানা হচ্ছে। বোমা এবং সন্ত্রাসবাদী কাণ্ডকারখানা বাড়ছে। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বাঙালরা যেন সেকেন্ড গ্রেড সিটিজেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ঘটিরা কোন গ্রেড সিটিজেন তা তারা নিজেরাই পরিষ্কার করে বলতে পারে না। এমনকি বিভিন্ন ক্লাবের মধ্যে এখনো বাঙাল-ঘটির বিভাজন রয়েই গেছে। এটা যে সমাজের পক্ষে কত ক্ষতিকর তা কেউ বুঝতে চাইছে না। তারা বুঝতে চাইছে না যে আমরা বাঙালি। তাই এখনো অনেকেই মনে করেন, বিধান চন্দ্র রায়, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে জাতপাত-গোষ্ঠীকে কোনো আমলই দেননি। তাঁরা কঠোর হাতে সমাজের সমস্ত রকম অপকর্ম দমন করেছেন। এঁদের আমলে শিক্ষারও অনেকটা উন্নতি হয়েছিল। দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন ভারতে শিক্ষার হার ছিল ১৮ শতাংশ মাত্র। সেখান থেকে গত ছয় দশকে এ বাঙাল নেতারাই বাঙালিদের টেনে তুলে নিয়ে গেছেন।

কিন্তু মমতা ব্যানার্জি সরকার আসার পর শিক্ষার যে এ অবস্থা হবে, তা বাঙাল বা ঘটি কেউই বুঝতে পারেনি। নগদ টাকার বিনিময়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক/উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষকদের নিয়োগ করা হয়েছে। প্রায় দেড় হাজার কোটি ভারতীয় রুপির হাতবদলে শিক্ষাঙ্গন ভরে গেছে অযোগ্য শিক্ষক দিয়ে। এ হঠকারিতার ফলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যে কোন রসাতলে যেতে পারে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত না হয়ে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়েছে সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের চাকরি। বহু টালবাহানার পর সবশেষে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে বিচারব্যবস্থাকে। গ্রেফতার করা হয়েছে খোদ শিক্ষামন্ত্রীসহ একাধিক বিধায়ক এবং শিক্ষা কর্মকর্তাকে। এ প্রক্রিয়ার শেষ কোথায় এখনো বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, পরবর্তী প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের সামনে অদ্ভুত আঁধার নেমে আসছে। তাদের মধ্যে বাঙাল-ঘটি দুই-ই রয়েছে।

লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর