সোমবার, ২৪ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

বৃক্ষরোপণ : সবুজ হয়ে উঠুক দেশ

অধ্যাপক মেজবাহ্ উদ্দিন সরকার

বৃক্ষরোপণ : সবুজ হয়ে উঠুক দেশ

ঈদের লম্বা বন্ধে অনেকেই শহর থেকে গ্রামে গিয়েছিলেন ঈদ উদযাপন করতে। নাড়ির টানে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ করার এই রেওয়াজ বাংলাদেশের এক ঐতিহ্য। আনন্দের এই ভাগাভাগি ছড়িয়ে পড়ে নিজ পরিবার-পরিজনের বাইরে প্রতিবেশী ও বাল্যবন্ধুদের সঙ্গেও। কোরবানির মাংস ভাগাভাগি শেষে বিভিন্ন গ্রামীণ খেলাধুলা যেমন হা-ডু-ডু, ফুটবল, ক্রিকেট, নৌকাবাইচ, মোরগ ও ষাঁড়ের লড়াই ইত্যাদি চলে পাড়া মহল্লায়-এসব খেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামের ছোট-বড় সবাই একত্রিত হয়, আবার অনেক সময় খেলাকে কেন্দ্র করে হাতাহাতি, সংঘর্ষও হয়। ফলে আনন্দের পরিবর্তে বিষাদ নেমে আসে, হয় মামলা-মোকদ্দমাও। যদিও সভ্যতার বিকাশের ফলে এগুলোর অনেক হারিয়ে গেছে আমাদের ইতিহাস থেকে। অবশ্য চ্যানেল আইয়ে শাইখ সিরাজের আয়োজনে এ ধরনের কিছু খেলাধুলা ‘কৃষকের ঈদ উদযাপন’ অনুষ্ঠানে দেখানো হয়। যা হোক, অনেকেই এই ছুটির সঙ্গে আরও কিছুদিন ছুটি বাড়িয়ে গ্রামে যায় জমিজমা, ঘর-দুয়ার ঠিক করার জন্য। এখানেও সীমানা নিয়ে হয় ধাক্কাধাক্কি, মারামারি। আপন ভাইবোনের মধ্যে হয় রেষারেষি, হাসাহাসি করে প্রতিবেশী। স্থায়ী গ্রামবাসীরা শহর থেকে যাওয়া আপনজনকে কেন্দ্র করে ছেলেমেয়েদের বিবাহের আয়োজন করে থাকে। ধুমধাম করে বিবাহ হয়, থাকে বর-যাত্রীর আসা-যাওয়া। যদিও থাকে না গ্রামের মহিলাদের সমবেত কণ্ঠে হলুদ বাটা, মেহেদি বাটার সেই গান, পালকিওয়ালার ঝুম-ঝুম কোরাস, ঐতিহ্যবাহী পিঠা-পায়েস। তবুও এই আয়োজন ঈদের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে তোলে কোনো সন্দেহ নেই। বর্ষার বৃষ্টির তালে তালে পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসে গরুর মাংস ও খিচুড়ি খাওয়ার স্বাদ যেন এক অমৃত। আমাদের গ্রামসহ অনেক গ্রামে এখনো কোরবানির মাংসের একাংশ (তিন ভাগের এক ভাগ) একত্র করে সমস্ত গ্রামবাসীর (যারা কোরবানি দেয় না) মধ্যে সমহারে বণ্টনের রেওয়াজ আছে। বিকালের পর থেকে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাংস আসতে শুরু করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে। বিশাল মাংসের স্তূপে বসে গ্রামবাসী নামের তালিকা অনুযায়ী ভাগ করতে থাকে। সে এক অপরূপ দৃশ্য, যেন ঈদের আনন্দকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যদিও শহরে এই চর্চাটি একটু অন্যরকম। এখানে এলাকা থেকে গরিব মুসলিমরা ব্যাগ নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে এসে ওই মাংস সংগ্রহ করে। দেখা যাচ্ছে একই ঘরের বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে ব্যাগ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে, কার আগে কে কত মাংস সংগ্রহ করবে। ফলে মাংসের এই বণ্টন সঠিকভাবে হচ্ছে না শহরে। যারা বেশি দৌড়াতে পারে তারা বেশি সংগ্রহ করতে পারে। এখানে অসুস্থ কিংবা অক্ষম গরিব ব্যক্তিটি কোনো মাংসই সংগ্রহ করতে পারে না। আবার অনেকে আছে কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য রাখে না, আবার এভাবে মাংস সংগ্রহ করতেও সংকোচ বোধ করে। আত্মীয়স্বজন থেকে মাংস পেলে তারা খায় অন্যথায়, মুখ বন্ধ। তবে বিকাল তিন-চারটার পর সংগ্রহকৃত মাংস রাস্তার মাথায় বিক্রি করতে দেখা যায়। ফ্রেশ মাংস, মূল্যও একটু কম, তাই অনেকে ডানে-বামে না তাকিয়ে কিনে নিয়ে যান। শহরের কোরবানি ঈদে গত কয়েক বছর যাবৎ এটি একটি নতুন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। বিত্তশালী শহরবাসী অনেকেই অনলাইনে গরু কেনার সংস্কৃতিতে ধাবিত হচ্ছে। গরু কাটাকাটিতেও নিয়োগ করা হয় পেশাদার কসাই, যা গ্রামের সংস্কৃতির সঙ্গে পুরো বিপরীত।

এ সময়টাতে শহরে চোরের উপদ্রব বেড়ে যায়। এজন্য গ্রামে যাওয়ার সময় ঘরের দরজা জানালা সঠিকভাবে তালাবদ্ধ করে যাওয়া উচিত। বাড়িতে সিসি ক্যামেরার সংযোগ থাকলে দূর থেকেও সবকিছু অবলোকন করা যায়। এ ছাড়াও গ্রামে যাওয়ার সময় গ্যাসের চুলা, পানির ট্যাব, টিভি, এসির কানেকশন সঠিকভাবে বন্ধ না করে গেলে আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনা হতে পারে বারান্দায় রাখা ফুলের টব, এসির পানির কানেকশন লাইন এবং পানি জমে থাকতে পারে এমন পাত্রগুলো পরিষ্কার করে উপুড় করে রেখে গেলে এডিস মশার উপক্রম থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সমগ্র বাংলাদেশের রাসেল ভাইপারের উপদ্রব দেখা দিয়েছে। ঈদে অনেকদিন পর বাড়িতে এসে নিজ বাড়ির ঝোপঝাড়, গাছের ডালপালা পরিষ্কার করেছেন অনেকে।

উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় গ্রামগুলোও এখন শহরে পরিণত হতে যাচ্ছে। তাই সর্বত্র গাছ কাটার হিড়িক দেখা যায়। প্রচন্ড তাপমাত্রা ও কার্বন নিঃসরণের জন্য সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম হচ্ছে গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। কিন্তু শহরে গাছ লাগানোর পরিবর্তে গাছ কাটার প্রতিযোগিতা চলে আবাসনের জন্য। ফলে তাপমাত্রা এক অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে, যা মানুষের জীবনযাত্রাকে মারাত্মক ব্যাহত করছে। শহরের গ্লাস করা এসি রুমে বসে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য যতই সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করা হোক না কেন, তাতে তাপমাত্রা মোটেও কমবে না। একমাত্র উপায় হচ্ছে গাছকে রক্ষা করা, আরও বেশি করে গাছ লাগানো এবং এটিকে দেশব্যাপী একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করা। গ্রামের মানুষ আগে গাছের ছায়ায় বসে পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি ইত্যাদি গান শোনাতেন। ক্লান্ত পথিক গাছের ছায়ার নিচে ঘুমিয়ে পড়তেন। আজকাল তেমনটি আর দেখা যায় না। ঈদের এই লম্বা ছুটিতে গ্রামে গিয়ে অনেকে গাছ লাগিয়েছেন। আগামী কয়েক বছর এই অভ্যাসটি অব্যাহত রাখলে বাংলাদেশ একসময় সুইজারল্যান্ডের চেয়েও প্রাকৃতিক ভূসর্গে পরিণত হবে। বাংলাদেশ পরিণত হবে স্বচ্ছ, সবুজ ও শ্যামল বাংলায়। অনেকে বর্ষা মৌসুমে নিজেদের জমিতে যাতে গাছ লাগানো হয়, সেজন্য স্বজনদের উদ্বুদ্ধ করেছেন।

লেখক : অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর