পবিত্র ঈদুল আজহার এক লম্বা ছুটি। অনেক দিন এমন লম্বা ছুটি বিশেষ করে পত্রিকা অফিসে খুব একটা দেখা যায় না। কেন জানি না, একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে সকালে ঘুম থেকে উঠে দু-এক বেলা নাশতা পানি না হলেও অস্বস্তি লাগে না। কিন্তু সকালে খবরের কাগজ না পেলে সারা দিনটাই কেমন যেন খালি খালি লাগে। আমার স্ত্রী নাসরীনের আগে তেমন পড়ার অভ্যাস ছিল না। কিন্তু ইদানীং সে মোটামুটি পত্র-পত্রিকা পড়ে। তার সব থেকে প্রিয় পত্রিকা মানবজমিন। বেশ কটি পত্রিকার মধ্যে সে সবার আগে মানবজমিন খুলে ধরে। সেজন্য আমিও পত্রিকা হাতে এলেই মানবজমিন তার দিকে এগিয়ে দেই। আমি সব পত্রিকাই পছন্দ করি, পড়তে চেষ্টা করি। কিন্তু আমার স্ত্রী প্রিয় মতিউর রহমানের মানবজমিন দিয়ে শুরু করে।
পবিত্র ঈদুল আজহা নিরাপদে কেটেছে নির্ঝঞ্ঝাটে কেটেছে এটা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব না। একদিকে সিলেট-লালমনিরহাট-গাইবান্ধা-কুড়িগ্রাম বন্যায় প্লাবিত। মানুষের দাঁড়াবার জায়গা নেই, খাবার নেই, গবাদি পশু এবং নিজেদের থাকার জায়গা নেই। সে যে কী দুর্বিষহ যন্ত্রণা যারা নিজেরা ভোগ না করেছে তাদের উপলব্ধিতেও আসবে না, আসা সম্ভব না। স্বাধীনতার পরপর সিলেট প্লাবিত হয়েছিল। ৮০-৯০ জন সহকর্মী নিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। প্রায় এক মাস ছিলাম সেখানে। তখন বয়স ছিল ২৬, এখন ৭৮-৭৯। এখন আর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি না। কিন্তু বুকের মধ্যে তোলপাড় করে। টিভির পর্দায় মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে বুক ফেটে যেতে চায়। আল্লাহ যে কেন এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছেন, নাকি মানুষের কষ্ট দেখতে সাক্ষী রাখতে চান। অন্যদিকে রাস্তাঘাটে প্রতিদিন দুর্ঘটনা আমাদের একেবারে উতালা করে রাখে। ভারতের এক রেল দুর্ঘটনায় প্রবীণ নেতা লাল বাহাদুর শাস্ত্রী দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে মন্ত্রিত্ব পদত্যাগ করেছিলেন। আমাদের কত দুর্ঘটনা ঘটে সড়ক-রেল-নৌপথে দুর্ঘটনার শেষ নেই। প্রিয় সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে খুবই ভালোবাসতাম, স্নেহ করতাম, একজন বিবেকবান মানুষ হিসেবে মনে করতাম। কিন্তু কেন যেন সে মতে আর অটল থাকতে পারছি না। ভদ্রলোক এখন দল, রাষ্ট্র ও সরকারের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রতিটি রাজনৈতিক কথার তিনি রাজনৈতিক জবাব দেবেন এটাই স্বাভাবিক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার জবাবে রাজনৈতিক জোড়াতালিও থাকবে। কিন্তু কূটনীতির ক্ষেত্রে যুক্তিহীন কোনো জোড়াতালির মানে বা অর্থ হয় না। মিয়ানমার নিয়ে, আমাদের জলসীমা নিয়ে, সেন্টমার্টিন নিয়ে ইদানীংকালে তার কথাবার্তা খুব একটা যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। অন্যদিকে সেনাপ্রধান তার অবসরের সময় মিয়ানমার নিয়ে যে কথা বলেছেন একমত হতে পারছি না। আমরা যুদ্ধ চাই না, কিন্তু যুদ্ধ আমাদের ঘাড়ে চেপে পড়লে নিশ্চয়ই লেজ গুটিয়ে পালাব না। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে ভাইয়ের মতো মনে করি। কিন্তু তারও ইদানীংকালের কথাবার্তা কেন যেন মন্ত্রীর মতো মনে হচ্ছে না। আবার কোনো কোনো নেতা বলছেন, মিয়ানমারের উসকানির ফাঁদে আমরা পা দেব না। কে কাকে ফাঁদে পা দিতে বলছে? দেশের মানুষ চায় দেশের সার্বভৌমত্ব, দেশের অখন্ডতা দেশের মান-মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকুক। কোনো নারীকে অপমান করা, জোর-জবরদস্তি করে তার সম্মান নষ্ট করা সেটা নানাভাবে হতে পারে। কিন্তু আমার বিবেচনায় একজন নারী একজন মেয়ে একজন মায়ের শাড়ির আঁচল বা ওড়না তার অনুমতি ছাড়া স্পর্শ করাও শ্লীলতাহানির শামিল, নারী নির্যাতন। এক সপ্তাহ- দশ দিন যে দেশের মানুষ সেন্টমার্টিনে নিরাপদে যেতে পারল না, মিয়ানমারের বাধার মুখে সবকিছু বন্ধ রইল এতে আমাদের সার্বভৌমত্বের হানি হয়নি? এতে আমাদের মর্যাদাহানি ঘটেনি? তাদের তিনটা জাহাজের বদলে আমরা নৌবাহিনীর ত্রিশটি জাহাজ কেন মোতায়েন করলাম না? যুদ্ধ করার জন্যই কি সব সময় সৈন্য সমাবেশ করতে হয়? দেশবাসী তেমন মনে করে না। নিজের মর্যাদা নিজের সামর্থ্য প্রমাণের জন্যও অনেক সময় শত্রুর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে হয়। কোথায় আমরা তেমন করে দাঁড়াতে পারলাম? সমুদ্রসীমা থেকে মিয়ানমার জাহাজ চলে গেলে আমরা নৌবাহিনীর জাহাজ মোতায়েন করলাম এটা একেবারেই কি হাস্যস্পদ নয়? একসময় আমরা ধর্তব্যের মধ্যে ছিলাম, এখন সব বড় বড় নেতা। আমাদের বোধ বিবেচনা মান-সম্মান রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের চিন্তা হয়তো তাদের কাছে কিছুই মনে হয় না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কন্যা জাতির নেতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন শেখ হাসিনা তো অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ কিনতে কম কেনেননি, তারপরও কেন এমন দৈন্যতা নিশ্চয়ই ভেবে দেখার সময় এসেছে। আমরা কখনো মিয়ানমার প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করিনি, করতে পারিনি। যদি তা পারতাম তাহলে সরকার যেমন সফল হতো তেমনি বোনের নেতৃত্বও জাতীয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো বিকশিত হয়ে তার সৌরব চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত। যে যত লাফালাফি করুন ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমরা যে জাতীয় ও মানবিক চেতনায় আকাশছোঁয়া শক্তি, সামর্থ্য ও মর্যাদা অর্জন করেছিলাম তার ছিটেফোঁটাও এখন অবশিষ্ট নেই। মানবিক গুণাগুণে আমরা একেবারে তলানিতে। আত্মমর্যাদাবোধে আমাদের চাইতে নিম্নসীমায় আর কেউ আছে বলে মনে হয় না। আমরা ইদানীং এত সহজে নতজানু হতে পারি, যা যৌবনে কল্পনাতেও ছিল না। এই অধোগতির হাত থেকে মুক্তি অর্জনে অথবা অধোগতি থেকে ন্যায় সত্য ভালোবাসায় কীভাবে অগ্রসর হব সবাই মিলে সেটাই ভেবে দেখা দরকার। আরও কিছু সময় এমন উদাসীনভাবে চললে বিপদ অনিবার্য। তাই একজন প্রবীণ মানুষ হিসেবে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বর্তমান সমাজপতিদের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ, একবার চোখ বন্ধ করে বিবেকের নির্দেশে চলবার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন, হিংস্র সিংহের সামনে দাঁড়ানো যত সহজ নিজের বিবেকের সামনে দাঁড়ানো অতটা সহজ নয়। নিজের বিবেক, নিজের আত্মার সামনে দাঁড়াতে পারা সব মানুষের ভাগ্যে জোটে না। অনেকে তো বিবেক কাকে বলে আত্মা কাকে বলে স্রষ্টার প্রতিভু কাকে বলে সেটাও হয়তো সারা জীবনে উপলব্ধি করে না বা করতে পারে না। বিবেকের নির্দেশ মানা, বিবেক দ্বারা পরিচালিত হওয়া খুব একটা সহজ নয়। যেমন সবাই বলে দেশপ্রেমিক। দেশপ্রেমও বাজার থেকে কিনে আনার মতো জিনিস নয়। সারা জীবনে অনেকের মধ্যে দেশপ্রেম জাগে না। কারণ কারও মধ্যে দেশপ্রেম জাগাতে গেলে নিজেকে ভালোবাসতে শিখতে হয়। যে নিজেকেই ভালোবাসে না, নিজের আনন্দ বেদনা বোঝে না, মা এবং মাটি যেখানে একাকার সেখানে মাকে উপলব্ধি না করে মায়েতে বিলীন না হয়ে সে কী করে মাতৃভূমির প্রেম উপলব্ধি করবে? মাকে তো তবু ধরা যায়, ছোঁয়া যায়। কিন্তু দেশপ্রেম ধরাছোঁয়ার বাইরে এক চরম পরম উপলব্ধি ব্যাপার। আমি যদি রাজনীতিতে না আসতাম, জেল-জুলুম সহ্য না করতাম, মানুষের গালি এবং ভালোবাসা না পেতাম সবকিছু উজাড় করা মাকে না পেতাম তাহলে মাটি আর মার স্পর্শ যে এক, মা আর মাটিতে যে কোনো পার্থক্য নেই, মায়ের কান্না আর মাটির কান্না একই রকম এর কিছুই বুঝতে পারতাম না। আল্লাহ আমাকে কত দয়া করেছেন ছেলেবেলায় যার সত্য-মিথ্যার কোনো উপলব্ধি ছিল না, ন্যায়-অন্যায়ের কোনো তফাত বুঝতাম না সেই অপদার্থকে আল্লাহ দয়া করে অন্তত পদার্থের কাছাকাছি করেছেন। এজন্য স্রষ্টার প্রতি পরম দয়ালু আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
যাক ওসব কথা, কেন যেন দেশে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বেনজীরের আবির্ভাব ঘটেছে। সেদিন মাননীয় সংসদ সদস্য বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী সংসদে বলার চেষ্টা করেছেন, সর্বত্র বেনজীর, সর্বত্র বেনজীরের প্রেতাত্মা। আবার আর একজন বেরিয়েছেন, নাম তার আছাদুজ্জামান মিয়া। কার কথা বলব, কাস্টমসের মতিউর রহমান, তার ছেলে ১৫ লাখ টাকা দামের ছাগল কোরবানির জন্য বায়না করে। শেষ বয়সে এসবও শুনলাম। দয়াল প্রভু জগৎ স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন কি এতই গরিব যে, তাঁর ২-৪-১০ লাখ বা হাজার কোটি কিংবা লক্ষ কোটির কোরবানির দরকার? তাঁর তো শুধু সমর্পণ দরকার। আল্লাহর দরবারে রাজা-বাদশা-আমির-ফকির-মিশকিনের কোনো তফাত নেই। কত রাজা-বাদশা-মন্ত্রী-মহামন্ত্রীর স্থান হবে ফকির মিশকিনের পিছে। ২৩ জুন পর্যন্ত বেনজীরকে দুদক সময় দিয়েছিল। হাজির হননি। এখন কী হবে? অন্যদিকে আনার হত্যার মাস পেরিয়ে গেল কোনো কূলকিনারা হয়নি। যদি আলামত না পাওয়া যায় আঙুর হোক, আনারস হোক, আপেল কিংবা কমলা কোনো কিছুর বিচার হবে না। হত্যার অস্ত্রের দরকার হবে, নিহতের লাশের দরকার সেটা সম্পূর্ণ হোক আর খন্ড-বিখন্ড হোক। অন্যদিকে কুষ্টিয়ার মিন্টু এখন আওয়ামী লীগের প্রতাপশালী সাধারণ সম্পাদক। ’৯০ সালের ১৭ জানুয়ারি আমি ঝিনাইদহের ওয়াপদা ডাকবাংলো থেকে গ্রেফতার হয়েছিলাম। তখন মিন্টু খুবই ছোট। আগাগোড়াই চটপটে। একদল পুলিশ, বিডিআর ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা যখন ডাকবাংলো ঘেরাও করে তখন তারা সত্যিকারে সরকারের লোক এটা জানার জন্য তখনকার ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সভাপতি আয়ুব হোসেনকে সালাম দিয়েছিলাম। বড় ভালো মানুষ ছিলেন আয়ুব হোসেন। তার স্ত্রী ওই অবস্থাতেও সকালের নাশতা নিয়ে এসেছিলেন। সে পুরনো দিনের কথা মনে হলে এখনো শিহরণ জাগে। সেই মিন্টু আনার হত্যায় এখন আসামিদের একজন। লোম বাছতে যেমন কম্বল উজাড়, তেমনি আওয়ামী লীগের খারাপ লোক বাছতে গিয়ে সব শেষ হয়ে যায় কি না বুঝতে পারছি না। তবে এটা সত্য, শুধু আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত, সরকারের সঙ্গে জড়িতদের নামেই এমন বিপুল দুর্নীতির যে বিবরণ প্রতিদিন প্রকাশ হচ্ছে এটা কোনো অশুভ অশনি সংকেত নয় তো? আরও তো অনেক আছে।
লেখক : রাজনীতিক
www.ksjleague.com