মঙ্গলবার, ২৫ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

গফুর, আমিনা আর মহেশের বাজেট

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

গফুর, আমিনা আর মহেশের বাজেট

প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সদ্য সমাপ্ত ঈদুল আজহায় এ বছর কোরবানির পশুর চাহিদা ছিল ১ কোটি ৭ লাখ। এর বিপরীতে সরবরাহ ছিল ১ কোটি ৩০ লাখ। সুতরাং বলা যায় বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ উন্নয়নেও স্বনির্ভর। ফলে সাত/আট বছর আগের তুলনায় পশু আমদানিতে সাশ্রয় ঘটেছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা, চামড়া সংরক্ষণে নিজস্ব সক্ষমতায় ঘটেছে যথেষ্ট উন্নতি। ঠিক এ নিরিখে দেখার বা পর্যালোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বেসরকারি খাতে প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে সরকারের বাজেটীয় প্রযত্ন প্রেরণা কতটুকু।

শরৎবাবু ভেবেই ছিলেন স্বাধীন দেশে সবাই সুখে থাকবে। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরোবার পরও, এ আশাবাদ ছিল বা আছে সবার। এ কারণে এবারের ‘জাতীয় বাজেট’টি অনেকটাই ‘জাতীয়’ হবে, এ প্রত্যাশা সবার। তবে দেখার বিষয় থেকেই যাচ্ছে, সবার আশা-আকাক্সক্ষার সালতামামিসহ ভবিষ্যৎ দিনাতিপাতের পথপরিক্রমার পথনকশা এই বাজেটে প্রকৃত প্রস্তাবে কেমন। বাজেট আলোচনা ও আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনাকে ৩০ জুনের বেড়াজালে আটকানোর মধ্যে মুনশিয়ানার কিছু নেই। বাজেটে বরাদ্দ দিয়েই দায়িত্ব শেষ এবং প্রচারের প্রগলভতায় তৃপ্তির ঢেকুর তোলা যুক্তিযুক্ত নয়। দেখা দরকার হবে বরাদ্দ অনুযায়ী আয়-ব্যয় হচ্ছে বা হবে কি না, বিশেষ করে কৃষক গফুর, নতুন প্রজন্ম আমিনা এবং প্রাণিসম্পদের প্রতিনিধি মহেশের।

সুবর্ণগ্রামের অতি প্রান্তজন আশির কাছাকাছি বয়সি গফুর, তার মেয়ে আমিনা এবং তাদের প্রিয় প্রাণিসম্পদ ও সংসারের অন্যতম অর্থনৈতিক সহযোগী সদস্য মহেশের কথা জাতীয় বাজেটে কীভাবে এবং কতটা প্রতিফলিত হবে সেটা নিরিখের জন্য বিষয়টি খোদ গফুর, আমিনা আর মহেশের কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের ‘কৃষকের বাজেটের’ এক মফস্বল মাহফিলে গফুর একবার যোগ দিয়েছিল আর দশজনের মতো। সে যা বলেছিল তা ছবিতে ও শব্দে ধারণ করা হয়েছিল।  সে শুনেছে গফুর যা যা বলেছিল তা টিভিতে নাকি দেখানোও হয়েছিল। (মহেশদের তো আর টিভি দেখার সুযোগ বিধাতা তাদের টিওআরএ রাখেননি) কিন্তু বাজেটে তার কিছু প্রতিফলন হয়তো হয়েছে হয়তো হয়নি। বাজেটে গফুরদের ভাগ্য ও বক্তব্য কৃষ্ণ চন্দবের এক গল্পের কবি প্রকৃতির সেই লোকটির মতো, যে সচিবালয়ে গাছচাপা পড়েছে যেখানে সে জায়গাটা কৃষি মন্ত্রণালয়ের, গাছের গোড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে, কবি হওয়ায় তার দেখভালের নথি তথ্য সম্প্রচার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে তাকে গাছের তলা থেকে উদ্ধারে যে টাকা লাগবে তা দেবার মালিক অর্থ মন্ত্রণালয়। গাছচাপা লোকটিকে বলা হলো তোমার ফাইল চালাচালি শুরু হয়েছে, খুব শিগগিরই তোমাকে উদ্ধার করা হবে। শেষমেশ লোকটা গাছের তলায় পড়ে মারাই গেল তার ফাইল চূড়ান্ত হওয়ার আগে। যে সমাজে ‘রোগী মারা যাবার পর ডাক্তার আসা’র কাহিনি হরহামেশা বিদ্যমান, যে অর্থনীতিতে আইন তৈরি হয়ে বাস্তবায়নে যাবার আগেই তা সংশোধন-সংস্কারের প্রয়োজন পড়ে, সে দেশে গফুর, আমিনা আর মহেশের ঠাঁই বাজেটের পাতায় উঠলেও উঠতে পারে। ডিজিটাল পদ্ধতির যেখানে জয়জয়কার সেখানে সুবর্ণগ্রামের গফুর আর মহেশের ভাগ্য ফিরতে কেন এত বিলম্ব? কেন তার কাছে স্টিমুলাস প্যাকেজের টাকা, প্রধানমন্ত্রীর নগদ সহায়তার টাকা পৌঁছাবে না, কেন সে টাকা মিথ্যা পরিচয় প্রত্যয়নের জোরে অপাত্রে যাবে? স্বাধীনতার পাঁচ দশকের মাথায় এসে এখনো গফুর আর মহেশের নাম-নিশানা নিয়ে ‘বোধগম্যতা’ কিংবা ‘দৃষ্টিসীমা’ কেন প্রসারিত হয়নি বা হচ্ছে না, মহেশ তা বলবে কীভাবে? আগে ‘পশু’ সম্পদ পরে ‘প্রাণী’ সম্পদভুক্ত (মিউটেশনে একধাপ উন্নতি?) হতে পেরেছে সে। পশু প্রাণীতে পরিণত হয়েছে তবে বাজেটে এই উত্তরণের কোনো উপায় উপকরণের সুফল দেখা যায় না, অথচ মন্ত্রণালয় ও দফতরের দক্ষতা-সক্ষমতা বৃদ্ধির এন্তেজাম আছে প্রচুর। সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় রিমাল ও জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কোনো তত্ত্ব-তালাশই হয়েছে বা হবে কি না, জানা যায় না। হায় বাজেট, সেখানে ভেসে আসা মরা হরিণের প্রসঙ্গ টেনে এনে একটা লাইনও যদি থাকত! বরাদ্দ তো দূরের কথা।

বাজেটে যা সাব্যস্ত হয় তা টের পেতে গফুর-আমিনাদের সময় লাগে না। গফুর নিজে এটা জানা বোঝার আগেই মোবাইলে তার পয়সা কাটা শুরু হয়ে যায়। এ পয়সা সরকারের খাজাঞ্চিখানায় কখন পৌঁছাবে, আদৌ পৌঁছায় কি না তার কিছুই সে জানে না, কেউ তাকে হিসাবও দেয় না। মোটাতাজাকরণ ধরনের যে তেলেসমাতি চালু হয়েছে তাতে নিজের মানসম্মান নিয়ে বংশ গৌরব ও জাতপাত নিয়ে মহেশদের ইদানীং বেঁচে থাকাই দায়। মহেশদের একসময় সম্মান ও কদর ছিল চাষাবাদে সহায়তার জন্য। এখন হালচাষের কাজও করে দেয় মেশিন। মহেশদের এখন কোরবানির মৌসুমে কাকে কত দামে বিক্রিযোগ্য করা যাবে, সেই ধান্দায় থাকে সবাই। এজন্য তাকে কত কিছু খেতে দেওয়া হয়, তাকে হাইব্রিড পণ্য বানানোর জন্য। হায় অবস্থা এখন এমন হয়েছে গফুর এক মণ ধানের যা দাম পায় তা দিয়ে ১ কেজি গরুর গোশতও পাওয়া যায় না। কোরবানির কালে মহেশদের হাটে ওঠা, বেচাকেনা, মাংস বানানো, বিলিবণ্টন, চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ-রপ্তানি এবং এমনকি মসলা আমদানি- সবই অনিশ্চিতের আঁধারে।

গফুরের বয়স এখন আশির কাছাকাছি। সে তিন জমানার তিন পতাকা দেখেছে। ব্রিটিশ আমলের পড়ন্ত বেলায় সে শুনেছে সামনে সুদিন আসছে। তার সঙ্গে তার পাড়ার পঞ্চায়েত পয়সাওয়ালাদের আর কোনো ফারাক থাকবে না, বৈষম্য কমে যাবে কত কিছু। কিন্তু পাকিস্তান আমলে সে জানতে পারল বৈষম্য কমেনি বরং বাইশ পরিবার চুরানব্বই লাখ পরিবারের প্রতিপক্ষ বনে গেছে। এসবের থেকে ‘মুক্তির সংগ্রামে’ গফুর নিজেও অনেক কষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছে। কিন্তু পরবর্তী পঞ্চাশের বেশি বছর, এখন ঘরে ঘরে শিক্ষিত বেকার সন্তানের সমাহার বাড়ছে। তাদের চাকরির বয়স চলে গেছে বা যাচ্ছে, তাদের অনেকেই এখনো চাকরি বা কোনো কর্মে নিয়োজিত হতে পারেনি। কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে অনেক কিছু খুইয়ে। আর তাদের দেশের কাজ করতে আসছে বিদেশের মানুষ। চাকরি-বাকরি কর্মসৃজনে এই যে আত্মঘাতী অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে এসব নিয়ে জাতীয় বাজেটে কোনো কর্মপরিকল্পনা আছে কি না গফুর এখনো জানতে পারেনি। গফুরের চোখে পানি এসে গেল, আমার আমিনা যদি লেখাপড়া না করতে পারে তাহলে ক্ষতিটা হবে কার? আমার।

বাজেটে প্রান্তজনদের সামাজিক নিরাপত্তা জাল বিস্তৃত হচ্ছে। কিন্তু আসন্ন শিক্ষিতজনদের কর্মসৃজনের প্রয়াস প্রচেষ্টায় কোনো কিছুর ভিজিবিলিটি বারবার চশমা পাল্টিয়েও বাড়ছে না। গফুর জমি চাষ করে এক ফসলের জায়গায় দুই তিন ফসল উচ্চ ফলনশীল শস্যের সমাহার ঘটায় কিন্তু তার বিক্রয়মূল্য যেভাবে পড়তে শুরু করেছে ভবিষ্যতে চাষাবাদে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়ে কি না, আবার খাদ্যশস্য আমদানির পথে হাঁটতে হয় কি না সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। গফুররা যাবে কোথায়?

গফুর ও আমিনারা গ্রামে বাস করে। সেই গ্রামীণ সমাজে বেশ কিছু পরিবর্তন তাদের ভাবায় বৈকি। ডিজিটাল অগ্রগতিতে সামাজিক যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে অনেক ইতিবাচক সাফল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু এর বিপরীতে ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধার অবৈধ ব্যবহারে উসকে দিয়ে সামাজিক ঐক্য, শান্তি ও নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন করা হচ্ছে। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ভিনদেশি ভাব ও ভাষা উগ্র এবং অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে পরিচিতি ও ব্যবহারকে সহজলভ্য করে তুলেছে। তাদের পড়াশোনা ও জ্ঞানচর্চায় নানা অনৈতিক পন্থা ও প্রবৃত্তি অনুসরণে আগ্রহী করে তুলছে। ‘জাতীয়’ পাঠ্যপুস্তক বোর্ড থেকে ‘দলীয়’ লেখকদের দিয়ে মুক্ত বুদ্ধির পরিবর্তে বৃত্তাবদ্ধ বই বিনামূল্যে ধনী-দরিদ্র-নির্বিশেষে সবাইকে বিলি করা হচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশ অরাজকতা বিরাজ করছে।

শিক্ষকের নিয়োগ ও তাদের জ্ঞানবত্তা গুণগত মান নিয়ে সদাসর্বদা বাণিজ্য, অনিয়ম ও দুর্নীতি সর্বব্যাপী হয়ে ওঠায় শিক্ষার মানে ধস নামছে। জিপিএ-৫ পেয়েও শিক্ষার্থীরা উচ্চপর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষাতেই কুপোকাত হচ্ছে। চাকরি-বাকরির পরীক্ষায় তারা সৎভাবে টিকতেই পারছে না। গফুর দিব্যদৃষ্টিতে দেখছে তার দেশ ও সমাজ এক ধরনের অস্বস্তিকর মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার কারণে। শিক্ষায় ভর্তুকি দিয়ে জনশিক্ষার হার হয়তো বাড়ছে কিন্তু গণশিক্ষা হচ্ছে না। এভাবে অন্তঃসারশূন্য শিক্ষায় শিক্ষিতরা দেশ ও সমাজের সম্পদ হওয়ার পরিবর্তে ‘সমস্যা’য় পরিণত হয় কি না গফুর কাকে দেখতে বলবে?

মৎস্য ও পশুসম্পদ বিভাগের কাজ একত্রে থাকায় এবং মৎস্য চাষাবাদ ও ব্যবসায়ের সঙ্গে নগদ স্বার্থবাদিতার সম্পর্ক বেশি থাকায় মৎস্য সম্পদের দেখভাল প্রক্রিয়া পশুসম্পদের হিস্সায় ভাগ বসাচ্ছে। মহেশের মনে দুঃখ অনেক। গফুর ইদানীং মাছ চাষের ব্যাপারে যতটা আন্তরিক, মহেশের দেখাশোনার ব্যাপারে ততটা নয়।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

সর্বশেষ খবর