বুধবার, ২৬ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

টালমাটাল ভারতের রাজনীতি

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

টালমাটাল ভারতের রাজনীতি

ভারতের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে দিল্লিতে প্রথম জোট সরকার গঠন করেন বিজেপিরই প্রবীণ নেতা অটলবিহারি বাজপেয়ি। জোট সরকারের অভিজ্ঞতা একেবারেই নেই নরেন্দ্র মোদির। জোটের দুই বড় শরিক অন্ধ্রের চন্দ্রবাবু নাইডু এবং বিহারের নীতীশ কুমারের কাছে তাকে জিম্মি থাকতে হবে। চন্দ্রবাবু নাইডু আগে অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এবার আবারও তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। অটলবিহারি যখন দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। গত ১০ বছর তিনি তার দল বিজেপির তরফে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এমনকী একটা সময় তার আম্মিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, তিনি নিজেই প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেন ‘মোদি সরকার’। আর মোদি সরকার থাকল না। এবার এনডিএ অর্থাৎ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন-মোদি সরকার থেকে এনডিএ সরকার। আর জোট সরকার চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তিনি কি পারবেন একটা পূর্ণাঙ্গ জোট সরকার চালাতে?

ইতোমধ্যে শরিক দলগুলো নানাভাবে দাবি-দাওয়া নিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেছে। অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্র বাবু নাইডুর তেলেগু দেশম পার্টির লোকসভায় নির্বাচিত সদস্য ১৬ জন। তাদের মধ্যে দুজন পূর্ণ ও দুজন প্রতিমন্ত্রী। বিজেপির শীর্ষ নেতারা স্পিকারের পদটি অন্য কোনো শরিক দলকে দেবেন না। এখানেই সংকট শুরু হয়ে গেছে। কথা ছিল ১৩-১৪ তারিখে সংসদে স্পিকার নিয়োগ করা হবে। কিন্তু পরে নিয়োগ পিছিয়ে দেওয়া হয়। ২৬ জুন এই স্পিকার পদে নিয়োগ করা হবে। এদিকে তেলেগু দেশম পার্টির নেতা চন্দ্র বাবু নাইডু দেখে নিতে চাইছেন তার দলের কাউকে স্পিকার করা হচ্ছে কি না। কিন্তু যদি তা না হয়, তাহলে নয়া এনডিএ সরকারের কাঠামো কেমন হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছে। অপরদিকে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার যার লোকসভা সদস্য সংখ্যা ১২, তিনিও তার দলের দুজনকে পূর্ণ মন্ত্রী করেছেন। তার অন্যতম প্রধান দাবি হলো ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্প বাতিল করা। এই দাবি তিনি লোকসভা নির্বাচনের আগেই মোদির কাছে করেছিলেন। তার দ্বিতীয় দাবি হলো জাত গণনা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ‘অগ্নিবীর’ থেকে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কিংবা জাতভিত্তিক সমীক্ষাকে কেন্দ্র করে বিজেপির সঙ্গে শরিকদের বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসতে বাধ্য। দীর্ঘ সময় ধরে গ্রামীণ যুবকদের চাকরির বড় উৎস হলো সেনাবাহিনী। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরে সেনায় পাকা চাকরির পরিবর্তে ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্প চালু করে মোদি সরকার। এই প্রকল্পে চাকরির মেয়াদ মাত্র চার বছর। সেনাবাহিনীতে পাকা চাকরির সুযোগ চলে যাওয়াতে রাজস্থান, হিমাচল প্রদেশ, বিহার, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলোর গ্রামীণ এলাকার যুব সমাজের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল।

নির্বাচনি প্রচারে ইন্ডিয়া জোটের নেতারা ক্ষমতায় এলে ওই প্রকল্প বাতিল করে পূর্বাবস্থা ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নীতীশ কুমারের রাজ্যেও তার ওপর এই চাপ রয়েছে। নরেন্দ্র মোদির শপথে এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শপথ নেওয়ার পরেই মোদি এস জয়শঙ্করকে বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, মালদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং বাণিজ্য বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনায় বসতে। মোদি দিল্লির গদিতে বসার পরই জয়শঙ্কর বিদেশ সচিব নিযুক্ত হন। ক্রমে ক্রমে তিনি নরেন্দ্র মোদির বিদেশ নীতির প্রধান পরামর্শদাতা হয়ে ওঠেন। মালদ্বীপের সঙ্গে ভারতের সংঘাত এখনো টাটকা। এই পরিস্থিতিতে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এস জয়শঙ্করের বৈঠকটিও ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর জয়শঙ্কর বলেন, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী এগিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন এবং হাসিনা কন্যা তথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। ভারত-সফর শেষের আগে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হন শেখ হাসিনা। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পুত্র-কন্যাসহ সোনিয়া দিল্লির আইসিটি মৌর্য হোটেলে যান। সেখানেই তৈরি হয় এই আবেগঘন মুহূর্ত। প্রিয়াঙ্কা হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, অনেকদিন পরে আপনার সঙ্গে দেখা হলো। উল্লেখ্য, দিল্লিতে এলে গান্ধী পরিবারের সঙ্গে দেখা না করে ফেরেন না শেখ হাসিনা।

এদিকে পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, এনডিএ সরকার বেশি দিন টিকবে না। তার মতে, কংগ্রেস প্রয়োজনীয় সক্রিয়তা দেখালে বিষয়টি ইন্ডিয়া মঞ্চের অনুকূলে আসতে পারত। তিনি ঠারেঠোরে বোঝাতে চেয়েছেন, মোদির এনডিএ সরকার বেশি দিন টিকতে পারবে না। বরং এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে যে শেষ পর্যন্ত ইন্ডিয়া জোটই সরকার তৈরি করবে। আর সেই সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে তাঁরই। বিজেপি একক গরিষ্ঠতা যখন পায়নি তখন কংগ্রেসের উচিত ছিল সরকার গঠনের চেষ্টা করা। দেশের মানুষ মোদি বা বিজেপিকে চাননি। তাই ইন্ডিয়া জোটের উচিত ছিল সরকার গঠনের চেষ্টা করা। ভারতের রাজনীতির এই টালমাটাল অবস্থা কতদিন চলবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর