বুধবার, ২৬ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

সুন্দরবন বাঁচাতে হবে

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

সুন্দরবন বাঁচাতে হবে

সুন্দরবনসহ উপকূলীয় জনপদ আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রাকৃতিক সম্পদের আধার। সুন্দরবনসহ উপকূলীয় জনপদের মানুষ ও প্রাণপ্রকৃতি বারবার মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ২০০৭ ও ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার তাণ্ডবে শত শত কিলোমিটার উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কৃষিজমি, মৎস্য খামার ও জনবসতিপূর্ণ এলাকায় সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ে। গত ২৭ মে উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঘূর্ণীঝড় রেমাল আঘাত হানার পর ব্যাপক ধ্বংসাত্মক ক্ষয়ক্ষতিতে শতাধিক উপজেলার মানুষের মধ্যে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। পূর্ব সতর্কতার কারণে মানুষের প্রাণহানির সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও সুন্দরবনে হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণী এবং উপকূলীয় এলাকায় হাজার হাজার গৃহপালিত গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি মারা গেছে। তবে শুধু আর্থিক মানদণ্ডে আমাদের উপকূলীয় প্রাকৃতিক সুরক্ষাব্যুহ সুন্দরবনের ক্ষতিসহ সামগ্রিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ করা সম্ভব নয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ ক্ষতির অঙ্ক লাখ লাখ কোটি টাকার চেয়ে বেশি। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট সাইক্লোন থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলকে প্রাকৃতিক সুরক্ষা দিচ্ছে সুন্দরবন। গত ১০০ বছরের মধ্যে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ৫০৮টি সাইক্লোনের উৎপত্তি হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৭ শতাংশ সাইক্লোন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আঘাত হেনেছে। সাম্প্রতিক দুই বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ ও ‘আইলা’র ধ্বংসযজ্ঞ থেকেও বাংলাদেশকে অনেকটা রক্ষা করেছে সুন্দরবন। উপকূলীয় সম্পদের সুরক্ষার বাস্তবসম্মত উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের কোটি মানুষের কর্মসংস্থান, জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নিশ্চিত সম্ভাবনা। এখন ঘূর্ণিঝড় রিমালের ক্ষয়ক্ষতিকে সামনে রেখে এ বিষয়ে জরুরিভিত্তিতে নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। উপকূলীয় জনপদকে অরক্ষিত রেখে, সেখানকার সাহসী, পরিশ্রমী মানুষদের দুস্থ অবস্থায় রেখে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ প্রত্যাশা করে দেশের সাধারণ মানুষ। সুন্দরবন হচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ লোনা পানির বা ম্যানগ্রোভ বন। এ বন জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। এখানে শত শত প্রজাতির গাছ, বিভিন্ন বন্যপ্রাণী, অসংখ্য প্রজাতির পাখি ও বিপুল মৎস্য সম্পদ রয়েছে। সুন্দরবন সংলগ্ন পাঁচটি জেলার কয়েক লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয় এ বনের ওপর নির্ভর করে। সুন্দরবন যে কেবল কয়েক লাখ মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করে তাই নয়, বরং এটি নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে সুরক্ষা দেয়। বিশেষ করে ২০০৭ সালে সংঘটিত প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের কথা আমাদের মনে আছে। ওই ঝড়ে সুন্দরবন একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার মাধ্যমে এ বন লাখ লাখ মানুষের প্রাণ রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। এতকিছু জানার পরও মানুষ নির্বিচারে এ বন উজাড় করে চলেছে। ফলে দ্রুত কমে আসছে সংরক্ষিত বনের আয়তন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন ছিল বর্তমানের দ্বিগুণ। কমতে কমতে বর্তমানে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন এখন দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটারে, যা দেশের সংরক্ষিত বনভূমির সর্বমোট ৫১ শতাংশ। এ অবশিষ্ট বনাঞ্চল সুরক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। বৈশ্বিক পর্যায়ে সুন্দরবনের গুরুত্ব বিবেচনায় ১৯৯৭ সালে এ বনকে ৭৯৮তম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করেছে জাতিসংঘের ইউনেসকো। এখানে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদরাজি রয়েছে। এ ছাড়া ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণসহ ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, লোনা পানির কুমির, গুইসাপ, কচ্ছপ, ডলফিন, অজগর, কিং কোবরাসহ ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৩১৫ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এসব প্রাণিকূল রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে সার্বিক জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন পরিস্থিতিতে সুন্দরবনকে অগ্নিকাণ্ডের হাত থেকে রক্ষার পাশাপাশি এর ভিতর দিয়ে বয়ে চলা নদীগুলো রক্ষায়ও জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় বিবেচনা করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। সুন্দরবনসহ দেশের সব প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সুন্দরবনসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে শুধু গাছ লাগিয়ে পরিবেশ সুরক্ষা হবে না। পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রকে গুরুত্ব দিতে হবে।

সুন্দরবন বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। যতগুলো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে, সবকটি থেকে দেশকে রক্ষা করেছে সুন্দরবন। বাংলাদেশের ফুসফুসখ্যাত সুন্দরবন অক্সিজেনের এক বিশাল ফ্যাক্টরি হিসেবে কাজ করে। এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও অনেক। সুন্দরবন থাকার সুবাদে আমরা সৌভাগ্যবান। জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব ও মানবসৃষ্ট নানা কারণে সুন্দরবনে গাছপালা এবং প্রাণিকুল হুমকির মুখে। অজ্ঞতা ও অবহেলা এবং সুন্দরবনের ভিতরের নদীগুলোর লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়াসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে অনেক গাছপালা ও প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। বারবার আগুন লেগে বনের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়েছে। এ আগুনের তীব্র তাপ পুড়ে যাওয়া এলাকার বাইরেরও বিস্তৃত এলাকায় পরিবেশের ক্ষতি করে, বিপন্ন করে প্রাণিকুলকে। উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করার জন্য পরিকল্পিত বনায়নের পাশাপাশি বৃহত্তম এ ম্যানগ্রোভ রক্ষা করতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি প্রাণী ও ভেষজের আধার সুন্দরবন। সবাই মিলেই সুন্দরবনকে বাঁচাতে হবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর