বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

হিন্দু-মুসলমানের বিয়ের পরিণতি

তসলিমা নাসরিন

হিন্দু-মুসলমানের বিয়ের পরিণতি

বলিউডের অভিনেত্রী সোনাক্ষী সিনহার বিয়ে হলো অভিনেতা জহির ইকবাল রতনসির সঙ্গে। সোনাক্ষী হিন্দু, জহির মুসলমান, কিন্তু তাঁদের বিয়ে হিন্দু রীতিতে হয়নি, মুসলিম রীতিতেও হয়নি। হয়েছে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট বা বিশেষ বিবাহ আইন নামক একটি আইনের অধীনে। বিশেষ বিবাহ আইন ইংরেজরা প্রথম তৈরি করেছিল ১৮৭২ সালে। ভিন্ন জাতের এবং ভিন্ন ধর্মের মানুষেরা পরস্পরকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চাইলে এই আইনের আশ্রয় নিয়ে যেন নির্বিঘ্নে বিয়ে করতে পারে। আইনটিতে বিবাহ নিবন্ধিত করার শর্তজুড়ে দিয়ে ১৯৫৪ সালে কিছুটা সংশোধন করা হয়েছে। এই আইনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমান জৈন শিখ পার্সি ইহুদি- যে কারও সঙ্গে যে কারও বিয়ে হতে পারে, এবং সে বিয়েতে কোনো ধর্ম এবং ধর্মীয় রীতির উপস্থিতি জরুরি নয়। বিয়ের পাত্রপাত্রীকে একই ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার প্রয়োজন নেই। যার যার ধর্মবিশ্বাস তার তার থেকে যায়। বিয়ের কারণে সোনাক্ষী এবং জহির, কাউকেই তাঁদের ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তন করতে হয়নি। জহিরের যদি নামাজ রোজা করতে ইচ্ছে হয়, করবেন। আর সোনাক্ষীর যদি পুজো করতে ইচ্ছে হয়, করবেন। হ্যাঁ একই বাড়িতে দুই ধর্মই পালিত হবে। কেউ কাউকে স্বধর্ম পালনে বাধা দেবেন না। শাহরুখ খানের বাড়িতে তো এমনই হয়। তাঁর বাড়ি মান্নাতে গণেশ আর লক্ষ্মী মূর্তি আছে। কোরআনও আছে একই বাড়িতে। পুত্র আরিয়ান ভালো গায়ত্রী মন্ত্র জানে। মান্নাতে ঘটা করে দিওয়ালি পালন করা হয়, ঘটা করে ঈদও পালন করা হয়। শাহরুখ আর গৌরির সন্তানরা হিন্দু এবং মুসলমান দুই ধর্ম সম্পর্কেই জানে। এবং দুই ধর্মই পালন করে।

ভিন্ন রাজনীতিতে, ভিন্ন অর্থনীতিতে, ভিন্ন দর্শনে বিশ্বাস নিয়েও যেমন দুজন মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসতে পারে, ঠিক তেমন, ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাস নিয়েও দুজন মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসতে পারে। ধর্মীয় রীতিতে, বিশেষ করে ইসলামী রীতিতে হিন্দু-মুসলমানে বিয়ে হলে হিন্দুকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়, খ্রিস্টান-মুসলমানে বিয়ে হলে খ্রিস্টানই ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, বৌদ্ধ-মুসলমানে বিয়ে হলে বৌদ্ধই ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বিয়ের জন্য কিন্তু কোনো মুসলমানকে ধর্ম বদলাতে হয় না। অথচ মুসলমানের সঙ্গে বিয়ে হলে সব অমুসলিমকে নিজের ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হয়। এই বৈষম্যের ভিতরে যেতে না চাইলে বিশেষ বিবাহ আইনে বিবাহটি করে ফেলাই উত্তম ।

যে তার প্রেমিক/প্রেমিকাকে ধর্ম বদলাবার জন্য চাপ দেয়, তাকে বিয়ে না করাই ভালো। কারণ সে প্রেমিক/প্রেমিকার চেয়ে ধর্মকে বেশি ভালোবাসে, তাছাড়াও নিজের ধর্মকে সব ধর্মের ওপরে রাখে। এই মেগালোম্যানিয়া যে কোনো সুস্থ সুন্দর সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর। যে মনে করে, তার ধর্মটি অন্য সব ধর্মের চেয়ে সেরা, যে মনে করে সেরা ধর্মের অনুসারীদের ধর্মান্তরিত হতে হয় না, সে কী করে তাদের ভালোবাসবে, যাদের ধর্মান্তরিত হতে হয়? সে নিশ্চয়ই তাদের ধর্মকে ভুল ধর্ম বলে মনে করে, ভুল ধর্ম বলেই ভুল ধর্মকে ত্যাগ করতে হয় বলে মনে করে! তার নিশ্চয়ই তথাকথিত ভুল ধর্মের অনুসারীদের জন্য শ্রদ্ধাবোধ জাগে না!

সোনাক্ষী আর জহিরের বিয়েতে কেবল আশীর্বাদই জুটছে না, অভিশাপও জুটছে। কট্টর হিন্দুরা ঘৃণা ছুড়ে দিচ্ছে। তারা দাবি করছে এ ‘লাভ জিহাদ’। হিন্দু মুসলমানে বিয়ে হলেই কিছু মুসলিমবিদ্বেষী হিন্দুবাদী বলবেই হিন্দুকে মুসলমান বানাবার জিহাদ ছাড়া এ কিছু নয়। হিন্দু আর মুসলমান তরুণ তরুণীর মধ্যে যে নিখাদ প্রেম হতে পারে, এ তারা বিশ্বাস করে না। তারা বিশ্বাস করে হিন্দুকে বিয়ে করা মুসলমানদের ষড়যন্ত্র। বিয়ের কিছুদিন পর বউকে বোরখা পরাবে, আর তার কিছুদিন পর তিন-তিনটে বউ নিয়ে আসবে ঘরে। ভালোবাসার অভিনয় করে মুসলমান পুরুষরা হিন্দু মেয়েদের দুর্বল ক’রে, তাদের ধর্মান্তরিত ক’রে মুসলমান বানিয়ে, মুসলমান সন্তান উৎপাদন করে সমাজ সংসার ছেয়ে ফেলতে চায়। হিন্দু-সংখ্যা এভাবেই কমতে কমতে শূন্য হবে, আর মুসলমান-সংখ্যা ফুলে ফেঁপে আকাশ ছোঁবে। এভাবে পৃথিবীটাই হয়ে উঠবে একদিন দারুল ইসলাম বা ইসলামের পুণ্যভূমি। সোনাক্ষীকে ধরে বেঁধে ধর্মান্তরিত করা হয়নি, তারপরও জহিরকে ‘লাভ জিহাদ’ করার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে। সোনাক্ষীর বিরুদ্ধে বিহারে বিক্ষোভ হয়েছে, তাঁকে নাকি পাটনায় ঢুকতে দেওয়া হবে না। সোনাক্ষী যাঁকে বিয়ে করেছেন, সাত বছর তাঁর সঙ্গে তিনি প্রেম করেছেন, গত এক বছর তাঁর সঙ্গে একত্রবাসও করেছেন। দেখেশুনেই সুদর্শন যুবক জহিরকে তিনি জীবনসঙ্গী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জহির হ্যান্ডসাম, কিউট, রিচ, মডার্ন, ফান-লাভিং। তাঁর প্রেমে পড়তেই পারে যে কোনো ধর্মের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা যে কোনো মেয়ে। সোনাক্ষী টিন এজার নয়, ৩৭ বছর বয়সী প্রাপ্তবয়স্ক নারী।

বিয়েতে সোনাক্ষীর দুই দাদা লব আর কুষ উপস্থিত ছিলেন না। আমরা অনুমান করতে পারি কেন তারা অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁরা তাঁদের বোন সোনাক্ষী যে এক মুসলমানকে বিয়ে করেছেন, সেটা মানতে পারেননি। জহির ইকবালের পরিবারের কেউ আপত্তি করেনি এই বিয়েতে। সোনাক্ষীকে সাদরে বরণ করেছে জহিরের পরিবার।

সোনাক্ষীর বিয়ের সাজ অতি সাধারণ। বলিউডের অন্যান্য অভিনেত্রী দীপিকা, আনুস্কা, ক্যাট্রিনা, আলিয়া বা প্রিয়াংকার বিয়ের সাজের মতো নয় মোটেই। সোনাক্ষী পরেছেন ৪৪ বছরের পুরনো মায়ের বিয়ের শাড়ি আর গহনা। জহিরও কোটি টাকার পোশাক পরেননি। ওভাবেই ধর্ম-মুক্ত বিবাহের দলিলে দুই প্রেমিক প্রেমিকা সই করেছেন এবং স্বামী স্ত্রীতে পরিণত হয়েছেন।

অনেকেই প্রশ্ন করছে সোনাক্ষী আর জাহিরের সন্তানদের ধর্ম কী হবে? শাহরুখ খান, সঈফ আলী খান, আমির খান, মনসুর আলী খান পতৌদির মতো জহিরও স্বামীত্ব ফলিয়ে তাঁদের সন্তানদের মুসলিম পরিচয়ে বড় করে তুলতে চাইবেন কি না। যদি চান সেটা, তাহলে শর্মিলা, কারিনা, রীনা, গৌরীর মতো সোনাক্ষীও মুখবুজে মেনে নেবেন কি না। যদি জহির তাঁদের সন্তানদের মুসলিম পরিচয়ে পরিচিত করাতে চান এবং সোনাক্ষী সেটা মেনে নেন তবে এ ঘটনাও পুরুষতন্ত্রের গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়ার মতো ঘটনা হবে। নতুন কোনো ইতিহাস সৃষ্টি হবে না।

আমি মনে করি, জন্মের পরপরই কোনো শিশুর গায়ে কোনো ধর্মের লেবেল সেঁটে দেওয়া উচিত নয়। পিতা-মাতা একই ধর্মের অনুসারী হন, বা ভিন্ন ধর্মের অনুসারী হন, সন্তানকে কোনো একটি বিশেষ ধর্ম পালনে অনুপ্রাণিত করা বা বাধ্য করা একেবারেই ঠিক নয়। সন্তান বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবে, এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে কোন ধর্ম সে পালন করবে, অথবা আদৌ কোনো ধর্ম সে পালন করবে কি না। সন্তানের ওপর নিজেদের ধর্ম চাপিয়ে না দিয়ে সন্তানকে পৃথিবীর সমস্ত ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান আহরণের সুযোগ দিয়ে অতঃপর সন্তানকে নিজের ধর্ম বা দর্শন নির্বাচন করার স্বাধীনতা দেওয়াই সভ্য পিতা-মাতার কর্তব্য। সমাজ এখনো ততটা সভ্য হয়নি, যতটা সভ্য হওয়া দরকার। সে কারণে পিতা-মাতার ধর্মকেই সন্তানরা নিজেদের ধর্ম বলে বিশ্বাস করে।

মুসলমান নায়ক, গায়ক, শিল্পী, সাহিত্যিক যাঁরাই হিন্দু মেয়েদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন, সে বিবাহ ধর্মীয় রীতিতে হোক বা না হোক, তাঁদের সন্তানদের নামে, লক্ষ্য করেছি, আরবি-ফারসির প্রভাব। সন্তানরা হয়তো বাবা-মায়ের দুই ধর্মই যখন যেটা ইচ্ছে পালন করছে, কিন্তু নাম কারও রামায়ণ মহাভারত বা গীতা থেকে নেওয়া নয়, নেওয়া কোরআন থেকে বা ইসলামের ইতিহাস থেকে। এই পক্ষপাত উচিত নয়। আমি মনে করি এর পেছনে ধর্মের অনুশাসন ততটা নেই, যতটা আছে পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য। আমির খান আর রীনা দত্তের ছেলে মেয়ের নাম জুনাইদ খান আর ইরা খান কেন, কেন কারও নামের পদবি দত্ত নয়? কেন শাহরুখ খান আর গৌরী ছিবারের পুত্রের নাম আব্রাহাম, কিন্তু আদিত্য নয়, কেন খান, কেন কারও পদবি ছিবার নয়? কারিনা কাপুর আর সঈফ আলী খানের দুই পুত্রের নাম তৈমুর এবং জাহাঙ্গীর। কেন কারও নাম তীর্থংকর কাপুর বা জগন্নাথ কাপুর নয়? পুরুষতন্ত্র প্রচণ্ড শক্তিশালী, অনেকটা ধর্মের মতোই শক্তিশালী। মিশ্র বিবাহের সন্তানদের নামেই সেটা অনুমান করা যায়।

আমি বিশ্বাস করি পদবিহীন নামে, প্রতিটি মানুষকেই যেহেতু আমি স্বাধীন এবং স্বকীয় সত্তার অধিকারী বলে মনে করি। আমার নামে কোনো পদবি নেই। আমি আমার ভাই-বোনের সন্তানদের যে নামগুলো রেখেছি, সেগুলোতে কোনো পদবি নেই। স্রোতস্বিনী ভালোবাসা, অনাবিল উৎসব, সমৃদ্ধ সংশপ্তক, অথই নীলিমা। এই নামগুলোয় কোনো ধর্মের গন্ধ নেই। নামগুলো বিশুদ্ধ বাঙালি নাম। মানুষের নামের মধ্যে ধর্মকে ঢুকিয়ে রাখা খুব ভালো কাজ নয়। বাঙালি-মুসলমান-সমাজে বড় হওয়া প্রগতিশীল মানুষেরা সন্তানের নাম থেকে ধর্ম বিদেয় করতে পারে। কিন্তু লক্ষ্য করেছি হিন্দু সমাজে বেড়ে ওঠা মানুষেরা যত আধুনিক আর প্রগতিশীলই হোন না কেন, যত মুক্তচিন্তকই হোন না কেন, পদবি ছাড়া নাম তাঁরা কল্পনাও করতে পারেন না। তাঁরা রিফর্মেশান পর্যন্ত যেতে পারেন, রেভ্যুল্যুশান পর্যন্ত পারেন না। তাই নাস্তিক হয়েও তাঁরা রয়ে যান সুদীপ মৈত্র হয়ে, সাধন বিশ্বাস হয়ে, অনিমেষ বৈশ্য হয়ে, ভাস্কর সেন হয়ে। তাঁদের সন্তানদেরও ধারণ করতে হয় তাঁদের হিন্দু পদবি।

কথা হচ্ছিল সোনাক্ষী সিনহা আর জহির ইকবালের সন্তানদের নামকরণ নিয়ে। তাঁরা যদি পদবি খুব পছন্দ করেনই, তবে দুজনের পদবিই ব্যবহার করতে পারেন। সন্তানের নাম যদি ধর্মনিরপেক্ষ ‘আশা’ রাখা হয়, তবে পুরো নামটি দাঁড়াবে আশা সিনহা রতনসি অথবা আশা রতনসি সিনহা। আর যদি পদবির সংস্কারকে অতিক্রম করতে পারেন, তাহলে ‘অনন্ত আশা’ বা ‘আশা অনন্ত’ নয় কেন? সংস্কার এবং ঐতিহ্যের বাইরে দাঁড়িয়েও তো ভাবা যায়!

ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমানের বিয়ে সাধারণত হিন্দু মুসলমান কোনো পক্ষই মেনে নিতে পারে না। প্রেম করেছে বা বিয়ে করেছে এমন সংবাদ শুনলে অনেকে পাত্র বা পাত্রীকে ঠান্ডা মাথায় খুন পর্যন্ত করে ফেলে। সোনাক্ষী আর জহিরের ওপর শারীরিক আঘাত হয়তো আসবে না, কারণ তাঁরা ধনী এবং ধনীদের নিরাপত্তা সমাজে যথেষ্ট। আমি আশা করি, তাঁরা সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করবেন। এবং সাম্প্রদায়িক লোকদের নিন্দে আর ধিক্কার, কুৎসা এবং ঘৃণা ফুঃ মেরে উড়িয়ে দেবেন। আমি বিশ্বাস করি, হিন্দু মুসলমানে যত বেশি বিয়ে হবে, সমাজ তত বেশি অসাম্প্রদায়িক হবে।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

সর্বশেষ খবর