শিরোনাম
শুক্রবার, ২৮ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

বরগুনাবিষয়ক বিরূপ বার্তা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

বরগুনাবিষয়ক বিরূপ বার্তা

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে জেগে ওঠা নদীবিধৌত এক অপরূপ জেলার নাম বরগুনা। গুণের শেষ নেই এই বরগুনার। প্রতি বছর নভেম্বরে ঘটা করে জেলায় জোছনা উৎসব করেন আধুনিক ও সংস্কৃতিমনা বরগুনাবাসী। স্থানীয় রাখাইনরা তাতে যোগ করে উপজাতীয় সংস্কৃতির বাড়তি স্বাদ। সাগর আর নদীগুলো যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে পুরো জেলা বিশেষত উপকূলীয় দ্বীপগুলোকে প্রকৃতির আপন মহিমায় সাজিয়ে দিতে। যাদের ভ্রমণপিয়াসী মন ও অনুসন্ধানী চোখ নানা বর্ণের গাছগাছালি, রঙিন পাখি আর দুরন্ত সব জলজ প্রাণী খুঁজে বেড়ায়, বরগুনা তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর শিল্পপতি ও বিনিয়োগকারীদের জন্য অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে বঙ্গোপসাগর পাড়ের জনপদ বরগুনা। বিশেষত জাহাজসহ নানা ধরনের নৌযানের নির্মাণ, পুনর্র্নির্মাণ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও মেরামতের এক নতুন ও বড় গন্তব্য হতে চলেছে বরগুনা। মাছ ও বিষমুক্ত শুঁটকি রপ্তানি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বরগুনার নাম না জানা উদ্যোক্তারা। চীন ও মালয়েশিয়ায় সেনাবাইম মাছ এবং কাঁকড়া রপ্তানি করে তারা দেশের ডলার খরা নিরসনে কিছুটা হলেও অবদান রাখছেন। ৪টি বড় নদী, ১২টি ছোট নদী আর অসংখ্য খাল-বিলের মাছ দেশের পুষ্টি নিরাপত্তায় অবদান রাখছে। আর খাদ্য নিরাপত্তায় আশীর্বাদ হয়ে আছে বরগুনার ধান, রবিশস্য, ডাল, মরিচ, আলু, কুমড়া, তরমুজ প্রভৃতি। পর্যটনের ক্ষেত্রে বরগুনা এক ঈর্ষণীয় নাম। বালুকাময় সমুদ্রতীর, নোনা পানিসহিষ্ণু বনাঞ্চল, মনোমুগ্ধকর ছোট ছোট দ্বীপ, উদাস নদী অববাহিকা, ইকোপার্ক আর নানা প্রজাতির জীববৈচিত্র্য যে কোনো বিচারে বরগুনার পর্যটন সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে আসে।

প্রিয় পাঠক বরগুনা নিয়ে বিড়বিড় করে এতক্ষণ যা কিছু লিখলাম, তা খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কারণ মিডিয়াময় বিশ্বে বরগুনা নিয়ে এমন ইতিবাচক খবরের চেয়ে বিরূপ বা নেতিবাচক বার্তাই যেন বেশি।

সম্প্রতি বরগুনা আলোচনায় এসেছে একটি বিষাদময় সংবাদকে কেন্দ্র করে। জেলার আমতলী উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়ন এবং চাওড়া ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থানে লোহার তৈরি একটি ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজ ছিল। ২২ জুন ২০২৪, শনিবার, একটি মাইক্রোবাস ও অটোরিকশাসহ ব্রিজটি ভেঙে পড়ে। এতে মাইক্রোবাসে থাকা স্থানীয় একটি বিয়েবাড়িমুখী ৯ নারী ও ১ শিশুসহ এ পর্যন্ত ১০ জন মৃত্যুবরণ করেন। মুহূর্তে বিয়ের আনন্দ আলো নিভে যায়, আর নেমে আসে বিষাদের অন্ধকার।

বরগুনার এই নির্মম মৃত্যুকে নিছক দুর্ঘটনা বলার সুযোগ নেই। প্রায় এক বছর আগে (২৯ জুলাই ২০২৩) বরগুনার ১৬৭টি লোহার সেতু ও ৪২টি পাকা সেতু চলাচলের অনুপযোগী এবং ঝুঁকিপূর্ণ বলে একটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশিত হয়। চলতি বছর ৩০ এপ্রিল একই জেলার ২৬৬টি লোহার ব্রিজ এখন মৃত্যুফাঁদ বলে সংবাদ প্রকাশ করে আরেকটি দৈনিক সংবাদপত্র। এ ছাড়া আরও বহু পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ-সংক্রান্ত কন্টেন্টের ছড়াছড়ি দেখা যায়। সম্প্রতি ১০টি প্রাণ কেড়ে নেওয়া ব্রিজটিও তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু এ নিয়ে বছরের পর বছর কেউ কিছু না করার করুণ পরিণতি এমন ১০টি প্রাণের অকালমৃত্যু। সম্প্রতি বেশকিছু টিভির অনুসন্ধানে দেখা যায়- ১৫ বছর আগে খুব অযত্নে ও নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। অথচ এখন এ দায় কেউ আর নিতে রাজি নয়। স্থানীয় কেউ কেউ জীবনজীবিকার প্রয়োজনে জোড়াতালি দিয়ে এখনো এমন অসংখ্য ব্রিজ পার হতে বাধ্য হচ্ছেন। তাই ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা করছেন সবাই। সরকারি কোষাগারে টাকা নেই বলে এমন মৃত্যুফাঁদ সংস্কার করা যাচ্ছে না বলে ভাবার অবকাশ নেই। কারণ এ দেশেরই শতাধিক ব্রিজসহ সহস্রাধিক সরকারি স্থাপনা আছে, যা জনগণের কোনো কাজে আসছে না, বরং নির্মাণের পর থেকে ব্যবহৃত না হওয়ায় সেগুলো ধ্বংস হচ্ছে বা অপরাধ ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। খোদ বরগুনার আমতলীতে ৮৫ লাখ টাকায় নির্মিত ব্রিজের দুই পাশে ওঠানামার সুবিধা নেই। একদিকে নারিকেল গাছের কাণ্ড আর অন্যদিকে বাবলা গাছের মই বেয়ে ঝুঁকি নিয়ে ব্রিজ পারাপার হয় আবালবৃদ্ধবনিতা। (সূত্র : একটি টেলিভিশন নিউজ, ৩ অক্টোবর ২০২৩)। অন্যদিকে বরগুনার টেংরাগিরি ইকোপার্কের সংযোগ সড়কে ৭ কোটি টাকা বরাদ্দ হয় একটি সেতু নির্মাণের জন্য। দুই পাশের রাস্তা নির্মিত হয়ে গেলেও দুই বছরে মূল সেতুটি নির্মাণ হয়নি সেতুর উচ্চতাসংক্রান্ত জটিলতায় (সূত্র : বণিক বার্তা, ৫ ডিসেম্বর ২০২৩)। বরগুনায় সাম্প্রতিক দুর্ঘটনাস্থলের অদূরে চাওড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছিলেন মো. বাদল খান। তার ছোট ভাইয়ের নাম মো. আলমাস খান। এই খান ব্রাদার্স ব্রিজ নির্মাণ না করেই সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দু-দুটি ব্রিজের জন্য বরাদ্দ টাকা গায়েব করে দেন। এ নিয়ে মামলা করেছে দুদক (সূত্র : ১৫ মার্চ ২০২১)। এমন আরও বহু খবরে ভরা নেট দুনিয়া। এর মধ্যে একটি হলো টাকা মেরে দেওয়ার খবর প্রকাশের পর এবং টাকা উত্তোলনের তিন বছরের মাথায় নির্মিত হয় একটি লোহার ব্রিজ (সূত্র : আজকের পত্রিকা, ১০ জানুয়ারি ২০২৩)।

বরগুনার আরও কিছু বিরূপ খবরের মধ্যে একটি হচ্ছে ৩ কোটি টাকার স্কুল ভবন নির্মাণের কাজ এক বছর ধরে বন্ধ, কেটে গেছে পাঁচ বছর (সূত্র : কালবেলা, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)। আরেকটি খবর হলো- ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন ভূমি অফিসের সম্মুখভাগ বিকট শব্দে ভেঙে পড়েছে (সূত্র : বাংলানিউজ, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১)। জেলার বেতাগীতে সরকারের ১৪ লাখ ১০ হাজার ৩৮২ টাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম শিকদারের জন্য ‘বীর নিবাস’ নামের আবাসস্থল নির্মাণের পরপরই তা ভেঙে পড়ে (সূত্র : বাংলানিউজ ১৭ এপ্রিল ২০২২)। সরকার থেকে বরাদ্দ ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকার প্রকল্পের আওতায় বেতাগী এলাকায় একটি মাদরাসার সিঁড়ি ভেঙে পড়ে নির্মাণের পরপর (সূত্র : ক্রাইম নিউজ ২০২৩)। বরগুনার ৮২টি সরকারি দফতরের অব্যবহৃত কোটি কোটি টাকার প্রায় ২০০ যানবাহন খোলা আকাশের নিচে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে (সূত্র : সময় টিভি)।

বরগুনার এমন বিরূপ বার্তা দেশজুড়ে চলমান অসম উন্নয়ন, টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনার অভাব, তদারকি ও জবাবদিহি না থাকার অপসংস্কৃতি, সর্বোপরি সর্বগ্রাসী দুর্নীতির একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। এখনো শত শত ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজ দিয়ে নিত্য পারাপার হয় বরগুনার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ও স্কুলগামী নিষ্পাপ শিশুরা। সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড লাগানো ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেন আর কোনো দায়িত্ব নেই। অথচ স্থানীয় সৎ ও কর্মঠ জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সহায়তা নিয়ে সরকারি বরাদ্দের দিকে না তাকিয়ে বরং স্বেচ্ছায় এ ধরনের বা এর চেয়ে বড় বড় মেরামত বা নতুন কিছু নির্মাণের শত শত উদাহরণ এ দেশেই সৃষ্টি করেছেন।

বরগুনার কয়েক শ ঝুঁকিপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে হাজারো শিশু, এমন খবরও প্রকাশিত হয়েছে। একটি কল্যাণগামী গণতান্ত্রিক দেশে এমন পরিস্থিতি বড্ড বেমানান। বরগুনার এই করুণ মৃত্যু থেকে শিক্ষা নিয়ে এ দেশের সরকারি সব মহল ও জনপ্রতিনিধি জননিরাপত্তায় অবদান রাখবেন, এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

Email: [email protected]

সর্বশেষ খবর