শিরোনাম
শুক্রবার, ২৮ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

সবখানেই মুখোশ, মানুষ নেই একজনও!

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

সবখানেই মুখোশ, মানুষ নেই একজনও!
বিশ্বাস একটা শব্দমাত্র, অথচ এর শেকড় অনেক গভীরে। ঠিক যেন একটা বটগাছের মতো, যার শেকড় মাটির অনেক গভীরে আর শেকড়ের বিস্তৃতি মাটিকে আঁকড়ে ধরে চারপাশে এবড়ো-খেবড়োভাবে। অথচ যতক্ষণ এ শেকড় মাটির নিচে থাকে, ততক্ষণ সেটাকে দেখা যায় না, অথচ গাছটা উপড়ে শেকড়টা বেরিয়ে এলে নিজের অস্তিত্বকে হারায়, কারণ তখন যে অদেখা বিশ্বাস নগ্ন সত্য হয়ে যায়

১. মনে আছে ক্লোজআপ ওয়ানের তারকা শিল্পী রিংকুর কথা। মাথা বেয়ে পেছনে লম্বা লম্বা উসকো-খুসকো চুল, খুব সাধারণ গোছের মুখ। অচেনা একটা গ্রামের তরুণ কাঁচা মাটির রাস্তা থেকে উঠে এসে পিচঢালা পাথরের নগরে পা রেখেছিল, সংগীত দিয়ে মাতিয়েছিল সারা দেশকে। অখ্যাত একটা লিকলিকে ছেলে কণ্ঠের জাদুতে সহসাই বিখ্যাত হয়ে উঠছিল, করপোরেট দুনিয়ার মানুষ বোধ হয় তাকে মানুষ হিসেবে নয়, বরং নিজেদের বাণিজ্যের পণ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিল। তখন তার সুসময়, চারপাশে স্বপ্নের হাতছানি, মায়ার জাল। কিন্তু বাস্তবতা যে খুব কঠিন, খুব নির্মম, সময় বদলে যায় চোখের পলকে। আকাশের জ্বলজ্বলে তারা মিটমিট করে আলো ছড়ায়, খুব আগ্রহ নিয়ে মানুষ সেই সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়, অথচ সেই আকাশে ঝুলে থাকা তারার যখন পতন ঘটে, কেউ আর তখন তাকে মনে রাখে না। রিংকুর জীবনটাও এমন। সেই সুসময় আর নেই, দুঃসময়ের জীবন কাটছে তার।

সুসময়ে তার চারপাশে কত মানুষের ভিড় ছিল, যেদিকে তাকাত সেদিকেই ঝলমলে আলোর ঝলকানি ছিল, জমকালো উৎসবে হাজার মানুষের গ্রোতেও নিজেকে উজ্জ্বল মনে হতো, অথচ এখন সব আছে, কোথাও সে নেই।

তার কতগুলো কথা আজকে আবার মনের দরজায় এসে ধাক্কা দিল, আয়নায় দেখলাম একটা মুখ, বুঝলাম না সেটা আমার, না অন্য কারও। বাইরে বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টি, বুঝলাম প্রকৃতি কাঁদতে জানে, আর কেউ কেউ কান্নাকে বুকে চেপে ধরে পাথর হয়ে যায়। মনে হলো আসলে মানুষের কাছে মানুষ শ্রেফ একটা প্রয়োজন, এর বেশি কিছু নয়।

রিংকু বলছিলেন, ‘একটু আড়াল হলেই বন্ধু, সহকর্মীরা কাজের জন্য খোঁজখবর নিতেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে নওগাঁর আত্রাই উপজেলার গ্রামের বাড়িতে থাকার পর সেই প্রিয় মানুষেরা যেন অচেনা হয়ে যান। সেই মানুষেরাই আর খবর নেন না।’

সেই কষ্টের কথা বলতে গিয়ে রিংকু আরও বলছিলেন, ‘এখন আমার খবর আর কে নেবে। আমি আর কোনো কাজেও লাগি না। কেউ আমার খবরও নেয় না। ইন্ডাস্ট্রির মানুষেরা স্বার্থপর। আমি অসুস্থ হওয়ার পর কারও কাছ থেকে তেমন সহায়তা পাইনি। ক্লোজআপ ওয়ানের বন্ধুরাও খবর নেয় না।’

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক। শেষ জীবনটা কেটেছে বস্তিতে। চোখে ঝুলানো নিকেলের চশমা, মুখটা চেনা চেনা, তারপরও কত অচেনা। বিধ্বস্ত মুখ, ভেঙে পড়া নদীর মতো। ঠিক তার লেখা পদ্মা নদীর মাঝির মতো একটা মানুষ। জীবনের বাতি যখন নিবু নিবু তখন বুঝেছিলেন, এই পৃথিবীর মানুষ কেবল নিতে জানে, দিতে জানে না। খুব অভিমান নিয়ে অন্তিম সময়ে বলেছিলেন, ‘দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাঙলা দেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়’। কে জানে কার প্রতি এ ক্ষোভ, নিজের প্রতি, না সেই স্বার্থপর মানুষদের প্রতি।

একসময় সব চিনতে চিনতে নিজেকেই তো আর চেনা যায় না। মাত্র আটচল্লিশ বছরের জীবন, হয়তো অনেকটা সময় টেনে নেওয়া যেত তার এ জীবনকে। কিন্তু জীবনের সঙ্গে লড়তে লড়তে যখন ভেঙে পড়েছেন, শরীরে বাসা বেঁধেছে রোগ। হয়তো হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করালে সেরে উঠতেন; কিন্তু গুণী মানুষের মাথাভরা জ্ঞান থাকলেও পকেট থাকে শূন্য। এই তো জীবন, মনে হবে সব আছে, অথচ কতটা শূন্যতা চারপাশে।

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বেদনাহত মন নিয়ে মানিকের স্ত্রীকে বলেছিলেন, হাসপাতালে নেওয়া গেল না, বিলম্বই হয়ে গেল, আহা, আর কটা দিন আগে নিলে হয়তো বাঁচানো যেত। টেলিফোন করে তো জানাতে পারতে?

এতটা বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়েও মুখে ট্র্যাজেডির হাসি ধরে রেখে ভদ্রমহিলা মৃদুস্বরে বলেছিলেন, ‘তাতে যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই।’

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন- ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’। মানুষের জীবনটা বুঝি পুতুলনাচের মতোই। সবাই সুতোতে বেঁধে খেলতে চায়, মুখে বলে স্বাধীনতার কথা, অথচ কথা কেড়ে নেয়, হাত বেঁধে দেয়, শিকল পরিয়ে দেয় শরীর ও মনে। সারা পৃথিবীটাই তো এমন, কেউ খেলছে, কেউ খেলাচ্ছে। তাদের মাঝখানে পড়েছে সেই সাধারণ মানুষগুলো, যাদের কারও কাছেই মূল্য নেই। ফুটবলের মতো অনেকটা, বাতাস ভরা থাকলেও লাথি মারে, বাতাস বেরিয়ে চুপসে গেলেও ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে।

২. বিশ্বাস একটা শব্দমাত্র, অথচ এর শেকড় অনেক গভীরে। ঠিক যেন একটা বটগাছের মতো, যার শেকড় মাটির অনেক গভীরে আর শেকড়ের বিস্তৃতি মাটিকে আঁকড়ে ধরে চারপাশে এবড়ো-খেবড়োভাবে। যতক্ষণ এ শেকড় মাটির নিচে থাকে, ততক্ষণ সেটাকে দেখা যায় না, অথচ গাছটা উপড়ে শেকড়টা বেরিয়ে এলে নিজের অস্তিত্বকে হারায়, কারণ তখন যে অদেখা বিশ্বাস নগ্ন সত্য হয়ে যায়। বিশ্বাস এমনই, মনে হবে নিজের সঙ্গে আছে, অথচ সেটাকে দেখতে পাচ্ছি না। এই না দেখার অতৃপ্তিটাই বিশ্বাসের মূল শক্তি। যখন মানুষ বলে, আমি বিশ্বাসকে দেখেছি, তখন তার ভিতর থেকে বিশ্বাস বের হয়ে যায়, একবার বিশ্বাস বের হয়ে গেলে তা আর কখনো ফিরে পাওয়া যায় না।

বিশ্বাস নিয়ে কথা বলছিলাম। এ সংক্রান্ত একটা ছোট গল্প আছে, কোনো এক জনপদে দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টি না হওয়ায় সেই জনপদের মানুষেরা সিদ্ধান্ত নিল, সবাই মিলে একটা বড় মাঠে গিয়ে একত্রে প্রার্থনা করবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ, সেই জনপদের সবাই মাঠটিতে প্রার্থনার উদ্দেশ্যে একত্রিত হলো, যাতে বৃষ্টি নেমে আসে খরতাপে পোড়া জনপদে। কাঁদছে শুষ্ক মাটি, কাঁদছে মানুষের মন। মাটি কাঁদলে যে মনও কাঁদে, অথচ সে কান্নার ভিতরে বেরোতে পারছে না পানি। কারণ বৃষ্টিই যে নেই অনেক দিন।

সবাই যখন প্রার্থনার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ১০-১২ বছরের একটা ছেলে ছাতা হাতে নিয়ে সেই প্রার্থনা সভায় যোগ দিতে এলো। সবাই খুব অবাক হলো, কী ব্যাপার, বৃষ্টি নেই, তারপরও ছেলেটা সঙ্গে ছাতা নিয়ে এসেছে। সবাই কৌতূহলবশত ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করল, কী হে, আমরা তো বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতে এসেছি, তুমি কেন ছাতা নিয়ে এসেছো। তখন ছেলেটা দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলল, আমি বিশ্বাস করি, সবার প্রার্থনায় বৃষ্টি নেমে আসবে সহসাই, তাই বৃষ্টি থেকে নিজেকে সুরক্ষিত করতে ছাতা নিয়ে এসেছি।

সবাই সেখানে প্রার্থনার জন্যই এসেছিল, আর ছেলেটা বিশ্বাস নিয়ে এসেছিল যে এই প্রার্থনার পরেই বৃষ্টি নেমে আসবে। এটাই বিশ্বাস, যেটাকে না দেখেও নিজের সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়।

কথিত আছে, পাবলো পিকাসো যখন মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে এলেন, তখন তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল দুটো শব্দ, পিজ, পিজ। ‘পিজ’ মূলত ‘লাপিজ’ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ, যার অর্থ পেনসিল। পিকাসোর মা তখন থেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন তার ছেলে এক দিন পৃথিবীর সেরা মানুষদের একজন হয়ে উঠবেন। বাস্তবে হয়েছেনও তাই, পৃথিবীর বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের মধ্যে তিনি একজন। সব মায়ের মনেই এমন বিশ্বাস থাকে, অথচ কজনইবা সেই বিশ্বাসের মূল্য বোঝে! সবাই যে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, সরলতার দাম নেই এ পৃথিবীতে, অথচ বিশ্বাসে থাকে বোকার মতো সরলতা।

বিশ্বাস যখন বাস্তবতা হয়েছে, তখন আরেক বিশ্বাসের জন্ম হয়েছে। বিশ্বাস এমনই, একটার পর একটা পথ পাড়ি দেয়, অথচ বিশ্বাসের দেখা পায় না কখনোই। যদিও পাবলো পিকাসো বিশ্বাস প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমরা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারব পরিকল্পনা নামের একটি গাড়িতে চড়ে, যে গাড়ির প্রতি আমাদের থাকতে হবে অগাধ বিশ্বাস এবং যার ওপর ভিত্তি করে আমাদের নিরন্তর কাজ করে যেতে হবে। এর বাইরে সাফল্যের আর কোনো পথ নেই।’ অথচ তাকে যখন প্রশ্ন করা হতো আপনার বিখ্যাত চিত্রকর্ম কোনটা, তখন তিনি বলতেন হয়তো পরের চিত্রকর্মটাই আমার বিখ্যাত চিত্রকর্ম হবে। এভাবেই একটার পর একটা বিখ্যাত চিত্রকর্মের জন্ম হয়েছে তার হাতে, অথচ নিজের কাছে নিজের বিখ্যাত চিত্রকর্মটা দেখার বিশ্বাসের অতৃপ্তিটা থেকে গেছে আমৃত্যু। পুরনো চিত্রকর্মের ধারাকে পেছনে ফেলে সব সময় নতুন নতুন ধারার চিত্রকর্মের জন্ম দিয়েছেন, অথচ বলতেন, আমি খুঁজি না, আমি পেয়ে যাই। বিশ্বাস এমনই খুঁজতে গেলে হারিয়ে যায়, না খুঁজলে পাওয়া যায়।

পিকাসো মরে গেলেও তার চিত্রকর্মগুলো তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, হয়তো রাখবে অনন্তকাল। মানুষ মরে যায়, অথচ কী অদ্ভুতভাবে বিশ্বাস বেঁচে থাকে মহাকাল থেকে মহাকালে, সভ্যতা থেকে সভ্যতায়। মহাকালের গর্ভে মহাকাল হারিয়ে যায়, সভ্যতার পর সভ্যতা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, কিন্তু বিশ্বাস ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে অবিচলভাবে, এত শক্তি নেই কারও তাকে সরাবার, হয়তো বিশ্বাসের রূপান্তর ঘটে, কিন্তু বিশ্বাস বিশ্বাসের মতোই মাথা উঁচু করে থাকে। যেখানে ভয় নেই, বরং আছে সাহস। যে সাহস মানুষের মুখে ভাষা দেয়, ভাষা কেড়ে নেয় না।

অথচ আজকের এ পৃথিবীতে বিশ্বাসকে চেনাই যে খুব কঠিন। ভাবছি, চলছি বিশ্বাসের সঙ্গে, অথচ চারপাশে কেবল বিশ্বাসঘাতকের মুখ। হোঁচট খাই নিজের ছায়া দেখে, যদি নিজের ছায়াটাও বিশ্বাসঘাতক হয়ে ওঠে।

৩. গল্পটা হয়তো অনেক চেনা, অথচ গল্প মানুষকে নিজেকে চেনায়। কারণ কখনো কখনো গল্প যে জীবন থেকেই নেওয়া হয়। আচ্ছা, ভাবুনতো, এ পৃথিবীতে কত মানুষ এসেছে, আবার চলেও গেছে, কিন্তু মানুষের এ আগমন-প্রস্থান কখনো থেমে থাকেনি। এ মানুষদের নিয়ে যদি গল্প লেখা হতো, সেই গল্পগুলো যদি এখনো লেখা চলতে থাকত, তবে হয়তো সবাই বলত মানুষকে নিয়ে লেখা গল্প। সেখানে সবাই মানুষ, কিন্তু কারও গল্পের সঙ্গে কারও গল্প কি মিলত! মানুষ একাই এ পৃথিবীতে আসে, একাই চলে যায়। শূন্য হাতে আসে, শূন্য হাতে বিদায় নেয়, অথচ মধ্যবর্তী সময়ের গল্পগুলো কতটা অন্যরকম।

অদ্ভুত একটা বিষয় হলো- লেখকরাও গল্প লিখে নিজের মতো করে, গল্পের অনেক চরিত্র থাকে, শেষটা ঠিক কেমন হবে, লেখক হয়তো নিজেও জানেন না, অথচ লেখাটাকে টানতে টানতে অনেকটা দূর নিয়ে যান কিন্তু শেষটা লেখকের মতোই হয়, মানুষের মতো কি সেটা হয়?

বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের একটা উল্লেখযোগ্য চরিত্র ছিল বাকের ভাই। ঠিক এ সময়ের নাটক সেটা ছিল না, যদি সময়ের হিসাব করি, তবে ৩২ বছর আগে ফিরে যেতে হবে। বাকের ভাই মাস্তান গোছের মানুষ হলেও তিনি ছিলেন সত্যের প্রতি অবিচল, মানুষের প্রতি তার ছিল অগাধ ভালোবাসা। কারণ নিঃস্বার্থ, পরোপকারী মানুষ হিসেবেই তার চরিত্রটি লেখা হয়েছিল। যদিও বলছি মাস্তান, আসলে মাস্তান নয়, একজন পথের মানুষ, যার ভাবনাজুড়ে ছিল মানুষ।

মিথ্যা খুনের মামলায় সাক্ষীদের মিথ্যা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বাকের ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ড হবে কি হবে না, এ জায়গাতে এসে লেখক যেন থেমে গেল। টেলিভিশনের নাটক আর টেলিভিশনের মধ্যে বন্দি থাকল না, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তব জীবনের মানুষের গল্প হয়ে গেল। সারা দেশে তখন মানুষের তুমুল প্রতিবাদ ‘বাকের ভাইয়ের মুক্তি চাই, বাকের ভাইয়ের মুক্তি চাই’। একটা নাটকের চরিত্র, অথচ মনে হলো সারা দেশের মানুষের কাছে বাকের ভাই কত আপন। মানুষের একটাই চেষ্টা, প্রতিবাদের মুখে লেখকের মন গলে যদি বাকের ভাইকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা যায়। অথচ মানুষ যেটা চাচ্ছিল না, লেখক সেটাই লিখে ফেললেন।

প্রশ্ন হতে পারে, কেন এত মানুষের আবেদন আর প্রতিবাদের পরও লেখক মৃত্যুদণ্ডের সিদ্ধান্তকেই বজায় রাখলেন। এর কারণ কী হতে পারে? এটা আমার মতামত, লেখকরা কখনো মানুষকে মাথায় রেখে গল্প লিখেন না, বরং মানুষ যেটা চায় না, মানুষ যেটা ভাবতে পারে না সেটা নিয়েই গল্প লিখেন।

সত্যি করে বলুন দেখি, বুকে হাত দিয়ে বলুন, সেদিন যদি বাকের ভাই মুক্তি পেত, তবে কি সেই পেছনে ফেলে আসা নাটকটা এখনো মানুষ মনে রাখত? আমার তো মনে হয় মনে রাখত না, যা মানুষকে আনন্দ দেয়, তা হারিয়ে যায়। বরং যা মানুষকে কষ্ট দেয়, কাঁদায়, আঘাত করে সেটাই মানুষ আজীবন মনে রাখে। বাকের ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ডের সিদ্ধান্তে সেদিন মানুষের মন ভেঙে পড়েছিল বলেই মানুষ সেটাকে মনে রেখেছে। মানুষ সেদিন কেঁদেছিল বলেই সেই নাটকটাকে ভুলে যায়নি।

জীবনে আনন্দ যতটা না মানুষ মনে রাখে, আঘাত ততটাই মানুষ মনে রাখে। আনন্দ, হাসিগুলো সময়ের গর্ভে হারিয়ে যায়, কষ্ট আর আঘাতগুলো থেকে যায়।

অতৃপ্তি যেখানে থাকে, সেটা মানুষের মনে রেখাপাত করে, কারণ অতৃপ্তি মানুষকে স্বপ্ন পূরণের দিকে টেনে নিয়ে যায়, স্বপ্ন পূরণ হবে কি হবে না, সেটার চেয়েও বড় জীবন পূর্ণতায় স্বপ্ন দেখে না, অপূর্ণতা মানুষকে স্বপ্ন দেখায়।

সেই ১৯৯২ সালের মানুষের কথা ভাবছি, কতটা আবেগ, কতটা অনুভূতি, কতটা ভালোবাসা তাদের কাজ করত, তখন প্রযুক্তি এতটা বিকশিত হয়নি, কিন্তু মন বিকশিত ছিল। এখন ২০২৪, প্রযুক্তি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নাম ভাঙিয়ে মানুষকে আরও যন্ত্র বানিয়েছে, মানুষের মনটাই কেড়ে নিয়েছে।

মাত্র ৩২ বছরের ব্যবধান, অথচ সময় এসে মানুষের জীবনের গল্পগুলোই বদলে দিল। আরও কত বদলাবে কে জানে? হয়তো সময় এর উত্তর দিতে পারবে, আর কেউ নয়, কারণ এত মানুষ, এত টাকায় উড়ানো উৎসব অথচ কোথাও কেউ নেই। এ সময়ে এসে ডায়োজেনিসের মতো দিনের আলোয় হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজছি সেই মানুষগুলোকে, অথচ সবখানেই মুখোশ, মানুষ নেই একজনও।

লেখক : শিক্ষাবিদ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

সর্বশেষ খবর