শুক্রবার, ২৮ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

দেশে ফিরে হাজিদের করণীয় ও বর্জনীয়

মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী

দেশে ফিরে হাজিদের করণীয় ও বর্জনীয়

হাজিরা হজ পালন শেষে দেশে ফিরতে শুরু করেছেন। পবিত্র হজ পালনকারীর জন্য পবিত্র ভূমি থেকে দেশে ফিরেই বাড়ির নিকটস্থ মসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নত। কেননা রসুলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো সফর থেকে ফিরে আসতেন, তখন মসজিদে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করতেন (বুখারি)। এরপর নিজ ঘরে এসে দুই রাকাত নামাজ আদায় করাও মুস্তাহাব। নবীজি (সা.) বলেন, যখন তুমি ঘর থেকে বের হবে তখন দুই রাকাত নামাজ পড়বে, সেই নামাজ তোমাকে ঘরের বাইরের বিপদাপদ থেকে হেফাজত করবে। আর যখন ঘরে ফিরবে তখনো দুই রাকাত নামাজ আদায় করবে, সে নামাজ তোমাকে ঘরের অভ্যন্তরীণ বালামুসিবত থেকে হেফাজত করবে। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে হজ পালনের পর, মহান রব্বুল আলামিনের দরবারে শুকরিয়াস্বরূপ স্বদেশে ফিরে গরিব মিসকিন ও আত্মীয়স্বজনকে খাবারের দাওয়াত দেওয়া বৈধ। কেননা নবীজি (সা.) যখন মদিনায় এসেছেন, তখন একটি গরু জবাইয়ের নির্দেশ দেন, এরপর তা থেকে সাহাবিরা আহার করেছেন (বুখারি)। তবে সব রকমের অহংকার, রিয়া ও নিজের সুনাম- সুখ্যাতি প্রচার করা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত রাখতে হবে। হজ-পরবর্তী হাজি সাহেবদের অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা জানানো, সৌজন্য সাক্ষাৎ ও কোলাকুলি করা এবং তাদের দিয়ে দোয়া করানো মুস্তাহাব এবং পবিত্র মক্কা-মদিনা থেকে নিয়ে আসা বরকতময় খেজুর ও জমজমের পানি এলাকার মুসলমানদের হাদিয়া দেওয়া মুস্তাহাব।

সম্পদশালী, সচ্ছল ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবানদের জন্য জীবনে একবার হজ আদায় করা ফরজ। পবিত্র নগরী মক্কায় আসা এবং এখানের আচার অনুষ্ঠান সম্পাদন ইত্যাদি কার্যক্রমের মধ্যেই শুধু হজের মূল উদ্দেশ্য শেষ হয়ে যায় না, বরং হজ-পরবর্তী সময়েও রয়েছে তাদের জন্য বিশেষ জীবনযাপন, পরহেজগারি ও আমলি জিন্দেগি। ইসলামের শান্তি ও ইমানের দৃঢ়তায় আল্লাহতায়ালার একনিষ্ঠ একাত্মবাদের আলোকে জীবন পরিচালনার জন্য অন্যতম সহায়ক হলো হজ। সুতরাং হজ-পরবর্তী জীবন হবে তাওহিদনির্ভর। হজ-পরবর্তী এমন কোনো কাজই করা যাবে না, যেখানে আল্লাহর সঙ্গে অংশীদারির ন্যূনতম সম্পর্ক রয়েছে। আল্লাহ ও তাঁর রসুলের পক্ষ থেকে মহান হজের দিনে মানুষের প্রতি বিশেষ বার্তা হলো, আল্লাহর সঙ্গে শিরককারীদের কোনো সম্পর্ক নেই এবং তাঁর রসুলের সঙ্গেও নেই। (সুরা তওবা, আয়াত ৩)। হজের পর গুনাহমুক্ত জীবনযাপনই হলো হজ কবুল হওয়ার লক্ষণ। হজের পর হজ পালনকারীদের উচিত আল্লাহর বিধিবিধান পালনের প্রতি যথাযথ গুরুত্বারোপ করা। অর্থাৎ গুনাহমুক্ত নতুন পবিত্র জীবনকে সব রকমের অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করা। কেননা নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ আদায় করল, সে তার ঘরে ফিরে এলো সদ্যভূমিষ্ঠ, নিষ্পাপ মাসুম শিশুর মতো। অতএব একজন হাজির উচিত হবে সর্বস্তরের ভালো কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। ন্যূনতম পাপের কাজ থেকেও নিজেকে মুক্ত রাখা। হজ-পরবর্তী নিজেকে একজন আল্লাহভীরু, আদর্শ মুসলিম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। নিজের পরিবার, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, মা-বাবা ভাই-বোনকে ইসলামী বিধিবিধান মতো পরিচালিত করা। প্রতিবেশী, সমাজ ও আত্মীয়স্বজন সবার মাঝে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক চেষ্টা করা এবং সর্বস্তরে সব রকমের পাপাচার, অন্যায়, অশ্লীল ও ইসলামবিদ্বেষী কর্মকাণ্ডের সাধ্যমতো প্রতিবাদ করা। হজকে নিজের সুনাম, সুখ্যাতি বৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করা। হজ যাদের কবুল হয় তাদের জীবনের মোড় ও কর্মের অভিযাত্রা ঘুরে যায় এবং ইসলামী লেবাস, সুন্নতের প্রতি আগ্রহ, ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের প্রাধান্যই তার মাঝে বেশি পরিলক্ষিত হবে। হারাম-হালালের বাছবিচার, বৈধাবৈধতার সমাচার, সর্বোপরি আখেরাতের প্রাধান্যের নিরিখেই তার প্রতিটি পদক্ষেপে স্বাক্ষর রাখবে। স্মরণ রাখবে যে আমি তো অন্যদের মতো নই, আমি একজন হাজি মুসলিম, সুতরাং আমি যা ইচ্ছা তাই অন্যদের মতো করতে পারি না। আমাকে সর্বদা একজন খাঁটি মুসলিম হিসেবে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ অনুগত থাকতে হবে। হজ আদায় করার পর যার জীবনে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আসেনি, তার হজ কবুল হওয়ার বিষয়টি সন্দেহমুক্ত নয়। অনেকে দেখা যায় হজ আদায় করার পরও ফরজ কাজগুলো নির্দ্বিধায় ছেড়ে দেয় এবং হারাম কাজগুলো নির্দ্বিধায় করতে থাকে যেমন : নামাজ ত্যাগ, রোজা ও জাকাত আদায়ে অনীহ ভাব প্রকাশ, পর্দার বিধান মেনে না চলা, নিজের স্ত্রী, মেয়ে ও বোনকে পর্দায় রাখতে না চাওয়া, পরনারীর সঙ্গে দেখা করা, কথা বলা ও বিনা প্রয়োজনে যোগাযোগ রাখা, অন্যের হক নষ্ট করা, কাউকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, অন্যায়-অবিচার ও জুলুম করা, কাউকে মনে আঘাত দিয়ে কষ্ট দেওয়া, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা, অন্যের গিবত ও দোষচর্চা করা, কারও মানসম্মান নষ্ট করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, মিথ্যা কথা বলা, ওয়াদা ভঙ্গ করা, আমানত রক্ষা না করা, জেনেশুনে ন্যায়ের পক্ষ ত্যাগ করে অন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন, মা-বাবার অবাধ্য হওয়া, প্রতিবেশীর হক নষ্ট করা, সুদ-ঘুষ, মদ, নেশা ও জুয়া খেলায় লিপ্ত হওয়া, ব্যবসায় ওজনে কম দেওয়া, কাউকে ধোঁকা দেওয়া, কাউকে ঠকানো, কিছু দিয়ে কাউকে খোঁটা দেওয়া ও অশ্লীল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ। অহংকার করে দম্ভ করে মাটিতে হাঁটা, দুনিয়াবি স্বার্থে ইসলামবিরোধী কাজে জড়িত হওয়া ইত্যাদি প্রবণতা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।

লেখক : ইমাম ও খতিব, কাওলার বাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণখান, ঢাকা

সর্বশেষ খবর