শিরোনাম
শনিবার, ২৯ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

কৃষিতে সফল মুসা মাস্টার

শাইখ সিরাজ

কৃষিতে সফল মুসা মাস্টার

বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে ফলের চাষ এক সময় ছিল না। মানুষ মূলত নিজের জন্য বসতবাড়ির আশপাশে ফলের চাষ করত। সময়ের পরিবর্তনে কৃষক এখন ফলের বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছেন। বলা যায়, গত দুই দশকে বাণিজ্যিক চাষের সাফল্যের কারণে দেশে ফল উৎপাদনে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যমতে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১০টি শীর্ষ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল (ট্রপিকাল ফ্রুট) উৎপাদনকারী দেশের একটি। দেশি ফলের পাশাপাশি উচ্চমূল্যের বিদেশি ফলের চাষ বেড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা শুধু কৃষক নন, কৃষি পেশার বাইরে অন্য পেশায় নিয়োজিতরাও উদ্যোগী হয়েছেন ফল চাষে। এমনই একজন ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুরের বাগমারি গ্রামের স্কুলশিক্ষক হারুন অর রশীদ মুসা। এলাকায় যিনি মুসা মাস্টার নামেই পরিচিত। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন নিজের কৃষি খামার। নতুন নতুন ফল-ফসল চাষ করে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। পেয়েছেন সাফল্যও। তার কৃষি সাফল্যের সুনাম এলাকা থেকে ছড়িয়ে গেছে সারা দেশে।

কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফসল সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকা জরুরি। জেনে বুঝে বিনিয়োগ করলে কৃষি থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কা খুব কম থাকে। এখন জেনেবুঝেই দেশের বহু কৃষক, তরুণ উদ্যোক্তা এমনকি ভিন্ন পেশার মানুষও কৃষিমুখী হচ্ছেন, নিচ্ছেন বাণিজ্যিক উদ্যোগ। শিক্ষক মুসাও তেমনি একজন। শৈশব থেকেই তিনি কৃষিকে ভালোবাসেন। পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে হাত লাগিয়েছেন। পরবর্তীতে কৃষির নেশায় চাকরি করেও পৈতৃক ভিটেমাটিকে শুধু ঐতিহ্য হিসেবে আঁকড়ে ধরে না রেখে বৈচিত্র্যময় ফল ফসল উৎপাদন করতে চেয়েছেন। সাফল্য আনার প্রচেষ্টায় ছুটে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে গতানুগতিক চাষাবাদের প্রথাকে ভেঙে গড়েছেন বাণিজ্যিক কৃষি খামার।

কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফসল সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকা জরুরি। জেনেবুঝে বিনিয়োগ করলে কৃষি থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কা খুব কম থাকে। এখন জেনেবুঝেই দেশের বহু কৃষক, তরুণ উদ্যোক্তা এমনকি ভিন্ন পেশার মানুষও কৃষিমুখী হচ্ছেন, নিচ্ছেন বাণিজ্যিক উদ্যোগ। শিক্ষক মুসাও তেমনি একজন
বছরখানেক আগে তার কৃষি খামার দেখতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। মুসার বাড়িটি একটি দ্বীপগ্রামে। গ্রামটিকে ঘিরে রেখেছে বনোহর বাঁওড়। গ্রামের সাধারণ মানুষের বাড়ি থেকে তার বাড়িটি ভিন্ন কারণ তার বাড়ির উঠোনে নানান ফল-ফুল গাছ নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চলছে। বলে রাখতে চাই, মুসা বাংলাদেশে অ্যাভোকাডো চাষের সফল বাণিজ্যিক উদ্যোক্তা।

মোট ২০ বিঘার সমন্বিত ফল বাগান তার। এখানে উৎপাদন করছেন অ্যাভোকাডো, মাল্টা, পারসিমন, লংগান, থাই জাম, কমলা, ড্রাগন, ফিলিপিনো আখসহ বিভিন্ন ফসল। গত এক যুগে দেশে ফলের উৎপাদন বেড়েছে ২২ শতাংশ। কম জমিতে বেশি মানুষের দেশ হিসেবে ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকাতেও এখন আমরা। আবার ফল চাষের জমি বৃদ্ধির দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। এই হিসাবে, বছরে ফল চাষের জমি বাড়ছে ১০ শতাংশ হারে। শুধু ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকে নয়, দেশের মানুষের মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণও দ্বিগুণ হয়েছে গত এক যুগে। ২০০৬ সালের এক হিসাবে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে দিনে প্রায় ৫৫ গ্রাম করে ফল খেত। বর্তমানের হিসাবে সেটি প্রায় ৮৫ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। যা দেশের মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য এবং নিরাপদ পুষ্টি গ্রহণ অবস্থার উন্নয়নের একটি বার্তা। দুই দশক আগেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, লিচু ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো ফল উৎপাদনের চিত্র দেখিনি। অথচ গত দুই দশকে নতুন নতুন ফল ফসলে বদলে যাওয়া বহু এলাকার চিত্র দেখছি। কৃষক, উদ্যোক্তাদের মাল্টা, ড্রাগন, পেয়ারা, কুল, কমলা, লটকন ও অ্যাভোকাডোর মতো পুষ্টিকর ফল উৎপাদনে সফল হয়েছেন অনেকে। যা হোক, গ্রামের ফসলের মাঠে হাঁটতে হাঁটতে কথা হচ্ছিল মুসার সঙ্গে। মাঠজুড়েই বিভিন্ন ফসল। কোথাও হয়তো লাউ চাষ হচ্ছে, পাশের জমিতেই ড্রাগন ফ্রুট, পেয়ারা, কলা, আম্রপালি আম কিংবা ফিলিপিনো আখ। এক সময় শুধু ধানই চাষ হতো এসব জমিতে। এখন ফসল বৈচিত্র্যের দারুণ সম্মিলন। মুসা বলছিলেন, উচ্চমূল্যের ফসলের নেশায় যুক্ত হয়েছেন ২০০৫ সালে। প্রথমে বাউকুল, পেয়ারা চাষ করেছেন। তারপর একে একে ড্রাগন, ফিলিপিনো আখ থেকে নানা রকম দেশি-বিদেশি উচ্চ মূল্যের ফল চাষের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন তিনি। সারি বাঁধা আখের খেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে জানালেন, গত দুই বছর ধরে দুই বিঘা জমিতে চাষ করছেন ফিলিপিনো আখ। সারি সারি ফিলিপিনো আখ দেখতে কালচে রঙিন ও বেশ লম্বাকার। জানা গেল, মাঠের এই আখ ভোক্তাদের খাওয়ার জন্য নয়, উৎপাদন হচ্ছে বীজ হিসেবে। এই আখের চাহিদা অনেক। প্রতিটি আখ বীজ হিসেবে কমপক্ষে ১০০ টাকা আর চিবিয়ে খাওয়ার জন্য কমপক্ষে ৫০ টাকা দরে বিক্রি করা যায়। মুসা জানালেন ১ বিঘা জমিতে আছে ১২ হাজার আখ। এই আখ চাষে মোট খরচ ৫০ হাজার টাকা। প্রতিটি আখ ৫০ টাকা হিসেবে বিক্রি করলেও ৬ লাখ টাকা অনায়াসেই পাওয়া যায়। আর বীজ হিসেবে বিক্রি করলে পাওয়া যাবে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা।

এরপর মুসা নিয়ে গেলেন ড্রাগন ফল চাষের খেতে। এখানে ১২ বিঘা ড্রাগন বাগানের মধ্যে পিংক রোজ জাতের ড্রাগন আবাদ হচ্ছে ৫ বিঘায়। দেখতে গোলাপি রঙের এই ড্রাগন অন্য জাতের ড্রাগনের থেকে অধিক ফলনশীল ও লাভজনক, বলছেন উদ্যোক্তা।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গোটা দেশেই রকমারি ফলের উৎপাদন লক্ষ্য করা যায়। শুধু ড্রাগন নয়, বারোমাসি আম, মাল্টা, কমলাসহ বিভিন্ন ফল উৎপাদনের সাফল্য দেখতে পাই। একজন স্কুলশিক্ষক হয়েও হারুন অর রশীদ মুসা কৃষিতেও দারুণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। তার পরিশ্রম আর হাতের যশে উৎপাদন হচ্ছে বৈচিত্র্যময় ফসল। যা থেকে তিনি পেয়েছেন সচ্ছলতা। সবচেয়ে বড় কথা বহু মানুষের কাছে তিনি নতুন নতুন ফলের বীজ পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন। আবার সৃষ্টি করেছেন বহু মানুষের কর্মসংস্থানও।

সারা দেশের অসংখ্য কৃষক, তরুণ উদ্যোক্তার হাত দিয়েই রচিত হচ্ছে কৃষিখাতের নানারকম সফল ঘটনা। এ সব সাফল্য যে শুধু বাণিজ্যের মোহে ঘটছে তা বলা যাবে না বরং মাটি আর ফল-ফসলকে ভালোবেসেই তারা কৃষিতে যুক্ত হয়ে দৃষ্টান্ত গড়ছেন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মাটি যে উচ্চমূল্যের ফসলের জন্য দারুণ উপযোগী তার প্রমাণ আমরা বারবার পাচ্ছি। এ অঞ্চলেই আমরা দেখেছি, বাণিজ্যিক কমলা বাগান, মাল্টা বাগান, আনার বাগানের মতো বিভিন্ন ধরনের নতুন ফসল উৎপাদনের উদ্যোগ। তারা এমন সব সুবিশাল বাগান করে প্রমাণ করেছেন, বাণিজ্যিক ও পরিকল্পিত কৃষি সব সময়ই লাভজনক। এর জন্য চাই নিষ্ঠার সঙ্গে জেনে বুঝে পদক্ষেপটি নেওয়া। যা করে তারা নিজেরা যেমন সফল হচ্ছেন, একইভাবে যুক্তি পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়ে গড়ে তুলছেন নতুন নতুন উদ্যোক্তা। যাদের হাতে সচল হচ্ছে দেশের কৃষি অর্থনীতি, একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে দেশের পুষ্টি উন্নয়নেও। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের বাগমারি গ্রামের স্কুলশিক্ষক হারুন অর রশীদ মুসার সমন্বিত কৃষি খামারটিও নতুন প্রজন্ম বা উদ্যোক্তাদের জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম।

উৎপাদনে যথেষ্ট এগিয়েছে বাংলাদেশ। এখন প্রয়োজন গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসের নিয়মাবলি মেনে ফল-ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ নিশ্চিত করা। যে উদ্যোগী মানুষ ফল-ফসল উৎপাদন করছেন তাদের একটি সুন্দর সুনিশ্চিত বাজার কাঠামোর ভিতর আনতে হবে। যেন তারা হতাশ হয়ে কৃষি থেকে সরে না যান। আরও বেশি উৎপাদনমুখী হতে তাদের অনুপ্রাণিত করতে হবে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর